এদিকে রোহিঙ্গাদের জন্য মিয়ানমারে নিরাপদ পরিবেশ তৈরি না হওয়ায় তাদের সেখানে ফেরত পাঠানো নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন ব্রিটিশ এমপিরা। তারা মনে করেন, এখনো মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর ধর্ষণ আর যৌন সহিংসতা অব্যাহত রয়েছে। চুক্তি অনুযায়ী আগামী ২২ জানুয়ারি থেকে প্রত্যাবাসন শুরু হওয়ার কথা।
বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা (বাসস) জানায়, গত বছরের ২৩ নভেম্বর বাংলাদেশ এবং মিয়ানমারের মধ্যে স্বাক্ষরিত ফিজিকাল অ্যারেঞ্জমেন্ট চুক্তির আলোকে প্রত্যাবাসন নীতিমালা চূড়ান্ত করা হয়েছে। নীতিমালা অনুযায়ী প্রতিটি পরিবারকে একটি ইউনিট হিসেবে গণ্য করা হবে।
প্রত্যাবর্তনের জন্য বাংলাদেশে ৫টি ট্রানজিট ক্যাম্প স্থাপিত হবে এবং এই ট্রানজিট ক্যাম্প থেকে বাছাই করা রোহিঙ্গাদের প্রথমে মিয়ানমারে স্থাপিত দুটি ক্যাম্পে নেয়া হবে। সেখানে যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়ার পর উত্তীর্ণ হলে তাদের মিয়ানমারে স্থাপন করা অস্থায়ী আবাসনে আশ্রয় দেয়া হবে। মিয়ানমার জিরো লাইনে অবস্থানকারীদের পুনর্বাসনে অগ্রাধিকার দেবে।
মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ তাদের নাগরিকদের বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ বন্ধের অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেছে বলেও বাসস উল্লেখ করেছে। সংবাদ সংস্থাটি জানায়, উভয় দেশ শনাক্তকরণ ও প্রত্যাবর্তন সম্পর্কিত দুটি টেকনিক্যাল ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠনে একমত হয়েছে। ফিজিকাল অ্যারেঞ্জমেন্ট প্রত্যাবর্তন সম্পর্কিত সার্বিক রূপরেখা রয়েছে। বৈঠকে শনাক্তকরণ ‘ফর্ম’ চূড়ান্ত হয়েছে। প্রত্যাবর্তনের বিষয়ও রূপরেখায় অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
বৈঠকে বাংলাদেশের পক্ষে পররাষ্ট্র সচিব এম শহীদুল হক এবং মিয়ানমারের পক্ষে সে দেশের পার্মানেন্ট সেক্রেটারি মিং থ নেতৃত্ব দেন। বৈঠকের বিষয়ে পররাষ্ট্র সচিব মো. শহীদুল হক বলেছেন, ওই চুক্তিতে জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থার ভূমিকার বিষয়টি যুক্ত করা হয়েছে। পাশাপাশি প্রত্যাবাসনের পর রাখাইনে রোহিঙ্গাদের জীবন-জীবিকার বিষয় নিশ্চিত করার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। সামগ্রিকভাবে দুই পক্ষের আলোচনার পর একটি ভারসাম্যপূর্ণ চুক্তি হয়েছে। এখন দুই পক্ষ যদি আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করে, তবে টেকসই উপায়ে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের কাজ শুরু করা যাবে বলে আশা করা যায়।
বৈঠকের সূত্র জানায়, চুক্তি অনুযায়ী প্রত্যাবাসন যাতে দ্রুত সম্পন্ন করা যায়, তার জন্য বাংলাদেশ এবং মিয়ানমার সীমান্তের জিরো পয়েন্টে থাকা রোহিঙ্গাদের দিয়েই প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু করার ব্যাপারে উভয় দেশ সম্মত হয়েছে। এখন বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়িতে মিয়ানমারসংলগ্ন সীমান্তে সাড়ে ৯ হাজার রোহিঙ্গা অবস্থান করছেন।
বৈঠক সূত্র জানায়, বাংলাদেশের পক্ষ থেকে প্রতি সপ্তাহে ১৫ হাজার করে রোহিঙ্গাকে ফেরত পাঠানোর প্রস্তাব করা হয়। আর মিয়ানমারের পক্ষ থেকে সপ্তাহে শনি ও রবিবার ব্যতীত ১৫০০ রোহিঙ্গাকে ফেরত নেয়ার প্রস্তাব করা হয়। পরে প্রতিদিন ৩০০ থেকে ৫০০ জন করে রোহিঙ্গা ফেরত পাঠানোর ব্যাপারে একটি সিদ্ধান্ত হয়।
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে ঠাণ্ডা মাথায় এগোচ্ছে বাংলাদেশ :
পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম মঙ্গলবার বলেছেন রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের ব্যাপারে ঠাণ্ডা মাথায় এগোচ্ছে বাংলাদেশ। রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করার জন্য বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে স্বাক্ষরিত ‘ফিজিক্যাল অ্যারেঞ্জমেন্ট’ চুক্তি কার্যকরী করার জন্য মিয়ানমারের রাজধানী নেপিডোতে অনুষ্ঠিত যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপের বৈঠকের পর গতকাল বিকেলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে নিজ কার্যালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে একথা বলেন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী।
শাহরিয়ার বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনায় রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের প্রক্রিয়া সম্পন্ন করছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। রোহিঙ্গাদের ফেরাতে আমরা বরাবরই আশাবাদী, যদিও বিষয়টা জটিল ও ঐতিহাসিক এবং সমস্যার ব্যাপ্তি অনেক বড়। গত সোমবার ৯ লাখ ৯৯ হাজার রোহিঙ্গার বায়োমেট্রিক নিবন্ধন হয়েছে বলে তিনি জানান।
পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলেন, রোহিঙ্গাদের দ্রুততম সময়ে নিজ নিজ গ্রামে পুনর্বাসন করা হবে। অবশ্যই তা হতে হবে স্বেচ্ছায়। তাদের প্রত্যাবাসন হবে নিরাপদ ও সম্মানজনক। যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠনের সময় বাংলাদেশের উদ্যোগে জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআরর সম্পৃক্ততা আনুষ্ঠানিকভাবে যুক্ত করা হয়েছে জানিয়ে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলেন, এটা আগে ছিল না। ধারাবাহিকভাবে যখনই সুযোগ থাকবে তখনই আমরা এই প্রক্রিয়াকে আরো দৃঢ় করার চেষ্টা করব।
খুব শিগগিরই রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু হবে উল্লেখ করে প্রতিমন্ত্রী বলেন, আমরা আশা করি, ফেব্রুয়ারি মাসের শুরুর দিকেই প্রত্যাবাসন শুরু হবে। তিনি বলেন, বানের পানির মতো ১৯ দিনে এসেছে চার লাখ রোহিঙ্গা। কিন্তু তাদের একইভাবে ফেরত যাওয়ার সুযোগ নেই। মানবিক বিচার-বিশ্লেষণ থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয়ার ব্যাপারে। একটি সঠিক প্রক্রিয়া অনুসরণ করে তাদের স্বদেশে ফেরত যেতে হবে।
যাচাইবাছাই বড় চ্যালেঞ্জ কিনা প্রশ্নের উত্তরে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলেন, আমরা সেটা মনে করি না। কারণ, কাজ অনেক দূর এগিয়ে রেখেছি। আমরা তাদের বায়োমেট্রিক আইডি দিয়েছিলাম যেন তারা অন্য জেলার মানুষের সঙ্গে মিশে যেতে না পারে এবং বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির সহায়তা পেতে পারেন। আমরা তাদের নিরাপত্তার বিষয়ে বেশি চিন্তিত ছিলাম।
শাহরিয়ার আলম বলেন, বাড়তি যে বিষয়টি আছে তা নিয়ে অনেকের শঙ্কা আছে। প্রায় ৪০ হাজার শিশু আছে পিতা-মাতা ছাড়া। সে বিষয়েও বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। সবাইকে আমলে নেয়া হয়েছে। যারা কোনো কাগজ দেখাতে পারবেন না তাদের বলা হয়েছে গ্রামের নামটি বললে তাদের স্থানীয়ভাবে বেছে নেয়া হবে।