
কক্সবাংলা ডটকম(১ অক্টোবর) :: বর্ষা বিদায় নিলেও লঘুচাপের কারণে ঝরছে ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি। এমন বর্ষণে বাড়ে ইলিশের আনাগোনা। তবে ভরা এই মৌসুমেও সাধারণ মানুষের পাতে উঠছে না স্বাদের ইলিশ। একদিকে কাঙ্ক্ষিত উৎপাদনে ধাক্কা, অন্যদিকে বাজারে দাম বাড়ার কারণে রুপালি ইলিশ এবার অনেকের কাছে ‘দুর্লভ’!
প্রজনন মৌসুমে ইলিশ ধরা বন্ধ, জেলেদের বিকল্প কর্মসংস্থান বা সহায়তাসহ নানা উদ্যোগের কারণে কয়েক বছর দেশে টানা বেড়েছিল ইলিশ উৎপাদন। তবে এবার মৎস্য অধিদপ্তরের হিসাবেই দেখা গেছে, গত মৌসুম অর্থাৎ ২০২৩-২৪ অর্থবছরে আগের বছরের চেয়ে অন্তত ৭ শতাংশ উৎপাদন কম হয়েছে।
এই জুলাই-আগস্টে ভরা মৌসুমে আহরিত ইলিশের পরিমাণ ছিল মাত্র ২৯ হাজর ৫১৯ টন। গত বছর একই সময়ে ধরা পড়েছিল ৪০ হাজার ২৯১ টন। অর্থাৎ দুই মাসেই গত বছরের চেয়ে ১০ হাজার ৭৭১ টন উৎপাদন কম। এক দশক ধরে বাড়বাড়ন্ত ইলিশ আহরণ এবার দিচ্ছে পতনের ইঙ্গিত।
ইলিশ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট– দুই কারণই উৎপাদন কমার পেছনে ভূমিকা রাখছে। বঙ্গোপসাগরের পানির তাপমাত্রা বাড়ার ফলে ইলিশের প্রজনন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। নদীর প্রবাহ কমে যাওয়ায় ইলিশের বিচরণও হয়ে পড়েছে সীমিত।
মেঘনার মোহনায় ডুবোচর বেড়ে যাওয়া, নদী ও উপকূলীয় দূষণ এবং অতিরিক্ত আহরণও ইলিশ বিপর্যয়ের কারণ। সব সংকট কাটিয়ে শিগগির যদি নদীকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা না যায়, তবে ইলিশ বাংলাদেশের জলসীমা ছেড়ে চলে যেতে পারে ভিন্ন পথে।
এ পরিস্থিতিতে আগামী ৩ অক্টোবর মধ্যরাত থেকে শুরু হচ্ছে ২২ দিনের মা ইলিশ রক্ষায় নিষেধাজ্ঞা, যা চলবে ২৫ অক্টোবর পর্যন্ত। এর পর নভেম্বর থেকে শুরু হবে আট মাসের জাটকা আহরণে নিষেধাজ্ঞা।
মৎস্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, প্রতিবছর জুলাই, আগস্ট ও সেপ্টেম্বর ভরা মৌসুম ধরা হয়। বছরে মোট আহরিত ইলিশের দুই-তৃতীয়াংশই এক সময় দক্ষিণাঞ্চলের নদনদীতে পাওয়া যেত। এ বছর জুলাই-আগস্টে ভরা মৌসুমে আহরিত ইলিশের পরিমাণ ছিল মাত্র ২৯,৫১৯.৪৬ টন।
গত বছর একই সময়ে আহরণ হয়েছিল ৪০,২৯১.২৪ টন। অর্থাৎ মাত্র দুই মাসেই গত বছরের চেয়ে ১০,৭৭১.৭৮ টন কম। সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে দেশজুড়ে ইলিশ উৎপাদন কমে পাঁচ লাখ ২৯ হাজার টনে দাঁড়িয়েছে। আগের বছর ২০২২-২৩ সালে ছিল পাঁচ লাখ ৭১ হাজার টন। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের হিসাব এখনও হয়নি, তবে ধারণা করা হচ্ছে, আরও কম হবে। এর আগে প্রতিবার ইলিশ উৎপাদন সামান্য হলেও বাড়ত। ২০১৮-১৯ সালে পাঁচ লাখ ৩২ হাজার, ২০১৯-২০ সালে পাঁচ লাখ ৫০ হাজার, ২০২০-২১ সালে পাঁচ লাখ ৬৫ হাজার, ২০২১-২২ সালে পাঁচ লাখ ৬৬ হাজার টন ইলিশ আহরিত হয়েছিল।
মৎস্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী- জুলাই, আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাসকে ইলিশের ভরা মৌসুম ধরা হয়। সে অনুযায়ী গতকাল শেষ হয়েছে ইলিশের মৌসুম।
এ সময় বাজারে পর্যাপ্ত ইলিশ পাওয়া গেলেও দাম কমছে না স্বাদের এই মাছের। উল্টো লাগামহীনভাবে বাড়ছে।
গত দুই সপ্তাহের ব্যবধানে কেজিতে অন্তত ২০০ থেকে ৩০০ টাকা বেড়েছে।
ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্য অনুযায়ী, গত এক বছরে ইলিশের দাম বেড়েছে প্রায় ২০ শতাংশ।
যা বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের (বিটিটিসি) এক প্রতিবেদনে ওঠে এসেছে।
বিটিটিসি বলছে, গত জুনে প্রতি কেজি ইলিশের দাম ছিল ৬০০ থেকে ২২০০ টাকা।
জুলাইয়ে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৯০০ থেকে ২ হাজার টাকায়। আগস্টে সরবরাহ বাড়ার ফলে দাম কিছুটা কমে হয় ৮০০ থেকে ২ হাজার টাকা। তবে সেপ্টেম্বরে তা বেড়ে ৯০০ থেকে ২২০০ টাকায় উন্নীত হয়।
বাজার ঘুরে দেখা যায়, ৭০০ থেকে ৮০০ গ্রামের প্রতি কেজি ইলিশ বিক্রি হচ্ছে ১৮০০ থেকে ১৯০০ টাকায়। যা কয়েক দিন আগেও বিক্রি হয়েছে ১৬০০ থেকে ১৭০০ টাকায়।
একইভাবে ৯০০ গ্রামের প্রতি কেজি ইলিশ বিক্রি হচ্ছে ২ হাজার টাকা, সোয়া কেজি ওজনের ইলিশ ২৪০০ থেকে ২৫০০ টাকা ও ১ কেজি ৫০০ গ্রাম ওজনের ইলিশ ৩ হাজার থেকে ৩২০০ টাকা।
জানতে চাইলে কারওয়ান বাজারের ইলিশ ব্যবসায়ী মো. রফিক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ইলিশের দাম এমনিতেই বেশি। এর মধ্যে পূজার চাহিদা রয়েছে। কিন্তু সরবরাহ বাড়েনি।
এ সুযোগে বরিশাল ও চাঁদপুরের আড়তদাররা দাম বাড়িয়ে দেওয়ায় বাজারে প্রভাব পড়েছে।
ইলিশ ব্যবসায়ীদের দাবি অনুযায়ী, নদীতে জাল ফেলে কাক্সিক্ষত ইলিশ পাচ্ছে না জেলেরা। সব মিলিয়ে বাজার চড়া। তবে এসব দাবিকে অযৌক্তিক বলে মনে করছেন বাজার সংশ্লিষ্টরা।
কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) ভাইস প্রেসিডেন্ট এস এম নাজের হোসাইন বলেন, একটু রোদ-বৃষ্টি হলে রিকশাচালকরা যেমন নানা অজুহাতে ভাড়া বাড়ায়, তেমনি সরকারি তদারকি না থাকায় মাছ ব্যবসায়ীরাও দাম বাড়াতে সরবরাহ ঘাটতির অজুহাত দাঁড় করানোর চেষ্টা করছে।
এদিকে ইলিশের দাম বাড়ার জন্য ১১টি কারণ চিহ্নিত করেছে ট্যারিফ কমিশন।
তারা বলছে, চাহিদা ও সরবরাহের ভারসাম্যহীনতা, মজুত ও সিন্ডিকেট, জ্বালানি তেল ও পরিবহন খরচ বৃদ্ধি, মাছ ধরার খরচ বৃদ্ধি, নদীর নাব্য সংকট ও পরিবেশগত সমস্যা, অবৈধ জালের ব্যবহার, দাদন, বিকল্প কর্মসংস্থান, নিষিদ্ধ সময়ে মাছ ধরা, মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য ও রপ্তানির চাপে ইলিশের দাম হুহু করে বেড়েছে।
মৎস্য অধিদপ্তর জানায়, নদী খনন ও নাব্য সংকট নিরসন ছাড়া ইলিশ সংকটের স্থায়ী সমাধান সম্ভব নয়। এ জন্য নিতে হবে বড় প্রকল্প। নদী ও মোহনা খনন, প্রজনন ক্ষেত্র রক্ষা, অবৈধ ট্রলিং প্রতিরোধ এবং জাটকা সুরক্ষা ছাড়া ইলিশ উৎপাদন বাড়ানো কঠিন।
মৎস্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ড. মো. আবদুর রউফ বলেন, নাব্য সংকটের পাশাপাশি ইলিশ প্রজনন ক্ষেত্রগুলোও ধ্বংস হয়েছে। সাগর সুরক্ষায় মৎস্য অধিদপ্তরের কার্যক্রম নেই। এ সুযোগে অবৈধ ট্রলিং ও জাটকা নিধনের কারণে উৎপাদন কমছে।
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতার বলেছেন, অবৈধ জাল ও জাটকা নিধন পুরোপুরি বন্ধ না হওয়াসহ জলবায়ু পরিবর্তন, নদীর নাব্য হ্রাস ও অভয়াশ্রমসংলগ্ন এলাকায় উন্নয়ন প্রকল্পের কারণে ইলিশ উৎপাদন কমেছে। জাটকা সুরক্ষা ও প্রজনন মৌসুমে নির্বিঘ্ন পরিবেশ নিশ্চিত করতে অভিযান পরিচালনাসহ কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। কারেন্ট জালসহ অবৈধ জালের বিরুদ্ধে অভিযান চলছে। ইলিশের দাম নিয়ন্ত্রণে নদী থেকে বাজারে আসা পর্যন্ত হাতবদল কমানোর পরিকল্পনাও হাতে নেওয়া হয়েছে।

Posted ৫:২৬ অপরাহ্ণ | বুধবার, ০১ অক্টোবর ২০২৫
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta