কক্সবাংলা রিপোর্ট(১৪ জানুয়ারি) :: হত্যা-নির্যাতনের মুখে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের সেবায় কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফে এনজিও ব্যুরোর অনুমোদন নিয়ে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ১৯২টি কর্মসূচিতে কাজ করছে ৯২টি এনজিও।আর অসহায় রোহিঙ্গাদের ঠকিয়ে রমরমা বাণিজ্য করছে দেশী-বিদেশী এনজিওগুলোও।
পাশাপশি এনজিওগুলোর সরকারবিরোধী প্রচারণা, জামায়াত-শিবিরের সঙ্গে সম্পৃক্ততা, সরকারি নির্দেশনা অমান্য করে দ্বিতীয় পর্যায়ের স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া, রোহিঙ্গা শিশুদের বাংলা ভাষায় পাঠদানসহ নানা বির্তকিত কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়া এবং ত্রাণ বিতরণে অনিয়ম করায় তাদের বিরুদ্ধে সুপারিশ গেছে এনজিও বিষয়ক ব্যুরোতে।
কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মো. আলী হোসেন গত ৪ জানুয়ারি রোহিঙ্গাদের মধ্যে এনজিওগুলোর ত্রাণ বিতরণে অনিয়ম নিয়ে এনজিও বিষয়ক ব্যুরোর মহাপরিচালক বরাবর এক প্রতিবেদন পাঠিয়েছেন।
তাতে বেশ কয়েকটি এনজিওর নাম উল্লেখ করে তিনি বলেছেন, এনজিওগুলো কেবল আর্থিকভাবেই অনিয়ম করছে না, তারা এখতিয়ারবহির্ভূত কার্যক্রমও পরিচালনা করছে। দোষী এনজিওগুলোর বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ করেছেন তিনি।
মন্ত্রিপরিষদসচিব, প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব এবং চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনারের কাছেও প্রতিবেদনটি পাঠিয়েছেন ডিসি।
প্রতিবেদনে সেভ দ্য চিলড্রেন ইন্টারন্যাশনাল, অগ্রযাত্রা বাংলাদেশ, কাতার চ্যারিটি, আল্লামা ফজলুল্লাহ ফাউন্ডেশন, সোশ্যাল এজেন্সি ফর ওয়েলফেয়ার অ্যান্ড অ্যাডভান্সমেন্ট ইন বাংলাদেশ (ছওয়াব), প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ, নেটওয়ার্ক ফর ইউনিভার্সেল সার্ভিসেস অ্যান্ড রুরাল অ্যাডভান্সমেন্ট (নুসরা), দুস্থ স্বাস্থ্যকেন্দ্র ও ইউনাইটেড সোশ্যাল অ্যাডভান্সমেন্টের (ঊষা) বিরুদ্ধে ত্রাণ বিতরণে অনিয়ম পাওয়া গেছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
তবে নুসরা, দুস্থ স্বাস্থ্যকেন্দ্র ও ঊষা সম্পর্কে বলা হয়েছে, এরা এনজিওবিষয়ক ব্যুরো থেকে কোনো ধরনের ত্রাণ সরবরাহের বরাদ্দপত্র পাচ্ছে বা কোনো ধরনের ত্রাণ সরবরাহ করছে সে বিষয়ে জেলা প্রশাসনকে কিছুই জানাচ্ছে না।
এর মধ্যে যুক্তরাজ্যভিত্তিক বেসরকারি সংস্থা (এনজিও) সেভ দ্য চিলড্রেন ইন্টারন্যাশনালের বিরুদ্ধে রোহিঙ্গাদের ত্রাণ বিতরনে গুরুতর অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয় খোলাবাজার থেকে ৬৫ টাকা কেজি দরে ডাল কিনে প্যাকেটে ভরে রোহিঙ্গাদের দিয়ে প্রতি কেজি ডালের প্যাকেজিং খরচ দেখানো হচ্ছে ৯৩ টাকা! শুধু ডাল প্যাকেটজাত করে রোহিঙ্গাদের মধ্যে ত্রাণ হিসেবে বিতরণ করে বাড়তি খরচ দেখিয়ে ১৭ লাখ টাকা পকেটে ভরেছে যুক্তরাজ্যভিত্তিক বেসরকারি সংস্থা (এনজিও) সেভ দ্য চিলড্রেন ইন্টারন্যাশনাল।
প্রতি রোহিঙ্গা পরিবারকে ২০০ টাকা দামের দুটি করে গামছা দেওয়ার কথা বাংলাদেশি এনজিও অগ্রযাত্রা বাংলাদেশের। ৮০ টাকায় একেকটি গামছা কিনে দুই টুকরো করে দুই প্যাকেটে ভরে দুটি গামছা হিসেবে বিতরণ করছে তারা।এছাড়া আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের এভাবে ঠকিয়ে রমরমা বাণিজ্য করছে অন্য এনজিওগুলোও।
এনজিওবিষয়ক ব্যুরোর ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালক মো. শাহাদাৎ হোসাইন রবিবার বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের মাঝে ত্রাণ বিতরণে ৯টি এনজিওর বিরুদ্ধে অনিয়ম-দুর্নীতির সরেজমিন তদন্ত প্রতিবেদন পেয়েছি। অনিয়মের সঙ্গে জড়িত সব এনজিওর কাছেই আমরা ব্যাখ্যা চেয়ে চিঠি পাঠিয়েছি। শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার আগে সবাইকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেওয়ার অংশ হিসেবে আমরা তাদের কাছে ব্যাখ্যা চেয়েছি। ব্যাখ্যা সন্তোষজনক না হলে তখন আমরা ব্যবস্থা নেব।’
৯টি এনজিওর অনিয়মের প্রসঙ্গ তুলে কক্সবাজারের ডিসি মো. আলী হোসেন বলেছেন, বলপ্রয়োগে বাস্তুচ্যুত হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া মিয়ানমারের নাগরিকদের জন্য ৯০টি এনজিও জেলা প্রশাসকের তত্ত্বাবধানে কার্যক্রম
চালিয়ে যাচ্ছে। এর মধ্যে কিছু এনজিওর কার্যাবলিতে অনিয়ম পরিলক্ষিত হচ্ছে, যা অনাকাঙ্ক্ষিত।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সেভ দ্য চিলড্রেন ইন্টারন্যাশনালের ১৩৩ টাকা দরের ডাল বিতরণ করার কথা।
কিন্তু সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, তারা ৮৫ টাকা কেজি দরের তীর মার্কা ব্র্যান্ডের কিছু ডাল কিনেছে। আর বাকি ডাল কিনেছে খোলাবাজার থেকে ৬৫ টাকা কেজি দরে। তারা এই ডালের প্যাকেজিং খরচ ধরেছে ৯২ টাকা ৯৬ পয়সা।
জেলা প্রশাসকের সরেজমিন তদন্ত করতে যাওয়া দলের প্রতিবেদন অনুযায়ী, এই ডাল প্যাকেজিংয়ে খরচ হওয়ার কথা বড়জোর ১৬ টাকা।
তদন্তদল হিসাব করে দেখেছে, এনজিওটি শুধু ডাল প্যাকেজিংয়ে বেশি খরচ দেখিয়ে ১৭ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। এ ছাড়া এনজিওটি জেলা প্রশাসনের অনুমতি ছাড়াই চাইল্ড রিক্রিয়েশন সেন্টার নির্মাণ করেছে, যা অনাকাঙ্ক্ষিত ও অনভিপ্রেত বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
এনজিওবিষয়ক ব্যুরোর ওয়েবসাইটে দেখা যায়, সেভ দ্য চিলড্রেন ইন্টারন্যাশনাল যুক্তরাজ্যভিত্তিক একটি এনজিও। সেখানে একটি টেলিফোন নম্বর রয়েছে। বিভিন্ন সময়ে ওই টেলিফোন নম্বরে কল করা হলেও কেউ তা রিসিভ করেনি। আর সেভ দ্য চিলড্রেন ইন্টারন্যাশনাল, বাংলাদেশের ওয়েবসাইটে গিয়ে যোগাযোগের জন্য আরেকটি টেলিফোন নম্বর পাওয়া যায়। সেটি বিচ্ছিন্ন রয়েছে।
অগ্রযাত্রা বাংলাদেশের ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম সম্পর্কে তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এনজিওটির ১৪০ টাকা কেজি দরের পাঁচ কেজি করে ডাল দেওয়ার কথা। কিন্তু তারা ৭০ টাকা কেজি দরের তিন কেজি করে ডাল দিচ্ছে। এ ছাড়া ২০০ টাকা দামের দুটি গামছা দেওয়ার কথা থাকলেও ৮০ টাকা দামের একটি গামছা ছিঁড়ে দুই টুকরো করে দুই প্যাকেটে দেওয়া হয়েছে। ৩২০ টাকা দামের একটি ডাস্টপ্যান, ব্রাশ ও ডাস্টবিন দেওয়ার কথা থাকলেও ৪৫ টাকা মূল্যের ময়লার ছোট ঝুড়ি ও বেলচা দেওয়া হয়েছে। অন্য দ্রব্যসামগ্রীর মানও অনুমোদিত দাম অনুসারে পাওয়া যায়নি।
চট্টগ্রামের জামাল খান রোডের ঠিকানায় নিবন্ধিত এনজিওটির ফোন নম্বরে কল করে সংযোগ বিচ্ছিন্ন পাওয়া যায়।
প্রতিবেদন মতে, প্রতিটি ২৮ হাজার টাকা মূল্যের এক হাজার তাঁবু দেওয়ার কথা কাতার চ্যারিটির। কিন্তু দিয়েছে প্রতিটি ২৪ হাজার টাকা মূল্যের। মূল রোহিঙ্গা ক্যাম্পে পাঁচ হাজার পরিবারের জন্য ওষুধ সরবরাহব্যবস্থা স্থাপন করতে জেলা প্রশাসন থেকে নির্দেশ দেওয়া হলেও এখনো এনজিওটি তা করেনি। এ ছাড়া সংস্থাটির রান্না করা খাবার সরবরাহ করার কথা থাকলেও প্রথম কয়েক দিন দেওয়ার পর এখন শুকনো খাবার সরবরাহ করছে। এ বিষয়েও জেলা প্রশাসনকে কিছু জানায়নি এনজিওটি।
কাতারভিত্তিক এনজিওটির উল্লেখ করা টেলিফোন নম্বরে যোগাযোগের চেষ্টা করে সেটি বন্ধ পাওয়া যায়।
ছওয়াব নামের একটি এনজিওর ১১ লাখ টাকার ত্রাণ সহায়তা দেওয়ার কথা। কিন্তু জেলা প্রশাসন থেকে সরেজমিনে গিয়ে সেখানে মাত্র চার লাখ টাকার ত্রাণসামগ্রী দেখা যায়। তখন চার লাখ টাকার ত্রাণ ছাড় করেনি জেলা প্রশাসন। পরে এনজিওটি বাকি সাত লাখ টাকার ত্রাণ নিয়ে আসে।
আল্লামা ফজলুল্লাহ ফাউন্ডেশনের নামে ১৮টি বরাদ্দপত্র পায় তদন্তদল। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে এনজিওটির কার্যক্রম সম্পর্কে প্রথম দিকে জেলা প্রশাসন কার্যালয়ে তথ্য জানানো হতো। তবে কিছুদিন ধরে এনজিওটি তা আর জানাচ্ছে না।
এ ছাড়া এনজিওটি মধ্যরাতে গ্যাস সিলিন্ডারের ট্রাক নিয়ে নিয়মবহির্ভূতভাবে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ঢোকে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
চট্টগ্রামের সাতকানিয়ার একটি ঠিকানায় নিবন্ধিত এই সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগের জন্য দেওয়া টেলিফোন নম্বরটি বিচ্ছিন্ন রয়েছে।
প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের তিন হাজার টাকা দামের ডিগনিটি কিট্স দেওয়ার কথা থাকলেও জেলা প্রশাসনের তদন্তদল সরেজমিনে গিয়ে ৯০০ টাকার ডিগনিটি কিট্স পায়। এর পরিপ্রেক্ষিতে জেলা প্রশাসন থেকে ডিগনিটি কিট্স সরবরাহের ছাড়পত্র দেওয়া হয়নি বলে জানিয়েছেন কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক।
অপরদিকে রোহিঙ্গা শিবিরে কর্মরত এনজিওগুলোর ত্রাণ বিতরণে অনিয়ম সরকারবিরোধী প্রচারণা, জামায়াত-শিবিরের সঙ্গে সম্পৃক্ততা, সরকারি নির্দেশনা অমান্য করে দ্বিতীয় পর্যায়ের স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া, রোহিঙ্গা শিশুদের বাংলা ভাষায় পাঠদানসহ নানা বির্তকিত কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়া আরও সাত এনজিও’র বিতর্কিত কার্যক্রমের প্রমাণ গোয়েন্দা নজরদারিতে পাওয়ার পর তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করতে এনজিও বিষয়ক ব্যুরোতে আরও একটি সুপারিশ পাঠানো হয়। প্রতিবেদনে এসব এনজিও’র কার্যক্রমের বিষয়েও জানানো হয় ব্যুরোকে।
প্রতিবেদন সূত্রে জানা গেছে, উখিয়া উপজেলার পালংখালী ইউনিয়নের হাকিমপাড়ায় রোহিঙ্গাদের মাঝে কাজ করে এডুকেশনাল ডেভলপমেন্ট অ্যান্ড সার্ভিস (ইডিএএস) নামে একটি এনজিও। কিন্তু ওই এনজিওটি সেবার আড়ালে সরকারবিরোধী প্রচারণা এবং জামায়াত-শিবিরের প্রচারণা ও রোহিঙ্গা জঙ্গিদের সংগঠিত করার চেষ্টা চালাচ্ছে বলে তথ্য মিলেছে। পাশাপাশি সরকারি নির্দেশনা অমান্য করাসহ নানা অভিযোগে সেভ দ্য চিলড্রেন, মোয়াস (এমওএএস), এমডিএস, কোডাক (সিওডিইসি), এসআরপিবি, শেড’র কার্যক্রমের ওপরও নিষেধাজ্ঞা প্রয়োজন মনে করে এ নিয়ে সুপারিশ পাঠানো হয়েছে ব্যুরোতে।
এ ব্যাপারে কক্সবাজার জেলা প্রশাসক মো. আলী হোসেন বলেন, এনজিওগুলোর কার্যক্রমের ওপর প্রতিবেদন তৈরি করে ব্যুরোতে পাঠানো হয়েছে ৪ জানুয়ারি। প্রতিবেদনে সাতটি এনজিও’র কার্যক্রম নিষিদ্ধ করার সুপারিশ এবং ৯টি এনজিও’র ত্রাণ কার্যক্রমে ব্যাপক অনিয়মের রিপোর্ট উল্লেখ করা হয়েছে। তিরি আরও জানান,সরকারের নির্দেশের পর যেসব এনজিও অনিয়ম এবং বির্তকিত কাজে জড়াবে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
Posted ১২:৩৪ অপরাহ্ণ | সোমবার, ১৫ জানুয়ারি ২০১৮
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta