মিয়ানমারের রাখাইন থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গাদের শরণার্থী জীবনের চার মাস পার হচ্ছে এ মুহূর্তে। বাংলাদেশ ও আন্তর্জাতিক শক্তি ও অধিকার সংস্থাগুলোর চাপের মুখে ইতোমধ্যে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে গত নভেম্বরে একটি চুক্তির স্বাক্ষর হয়েছে দুই দেশের মধ্যে। চুক্তি অনুসারে দুই দেশের প্রতিনিধির সমন্বয়ে ইতোমধ্যেই একটি যৌথ ওয়ার্কিং কমিটি গঠন করা হয়েছে।
এই কমিটির তদারকির আওতায় বাংলাদেশে নিবন্ধিত রোহিঙ্গারা দ্রুততম সময়ের মধ্যে আবারো রাখাইনে ফিরে যাওয়ার সুযোগ পাবেন। তবে কাগজে-কলমে সম্পাদিত এ চুক্তির মাঠ পর্যায়ের কার্যকারিতা সম্পর্কে এখন পর্যন্ত আশাবাদী হতে পারছে না জাতিসংঘ এবং আন্তর্জাতিক অধিকার গ্রুপসহ সংশ্লিষ্ট কোনো পক্ষই।
চুক্তির অলঙ্ঘ্যনীয় শর্ত অনুসারে, এই প্রত্যাবাসন রোহিঙ্গাদের স্বেচ্ছাভিত্তিক হতে হবে। তাদের জোর করে ফেরত পাঠানো যাবে না। রাখাইনে ফিরে যাওয়ার পর সেখানেও তাদের সম্মানের সঙ্গে গ্রহণ করার বিষয়টি নিশ্চিত হতে হবে। তাদের মিয়ানমারের দীর্ঘদিনের কাক্সিক্ষত নাগরিক স্বীকৃতি দিয়ে সব ধরনের সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।
অথচ বাস্তব পরিস্থিতি সমর্থন করছে না এর কোনোটাই। চার মাস আগে রাখাইনে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলিমদের ওপর দমন অভিযান শুরু করেছিল মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। বিদ্রোহ দমনের অজুহাতে অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে নিরীহ গ্রামবাসীর ওপর চড়াও হয় তারা। স্থানীয় দালালচক্রের সহযোগিতায় সুপরিকল্পিতভাবে রোহিঙ্গাদের গ্রামে হামলা চালিয়ে খুন, ধর্ষণ আর জ্বালাও-পোড়াওয়ের মাধ্যমে বিভীষিকার রাজত্ব কায়েম করে।
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন চুক্তিতে রাখাইনে সেনা অভিযান বন্ধ রেখে সেখানে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেয়ার কথা বলা হলেও মাঠপর্যায়ে রাখাইনের রোহিঙ্গা অধ্যুষিত জনপদে বর্বরোচিত সেনা অভিযানই বন্ধ হয়নি এখনো। গণমাধ্যমের জন্য নিষিদ্ধ করে রাখা ওই এলাকার দৃশ্য ধারণ করেছে মানবাধিকার গ্রুপের স্যাটেলাইট।
এর ফুটেজেও দেখা গেছে, প্রত্যাবাসন চুক্তি স্বাক্ষরের প্রায় দেড় সপ্তাহ পরও, গত ২ ডিসেম্বর রোহিঙ্গা গ্রামগুলোতে অগ্নিসংযোগ অব্যাহত রেখেছে সেনাবাহিনী। এদিকে, ফিরে যাওয়ার মতো পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে রাখাইনে, আন্তর্জাতিক তদারকি সংস্থাগুলোর কাছ থেকে এমন নিশ্চয়তা না পেলে রোহিঙ্গারা কোনোক্রমেই ফিরতে পারবে না রাখাইনে।
সু কির পুতুল সরকার, শেষ কথা বলতে পারে শুধু সামরিক শক্তি :
সংকট শুরুর পর থেকে এ পর্যন্ত নিরাপত্তা পরিষদে একাধিক উদ্যোগ নিয়েও কার্যকর কোনো প্রস্তাব এখনো পাস করা সম্ভব হয়নি মিয়ানমারের সামরিক কর্তৃপক্ষের মিত্র চীন-রাশিয়ার বাধার মুখে। তবে এর মধ্যেও গত ২৪ ডিসেম্বর একটি প্রস্তাব পাস হয়েছে জাতিসংঘে। ইসলামি সহযোগিতা সংস্থা ওআইসি ওই প্রস্তাব উত্থাপন করে জাতিসংঘে। চীন-রাশিয়ার বাধা দিলেও পাস হওয়া ওই প্রস্তাবে বিশ্বের সবচেয়ে নিপীড়িত জনগোষ্ঠীর ওপর চলমান সামরিক অভিযান বন্ধের আহ্বান জানানো হয় মিয়ানমারের উদ্দেশ্যে।
এর আগে দেশটির ওপর বিভিন্ন মাত্রার সামরিক ও অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার ঘোষণা দেয় ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) এবং যুক্তরাষ্ট্র। দীর্ঘদিনের সামরিক শাসনের পর সদ্য গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে উত্তীর্ণ দেশটির ওপর বিশেষ বিবেচনায় সামগ্রিক অবরোধ আরোপ না করলেও শীর্ষ সামরিক নেতৃত্বকে আনা হয় অবরোধের আওতায়। যদিও এসব পদক্ষেপের কোনোটাতেই তেমন গা করছে না মিয়ানমার।
শান্তিতে নোবেল জয়ী মিয়ানামরের গণতান্ত্রিক নেত্রী অং সান সু কির দল এনএলডি সর্বশেষ নির্বাচনে বিপুল ভোটে জিতে ক্ষমতায় এলেও দেশটির শাসনকাঠামো অনুসারে কার্যকর কোনো ক্ষমতাই নেই তাদের হাতে। সাংবিধানিক কলাকৌশলে ক্ষমতার মূল চাবিকাঠি আগে থেকেই সুরক্ষিত রয়েছে সামরিক নেতৃত্বের হাতেই। ফলে অং সান সু কির আন্তরিকতা বহিরঙ্গে দৃশ্যমান হলেও সামরিক শক্তিকে উপেক্ষা করে শান্তির লক্ষ্যে গৃহীত কোনো পদক্ষেপের বাস্তবায়ন কোনোক্রমেই সম্ভব নয় সেখানে।
জাতিসংঘের নির্দেশনা উপেক্ষিত :
রাখাইনে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে মিয়ানমারের সেনাভিযানকে জাতিগত নিধনের পুস্তকীয় নিদর্শন হিসেবে অভিহিত করেছে প্রথমে জাতিসংঘ এবং পরবর্তীতে যুক্তরাষ্ট্র। জাতিসংঘের গত রোববার ১২২-১০ ভোটে পাস হওয়া সর্বশেষ প্রস্তাবে মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসকে বলা হয়েছে মিয়ানমারে একজন বিশেষ দূত নিয়োগের জন্য।
তবে মিয়ানমার সরকারের আপত্তির মুখে আটকে আছে জাতিসংঘের বিশেষ দূত ইয়াংগি লির জানুয়ারি মাসের আসন্ন সফরও। রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনীর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ তদন্তে সংঘাতকবলিত ওই এলাকা পরিদর্শনের কথা রয়েছে তার।