কক্সবাংলা ডটকম(১ ফেব্রুয়ারি) :: বাংলাদেশের ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিনক্ষণ ঠিক না হলেও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বইছে নির্বাচনি হাওয়া। কেউ বলছেন সরকারের ইচ্ছা থাকলে এ বছরই সম্ভব। কেউ বলছেন পূর্ণ সংস্কার শেষে ভোট হোক। আবার কেউ বলছেন চলতি বছরেই হতে পারে। যত দ্রুত নির্বাচন দিয়ে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হবে, ততই মঙ্গলজনক। এ অবস্থায় জনমনে প্রশ্ন উঠেছে-কবে হবে ভোট?
এরই পরিপ্রেক্ষিতে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর কর্মসূচি এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের দল গঠনের প্রক্রিয়া নিয়ে এই ফেব্রুয়ারিতে রাজনীতির মাঠ বেশ উত্তপ্ত থাকতে পারে। রাজনীতি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মতে, নতুন দল গঠন করা হলে রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন মেরুকরণ হবে। আর আওয়ামী লীগের কর্মসূচি ঘিরে বিপক্ষের শক্তিগুলো সক্রিয় হলে রাজপথে উত্তেজনা ছড়াতে পারে। ফলে রাজনৈতিক নানা ঘটনার কারণে ফেব্রুয়ারি মাস খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে।
এখনো আনুষ্ঠানিক ঘোষণা না দিলেও মধ্য ফেব্রুয়ারিতে কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নামার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএনপি। ১ ফেব্রুয়ারি থেকে টানা কর্মসূচি নিয়ে মাঠে থাকার ঘোষণা দিয়েছে আওয়ামী লীগ। ঘোষণা না দিলেও আওয়ামী লীগের কর্মসূচি ঠেকাতে মাঠে থাকবে জামায়াত। প্রধান তিন রাজনৈতিক শক্তির পাশাপাশি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটির নেতৃত্বে নতুন রাজনৈতিক দল গঠন হওয়ারও কথা রয়েছে এই মাসে।
এদিকে সদ্য ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের ফেসবুক পেজে নির্যাতন ও নিপীড়নের প্রতিবাদ, দেশের জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠাসহ বিভিন্ন দাবিতে ১ থেকে ৫ ফেব্রুয়ারি লিফলেট বা প্রচারপত্র বিলি, ৬ ফেব্রুয়ারি প্রতিবাদ মিছিল ও সমাবেশ, ১০ ফেব্রুয়ারি বিক্ষোভ মিছিল সমাবেশ, ১৬ ফেব্রুয়ারি অবরোধ এবং ১৮ ফেব্রুয়ারি দেশব্যাপী সকাল-সন্ধ্যা সর্বাত্মক কঠোর হরতালের কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়েছে।
দলের সভাপতিমণ্ডলীর এক সদস্য বলেন, দল ভাঙার একটা চেষ্টা চলছে, সামনে এটা আরো বাড়বে। ক্লিন নেতাকর্মীদের ভয়ভীতি দেখানো হচ্ছে। দলের ভাঙন ঠেকাতে কর্মসূচি গুরুত্বপূর্ণ।
তবে মাঠের আন্দোলনের সঙ্গে টেবিলের আলোচনায় জোর দিচ্ছে আওয়ামী লীগ। দেশের বাইরে বৈঠকের পাশাপাশি দেশেও বৈঠক করা হচ্ছে। গত ডিসেম্বরে জাতিসংঘের প্রতিনিধিদলের সঙ্গে ঢাকায় আওয়ামী লীগের বৈঠক হয়েছে। দলের হয়ে বৈঠকে নেতৃত্ব দেন আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য সাবের হোসেন চৌধুরী। বৈঠকটি প্রথমে বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে অবস্থিত দলীয় কার্যালয়ে হওয়ার কথা থাকলেও পরে সাবের হোসেন চৌধুরীর বাসায় হয়। শিগগিরই ঢাকায় আসছে যুক্তরাজ্যের সর্বদলীয় সংসদীয় দল। তাদের সঙ্গেও ঢাকায় আওয়ামী লীগের বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নামাটাই বড় চ্যালেঞ্জ। কারণ বিএনপি-জামায়াতের পাশাপাশি বৈষম্যবিরোধীরাও রাজপথে তাদের মোকাবেলা করবে। তবে বিএনপি মাঠে নামলে সেটি রাজপথকে উত্তপ্ত করবে, তা বলা যায়। আর বৈষম্যবিরোধীদের রাজনৈতিক দল গঠন নিয়ে এরই মধ্যে একধরনের উত্তেজনা বিরাজ করছে।
অপরদিকে জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো এবং আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো তাদের মতামত দিতে শুরু করেছে। এর আগে ভারত ছাড়া আর কেউ দ্রুত নির্বাচনের কথা না বললেও এখন প্রায় সব পক্ষই চায় দ্রুত নির্বাচন।
ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীর সরকারকে সবচেয়ে বেশি সমর্থন দেওয়া দেশ যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমারাও দ্রুত নির্বাচন আয়োজনের পক্ষে মতামত দিচ্ছে। পাশাপাশি দাতা সংস্থা ও মানবাধিকার সংস্থাগুলোর পক্ষ থেকেও নানাভাবে নির্বাচিত সরকারের বিষয় নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। তারা চায় বাংলাদেশে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে গণতন্ত্রে ফিরুক। এ নিয়ে তারা বিএনপিসহ দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বৈঠক করছে।
তবে বিদেশিরা গত তিনটি নির্বাচনের মতো ভোট দেখতে চায় না। তারা ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনা সরকারের শেষ তিনটি নির্বাচনের মতো ভোটারবিহীন, রাতের ভোট কিংবা সব দলের অংশগ্রহণহীন নির্বাচন চায় না। তারা চায় দেশ সুষ্ঠু নির্বাচনের মধ্য দিয়ে গণতন্ত্রের পথে আসুক।
কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, এরই মধ্যে ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকারের সমালোচনা শুরু হয়েছে। সব পক্ষই মনে করে, সংস্কার ইস্যুতে নির্বাচনে বিলম্ব করার সুযোগ নেই। সংস্কার ও নির্বাচনের প্রস্তুতি একসঙ্গেই এ সরকারকে করতে হবে। দিন যত যাবে, নির্বাচনের চাপ তত বাড়তে থাকবে। এটা শুধু রাজনৈতিক দল থেকেই নয়, বিশ্ব সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকেও আসতে থাকবে।
এছাড়া নির্বাচন ও সংস্কার ইস্যুতে সরকার এবং রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যেন কোনো বড় বিরোধ তৈরি না হয়, সেদিকেও সতর্ক থাকা প্রয়োজন মনে করছে সব পক্ষ। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, চীন, জাপান ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত দেশগুলো সংস্কার ও নির্বাচন নিয়ে সরকার এবং রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বৈঠক শুরু করেছে। সেসব বৈঠকে তারা এক ধরনের মধ্যস্থতা করছে।
এর মধ্যে গত বুধবার ঢাকায় নবনিযুক্ত মার্কিন চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স (সিডিএ) ট্রেসি অ্যান জ্যাকবসন আগামী নির্বাচন ও বিদ্যমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে সিরিজ বৈঠক শুরু করেছেন। প্রথম দিন তিনি জাতীয় পার্টি এবং জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে আলোচনা করেছেন। এরপর তিনি বৃহস্পতিবার বিএনপির সঙ্গে বৈঠক করেছেন। এ ছাড়া গণ অধিকার পরিষদসহ অন্যান্য দলের সঙ্গেও বৈঠক করবেন।
এসব বৈঠক সম্পর্কে কোনো পক্ষই সরাসরি কথা বলেনি। তবে বৈঠকে উপস্থিত একাধিক রাজনীতিক নাম প্রকাশ না করে বলেছেন, আলোচনায় রাজনীতি ও নির্বাচন প্রাধান্য পেয়েছে। দেশের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের কূটনীতিক দলগুলোর মতামত জানতে চেয়েছেন। মার্কিন চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র সাধারণত বাংলাদেশের অভ্যন্তর থেকে আসা মতামত গুরুত্ব দিয়ে থাকে। এ কারণেই মার্কিন কূটনীতিক মূলত বাংলাদেশের নেতাদের মতামতই শুনছেন।
জানা গেছে, বুধবার জাতীয় পার্টি ও জামায়াতের সঙ্গে বৈঠকটি মার্কিন ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূতের গুলশানের বাসভবনে হয়। বৈঠকে যুক্তরাষ্ট্রের ডেপুটি রাষ্ট্রদূত মেগান বোল্ডিন উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকে জাতীয় পার্টির নেতাদের মধ্যে ছিলেন দলটির চেয়ারম্যান জিএম কাদের, সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, মহাসচিব মো. মুজিবুল হক চুন্নু, কো-চেয়ারম্যান এবিএম রুহুল আমিন হাওলাদার, প্রেসিডিয়াম সদস্য ও জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যানের বিশেষ দূত মাশরুর মওলা।
জানা গেছে, বৈঠকে জাতীয় পার্টির পক্ষ থেকে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে দলটির অবস্থান তুলে ধরা হয়। বর্তমান সরকারের বিষয়ে নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নেই বলে অভিযোগ করা হয়। বর্তমান সরকারের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে জাতীয় পার্টি। এ সরকারকে দুর্বল বলেও অভিহিত করেন নেতারা। তারা দ্রুত নির্বাচনের পক্ষে মত দেন এবং অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে গণতন্ত্রে ফেরার কথা বলেন। এ সময় দলটির পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়, জাতীয় পার্টিকে রাজনীতির অধিকার চর্চা করতে দেওয়া হচ্ছে না।
জাতীয় পার্টির সঙ্গে বৈঠকের পর ট্রেসি অ্যান জ্যাকবসন জামায়াতে ইসলামীর নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। বৈঠকে দলটির আমির ডা. শফিকুর রহমান, সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার, নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের উপস্থিত ছিলেন।
এর পরদিন বৃহস্পতিবার সকাল ১০টায় ঢাকায় নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স ট্রেসি অ্যান জ্যাকবসন প্রাতরাশ বৈঠক করেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সঙ্গে। বৈঠকটি মির্জা ফখরুলের গুলশানের বাসভবনে হয়।
মির্জা ফখরুল ছাড়াও সেখানে উপস্থিত ছিলেন দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ও চেয়ারপারসন ফরেন অ্যাফেয়ার্স অ্যাডভাইজরি কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, সাংগঠনিক সম্পাদক ও চেয়ারপারসনের পররাষ্ট্রনীতিবিষয়ক বিশেষ সহযোগী উপদেষ্টা কমিটির সদস্য শামা ওবায়েদ। প্রাতরাশ বৈঠকে যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের দুজন রাজনৈতিক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ছিলেন। বৈঠক সম্পর্কে কেউই প্রকাশ্যে মুখ খোলেননি।
বিএনপিদলীয় রাজনৈতিক সূত্র জানিয়েছে, বিএনপি নির্বাচন, বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং সরকারের বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলেছে। বিএনপি দ্রুত নির্বাচন চায়। দলটি সরকারের নিরপেক্ষতা নিয়ে কথা বলেছে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, যত তাড়াতাড়ি গণতান্ত্রিক পরিবেশে ফিরে যাওয়া যায়, তত তাড়াতাড়ি দেশের অস্থিরতা কেটে যাবে। অর্থনৈতিক স্থবিরতা, বাজার-সরবরাহ পরিস্থিতি সব কিছু স্বাভাবিক হবে। তিনি বলেন, স্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিবেশ ছাড়া বিনিয়োগ বাড়বে না। সার্বিক দিক বিবেচনা করে আমরা আগামী ৫ আগস্ট জাতীয় নির্বাচনের ভোটগ্রহণের প্রস্তাব রেখেছি। সরকার আন্তরিক হলে ঐতিহাসিক এই দিনটিতেই নির্বাচন করা সম্ভব। তিনি আরও বলেন, আমরা চাই বৈষম্যহীন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। এখানে আইনের অধিকার ও মানবাধিকার সমুন্নত থাকবে। মানুষের হারানো গণতান্ত্রিক অধিকার আমরা পুনরুদ্ধার করব।
নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেছেন, ভোট করার ইচ্ছা থাকলে এ বছরেই নির্বাচন হতে পারে। কেউ যদি বলে কীভাবে সম্ভব? আমি বলব, ভালোভাবে একটা সুন্দর ভোট হতে পারে। যদি করতে চায়, যদি সেই তাগিদ থাকে, নিষ্ঠা থাকে। সর্বোপরি যোগ্যতা থাকতে হবে। ভোট করার জন্য ইচ্ছাশক্তি প্রয়োজন। গতকাল সন্ধ্যায় বাংলাদেশ প্রতিদিনের সঙ্গে আলাপকালে তিনি এসব কথা বলেন।
কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, বাংলাদেশে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের কয়েক দিনের মাথায় এই ধারাবাহিক সংলাপ খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সিরিজ বৈঠকের মধ্য দিয়ে এটা স্পষ্ট হলো যে, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের আগামী নির্বাচন নিয়ে আগ্রহী। বিশেষ করে আগামী নির্বাচন নিয়ে রাজনীতির মাঠে উত্তাপ শুরুর ঠিক পূর্বমুহূর্তে এই সিরিজ বৈঠক অর্থবহ।
ঢাকায় মার্কিন দূতাবাস রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা শুরুর বিষয় নিশ্চিত করে দেওয়া এক মিডিয়া নোটে বলেছে, ‘ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স অ্যাম্বাসাডর ট্রেসি অ্যান জ্যাকবসন রাজনৈতিক দলগুলোর পরিকল্পনা এবং অবস্থানগুলোকে আরও ভালোভাবে বুঝতে দলীয় নেতানেত্রীদের সঙ্গে নিয়মিত বৈঠকের আয়োজন করছেন, যা মিশনের চলমান কূটনৈতিক সম্পৃক্ততার অংশ হিসেবে অনুষ্ঠিত হচ্ছে।’
এর আগে ২০ জানুয়ারি রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন মার্কিন সিডিএ ট্রেসি অ্যান জ্যাকবসন। ওই বৈঠকে তিনি বলেন, ‘আমরা জাতি হিসেবে আপনার সরকারকে বিভিন্ন বিষয়ে সমর্থন দিতে প্রস্তুত রয়েছি।’ বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা বাংলাদেশের চলমান সংস্কার কার্যক্রম, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্রের ওপর রাজনৈতিক ঐকমত্য গঠনের প্রচেষ্টা এবং আগামী সাধারণ নির্বাচনের পরিকল্পনা সম্পর্কে আলোচনা করেন। জুলাই ঘোষণাপত্রের বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, তিনি আশা করছেন রাজনৈতিক দলগুলো ফেব্রুয়ারির শুরুতে এ বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছাবে।
এদিকে ঢাকায় সম্প্রতি বিএনপির নেতৃত্বের সঙ্গে বৈঠক হয়েছে চীন ও সিঙ্গাপুরের কূটনীতিকদের। এ সময়ও যত দ্রুত সম্ভব জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয় নিয়ে তাদের আলাপ হয়েছে। এ ছাড়া কয়েক দিন আগে বাংলাদেশের নির্বাচন ইস্যুতে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র তাদের অবস্থান স্পষ্ট করেছে। তারা প্রত্যাশা করছে, যত দ্রুত সম্ভব বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচন আয়োজন করা হবে। এর মধ্য দিয়ে শুধু দেশের রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকেই নয়, বিশ্বের প্রভাবশালী রাষ্ট্রগুলোর পক্ষ থেকেও বাংলাদেশে দ্রুত জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের বার্তা উঠে এসেছে।
কূটনৈতিক সূত্র বলছে, ড. ইউনূসের সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বেশিরভাগ দেশই সরকারের সংস্কারপদ্ধতির ওপর জোর সমর্থন দিচ্ছে। হাসিনা সরকারের দুর্নীতির বিষয়ে সরকারকে সমর্থন করে। তবে আন্তর্জাতিক মহল শুরু থেকেই অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে সংস্কারের পাশাপাশি নির্বাচনের কথা বলে আসছে। সংস্কার ইস্যুতে সরকারের সময় নিয়ে কোনো মন্তব্য করেননি বিদেশিরা। প্রয়োজনীয় সময়ের পক্ষেই ছিল তাদের অবস্থান। কিন্তু দুই মাস ধরেই সংস্কারের পাশাপাশি দ্রুত নির্বাচনের বিষয়ে কূটনৈতিক চ্যানেলে আলাপ-আলোচনা জোরালো হচ্ছে।
এদিকে সম্প্রতি বেলজিয়ামভিত্তিক বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ (আইসিজি) অন্তর্বর্তী সরকারের গত পাঁচ মাসের কর্মকাণ্ড তুলে ধরেছে। গত বৃহস্পতিবার প্রকাশিত প্রতিবেদনটিতে আইসিজি বলছে, ড. ইউনূস নেতৃত্বাধীন সরকারের মধুচন্দ্রিমা শেষ। এখন চাপ বাড়ছে অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর। শুধু প্রতিশ্রুত সংস্কার নয়, শাসনব্যবস্থার উন্নতির জন্যও সরকারের ওপর জনগণের চাপ বেড়েছে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, এখন অন্যতম বড় ইস্যুটি হলো জাতীয় নির্বাচনের তফসিল। ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের তারিখ ঘোষণার জন্য বিএনপির দিক থেকে চাপ ছিল। তবে ড. ইউনূস জানিয়েছেন, ২০২৫ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০২৬ সালের জুনের মধ্যে নির্বাচন হবে। নির্বাচন যতই দূরে থাকুক তা ইতিমধ্যে বিএনপি, অন্যান্য রাজনৈতিক দল (যেমন জামায়াতে ইসলামী) এবং ছাত্রনেতাদের মধ্যে একটা আলোড়ন তুলেছে। আইসিজি বলছে, আওয়ামী লীগের অনুপস্থিতিতে বিএনপি এখন দেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক শক্তিতে পরিণত হয়েছে। দলটিকে অপেক্ষমাণ সরকার হিসেবে দেখা হচ্ছে।
দল গঠনে সক্রিয় বৈষম্যবিরোধীরা
ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝিতে নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করতে বেশ সক্রিয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটি। সংগঠনের নেতারা চাচ্ছেন ১৫ ফেব্রুয়ারির মধ্যে নতুন দলের নাম ও আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা করতে।
জানা গেছে, দলের নেতৃত্বে কারা আসবেন সেটিতে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। দল গঠন প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত একজন সমন্বয়ক বলেন, দলের নাম চূড়ান্তকরণ, গঠনতন্ত্র প্রণয়নসহ বেশ কিছু কাজ চলছে। দল গঠনের বিষয়ে অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের মতামত নেওয়া হচ্ছে। প্রথমে আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হবে। পরে কাউন্সিলের মাধ্যমে পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা করা হবে।
নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করলে নাহিদ ইসলাম অন্তর্বর্তী সরকারের তথ্য উপদেষ্টার পদ থেকে পদত্যাগ করে দলের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে যেতে পারেন বলে গুঞ্জন আছে। অবশ্য এ বিষয়ে এখনো সিদ্ধান্ত হয়নি বলে জানিয়েছেন তিনি।
গত বৃহস্পতিবার নাহিদ ইসলাম বলেন, ‘রাজনৈতিক দল গঠন ও পদত্যাগের ব্যাপারে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি। তবে সরকারে থেকে কোনো রাজনৈতিক দলে থাকব না।’
গত বছরের ১৪ সেপ্টেম্বর বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারীকে আহ্বায়ক এবং আখতার হোসেনকে সদস্যসচিব করে জাতীয় নাগরিক কমিটি গঠন করা হয়। তখন থেকেই ছাত্রদের নতুন দল গঠন করার বিষয়ে নানা আলাপ-আলোচনা শুরু হয়। এখন এটিকে দলীয় কাঠামোতে রূপান্তর করার চেষ্টা চলছে।
ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, জুলাই আন্দোলনে নাহিদ ইসলামের জনপ্রিয়তার বিষয়টি মাথায় রেখে তাঁকে দলের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দেওয়ার চিন্তা-ভাবনা করা হচ্ছে। তবে সেটি আহ্বায়ক কমিটিতে নাকি কাউন্সিলের মাধ্যমে পূর্ণাঙ্গ কমিটি হলে, তা এখনো নিশ্চিত নয়।
সম্প্রতি জাতীয় নাগরিক কমিটির একটি বৈঠকে বেশির ভাগ সদস্য মতামত দিয়েছেন যে অন্তর্বর্তী সরকারে থাকা এক বা একাধিক ছাত্র উপদেষ্টার পদত্যাগ করে নতুন দলের নেতৃত্বে সম্পৃক্ত হওয়া উচিত। তবে সরকারের ভেতরে প্রভাব ধরে রাখতে উপদেষ্টাদের এখনই পদত্যাগের পক্ষে নয় কেউ কেউ।
Posted ২:১৬ অপরাহ্ণ | শনিবার, ০১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta