
কক্সবাংলা ডটকম(১২ সেপ্টেম্বর) :: রোহিঙ্গা সঙ্কটকে ঘিরে মিয়ানমার ও বাংলাদেশের উদ্বেগকে ভারত একসাথে কীভাবে মোকাবিলা করবে, তা দিল্লির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে রীতিমতো সমস্যায় ফেলে দিয়েছে।
পর্যবেক্ষকরা বলছেন, বাংলাদেশ ও মিয়ানমার ও দুটি দেশই ভারতের বন্ধুপ্রতিম প্রতিবেশী – কিন্তু সেই দুই সম্পর্কের মধ্যে ভারসাম্য রেখে কীভাবে রোহিঙ্গা সঙ্কটের সমাধান বের করা যায় দিল্লি এখন তারই সন্ধানে ব্যস্ত। রাখাইন স্টেট থেকে যেভাবে শরণার্থীদের ঢল নেমেছে, মাত্র দুদিন আগে প্রথম তাতে উদ্বেগ ব্যক্ত করলেও রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন নিয়ে ভারত এখনও একটি শব্দও খরচ করেনি।
আর তাই নিউইয়র্কে আগামী সপ্তাহে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনেই যাতে রোহিঙ্গা সংকটের একটা গ্রহণযোগ্য সমাধান বেরোয়, তার জন্য পর্দার অন্তরালে জোরালো কূটনৈতিক তৎপরতা শুরু করেছে ভারত।
এই প্রচেষ্টার প্রধান লক্ষ্য হলো- মিয়ানমারের বিরুদ্ধে কোনও আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার প্রস্তাব এলে তা ঠেকানো । পাশাপাশি রোহিঙ্গা শরণার্থীদের স্রোত সামলাতে বাংলাদেশকে সাহায্য করা।
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ পর্যায়ের একটি সূত্র জানিয়েছে, রোহিঙ্গা সংকট ভারতকে এক নজিরবিহীন ‘ডিপ্লোম্যাটিক ডিলেমা’র (কূটনৈতিক দ্বিধা) মধ্যে ফেলে দিয়েছে ।কারণ,এই সংকটকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার প্রায় মুখোমুখি অবস্থানে চলে এসেছে। অথচ এই দুই প্রতিবেশীর সঙ্গেই ভারতের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক খুব ভাল।
এই পরিস্থিতিতে দুই দেশের সঙ্গেই সুসম্পর্ক বজায় রেখে ভারত কিভাবে রোহিঙ্গা প্রশ্নে নিজেদের ভূমিকা রাখতে পারে, এখন তা চূড়ান্ত করার চেষ্টা চলছে। এ ক্ষেত্রে ভারতের লক্ষ্য হলো- এমন একটা ফর্মুলা প্রস্তাব করা, যা মিয়ানমার ও বাংলাদেশ উভয় দেশেরই স্বার্থরক্ষা করে এবং দু’পক্ষের কাছেই গ্রহণযোগ্য হয়।
ভারতের কূটনৈতিক মহলের এই প্রচেষ্টার নানা দিক সম্বন্ধে যে আভাস পাওয়া যাচ্ছে, তা এরকম:
ক. ভারতের অনুমান, ১৯ সেপ্টেম্বর থেকে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের (ইউএনজিএ) অধিবেশনে যে বিতর্ক শুরু হবে, সেখানে ওআইসি (অর্গানাইজেশন অব ইসলামিক কান্ট্রিজ) ভুক্ত বিভিন্ন দেশ মিয়ানমারে রোহিঙ্গা নির্যাতনের বিরুদ্ধে সরব হতে পারে। এমনকি মিয়ানমারের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপেরও প্রস্তাব আসতে পারে। সেক্ষেত্রে ভারত সর্বশক্তি দিয়ে সেই প্রস্তাবের বিরোধিতা করবে।
সে ধরনের কোনও প্রস্তাব যদি নিরাপত্তা পরিষদে ওঠে,আর চীন যে তাতে ভেটো দেবে এটাও ভারতের একরকম জানাই। কিন্তু ভারত মিয়ানমারকে একটা স্পষ্ট বার্তা দিতে চায় যে, রোহিঙ্গা প্রশ্নে তারা বরাবরের মতোই পুরোপুরি মিয়ানমারের পাশে আছে। মিয়ানমারের বিরুদ্ধে ওআইসি দেশগুলো কতটা কঠোর অবস্থান নিতে চায়, সেটা আঁচ করতে ভারতের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী এম জে আকবর ইতোমধ্যেই তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলেছেন।
খ. রোহিঙ্গা সংকটকে ঘিরে নরেন্দ্র মোদির নীরবতায় বাংলাদেশে যে তীব্র ক্ষোভ ও হতাশা তৈরি হয়েছে, সে বিষয়েও ভারত অবহিত। দিল্লিতে নিযুক্ত বাংলাদেশি রাষ্ট্রদূত সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলী দু’দিন আগেই এ ব্যাপারে তাদের (বাংলাদেশের) উদ্বেগের কথা ভারতের পররাষ্ট্র সচিব এস জয়শঙ্করকে জানিয়ে দিয়েছেন। এরপরই নতুন করে একটি বিবৃতিতে রাখাইন স্টেট থেকে শরণার্থীদের ঢল নামার বিষয়ে ভারত উদ্বেগ ব্যক্ত করে। কিন্তু ওই বিবৃতিতেও রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতনের ব্যাপারে কোনও উচ্চবাচ্য করেনি ভারত।
এই পরিস্থিতিতে ভারত চাইছে, লাখ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থীকে সামলানোর বিষয়ে বাংলাদেশ যাতে সব ধরনের আন্তর্জাতিক সহযোগিতা পায়, তা নিশ্চিত করা। এই সাহায্য শুধু আর্থিক সহায়তা বা ত্রাণসামগ্রী দিয়েই নয়, পশ্চিমা বিশ্বের দেশগুলো যাতে কিছু কিছু রোহিঙ্গা শরণার্থীকে আশ্রয় দেয়, ভারত সেই দাবিও তুলতে পারে।
দিল্লিতে সাউথ ব্লকের একটি সূত্রের কথায়, ‘সিরিয়া-ইরাকের শরণার্থীদের যদি ইউরোপের সব দেশ নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে আশ্রয় দিতে পারে, এমনকি তারা কানাডা-যুক্তরাষ্ট্রেও যেতে পারেন, তাহলে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ক্ষেত্রেও তা করতে অসুবিধা কোথায়?’
গ. কিন্তু এক্ষেত্রে একটা বড় মুশকিল হলো, ভারত নিজেই ঘোষণা করেছে, এ দেশে বসবাসকারী চল্লিশ হাজারেরও বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থীকে মিয়ানমারে ফেরত পাঠাতে চায়। স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী কিরেন রিজিজু পার্লামেন্টের ভেতরে ও বাইরে জানিয়ে দিয়েছেন, এই রোহিঙ্গারা অবৈধ অভিবাসী। ফলে তাদের ভারতে থাকার কোনও অধিকার নেই।
তবে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ভারত সেই নীতি আপাতত স্থগিত রাখার কথা বিবেচনা করতে পারে। বাংলা ট্রিবিউন আভাস পেয়েছে, নিউ ইয়র্কে সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে রোহিঙ্গা ইস্যুতে আলোচনার গতিপ্রকৃতি কোন দিকে গড়ায়, তার ওপর নির্ভর করে ভারত রোহিঙ্গাদের দেশে ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়া আপাতত বন্ধ করে দিতেও প্রস্তুত।
ইউরোপ-উত্তর আমেরিকা-অস্ট্রেলিয়া-এশিয়া বা মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ যদি বাংলাদেশে অবস্থানকারী রোহিঙ্গাদের দশ-পনেরো হাজার করে ভার নিতে রাজি হয়, তাহলে ভারতও এই চল্লিশ হাজার রোহিঙ্গাকে এখনকার মতো মেনে নেওয়ার কথা ভাববে।
ঘ. এ বছর নিউ ইয়র্কে সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি যাচ্ছেন না । তার পরিবর্তে পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ ভারতের প্রতিনিধিত্ব করবেন। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সুষমা স্বরাজের ব্যক্তিগত সমীকরণ অত্যন্ত মধুর। ভারত আশা করছে, মিস স্বরাজ শেখ হাসিনার সঙ্গে একান্ত আলোচনায় রোহিঙ্গা প্রশ্নে ভারতের বাধ্যবাধকতার দিকটি তাকে বোঝাতে পারবেন । একই সঙ্গে ভারত যে বাংলাদেশের বিপদে মোটেও নির্বিকার নয়, সেই বার্তাটিও দিতে পারবেন।
তবে এই কূটনৈতিক ভারসাম্য বিধানের পরিকল্পনা করা যত সহজ, বিষয়টি বাস্তবে করে দেখানো যে তার চেয়ে অনেক কঠিন , ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা তা বিলক্ষণ জানেন।
ফলে আগামী সপ্তাহে নিউ ইয়র্কে জাতিসংঘের সদর দফতরে ভারতের জন্য এক দুরূহ কূটনৈতিক পরীক্ষা। রোহিঙ্গা প্রশ্নে মিয়ানমারকে তারা চটাতে পারবে না, একই সঙ্গে বাংলাদেশের উদ্বেগেও শরিক হতে হবে ও তাদের বোঝা লাঘব করার চেষ্টা চালাতে হবে!
মিয়ানমার বাহিনী কর্তৃক রোহিঙ্গাদের গণহত্যা সত্ত্বেও দেশটির পাশে থাকার ঘোষণা দিয়েছে চীন। রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের জরুরি বৈঠকের আগে এমন ঘোষণা দিয়েছে নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী এই সদস্য দেশ।
মঙ্গলবার চীন আবারো বলেছে, তারা ‘শান্তি ও স্থিতিশীলতা’ রক্ষায় মিয়ানমার সরকারের পাশে আছে। খবর: বিবিসি বাংলা।
চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র গেং শুয়াং বলেন, ‘মিয়ানমার সরকার তাদের জাতীয় উন্নয়নের জন্য শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখার যে চেষ্টা করছে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উচিত তার পাশে থাকা।’
রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে বুধবার জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের জরুরি বৈঠক বসতে যাচ্ছে। ধারণা করা হচ্ছে- এতে মিয়ানমারের বিষয়ে যেকোনো সিদ্ধান্তে ভেটো (বাধা) দেবে চীন। একই অবস্থান নিতে পারে রাশিয়াও।
এদিকে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক কমিশনার রাখাইনে যা ঘটছে তাকে ‘টেক্সটবুক এথনিক ক্লিনজিং অর্থাৎ জাতিগত নিধন অভিযানের যা সংজ্ঞা, হুবহু তাই’ বলে বর্ণনা করেন।
এরপরই জাতিসংঘের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এই পরিষদের বৈঠক অনুষ্ঠিত হচ্ছে। ব্রিটেন এবং সুইডেনের অনুরোধে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের এই জরুরি বৈঠক ডাকা হয়েছে বলে জানা গেছে।
তবে এতে রোহিঙ্গাদের ওপর ব্যাপক হত্যা-নির্যাতন-নিপীড়নের অভিযোগে মিয়ানমারের ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্তের সম্ভাবনা এখনো পর্যন্ত ক্ষীণ বলেই মনে করা হচ্ছে। নিরাপত্তা পরিষদে পাঁচটি স্থায়ী সদস্য দেশের যেকোনো দেশ কোনো প্রস্তাব বা সিদ্ধান্তের বিপক্ষে ভোট দেয়, তাহলে সেটি আটকে যায়।
রোহিঙ্গা ইস্যুতে নিরাপত্তা পরিষদের এই বৈঠকে তা-ই ঘটতে যাচ্ছে বলে মনে করা হচ্ছে। এর অন্যতম কারণ, চীন এখনো পর্যন্ত রোহিঙ্গা সংকটে মিয়ানমার সরকারের গৃহীত সব ব্যবস্থাকে শতভাগ সমর্থন জানিয়ে চলেছে।
জাতিসংঘের কূটনীতিকদের উদ্ধৃত করে বার্তা সংস্থা রয়টার্স বলছে, রোহিঙ্গা সংকটে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ কোনো মাথা গলাক, সেটা চীন চায় না। নিরাপত্তা পরিষদে গত সপ্তাহে আরেকটি বৈঠকেও চীন মিয়ানমারের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিল।
এদিকে নিরাপত্তা পরিষদের আরেক স্থায়ী সদস্য অবশ্য রোহিঙ্গা সংকটের ব্যাপারে তাদের দীর্ঘ নীরবতা ভেঙেছে। যুক্তরাষ্ট্র বলেছে, সহিংসতার মুখে যেভাবে রোহিঙ্গারা তাদের বাড়িঘর ছাড়া হয়েছে তাতে বোঝা যায় মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনী সেখানে বেসামরিক মানুষকে নিরাপত্তা দিচ্ছে না।

Posted ১১:১৪ অপরাহ্ণ | মঙ্গলবার, ১২ সেপ্টেম্বর ২০১৭
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta