কক্সবাংলা ডটকম(১১ আগস্ট) :: মিয়ানমারের ইতিহাসে সামরিক স্বৈরতন্ত্রের প্রভাব সবারই জানা। ১৯৪৮ সালে স্বাধীনতা অর্জনের পর থেকেই দেশটিতে সামরিক জান্তার আধিপত্য চলে আসছে। ২০১৫ সালে অং সান সু চির নেতৃত্বে বেসামরিক সরকার গঠিত হলেও তাথমাদাওই (মিয়ানমার সেনাবাহিনী) ছিল ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে। অং সান সু চির এনএলডি এবং সেনাবাহিনী এক ধরনের হাইব্রিড শাসনের মাধ্যমে দেশ চালাচ্ছিল; কিন্তু ২০২০ সালের নভেম্বরের জাতীয় নির্বাচনে জান্তা-সমর্থিত ইউএসডিপির ভরাডুবির পর তাথমাদাও নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ আনে এবং সেনাসমর্থিত নির্বাচন কমিশন নির্বাচনের ফলাফল প্রত্যাখ্যান করে।
নির্বাচনে কারচুপি ও দেশব্যাপী গণবিক্ষোভের ফলে দেশটিতে অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়। দেশের আইনশৃঙ্খলার অবনতির দোহাই দিয়ে ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে এক সেনাঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে সেনাবাহিনী জনগণের দ্বারা নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করে ক্ষমতা দখল করে এবং দেশব্যাপী জরুরি অবস্থা জারি করে। নির্বাচনের ফলাফলকে ভূলুণ্ঠিত করা এবং গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারকে দমনের জন্য সেনাবাহিনী অং সান সু চিসহ তার দলের অন্য নেতাদের গ্রেপ্তার করে।
দুঃখজনক যে, এনএলডি এবং অং সান সু চি তাদের ২০১৫ থেকে ২০২০ সালের শাসনামলে বিভিন্ন আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক চাপ থেকে সেনাবাহিনীকে রক্ষা করে এবং তাদের বিরুদ্ধে আনীত সব অভিযোগ অস্বীকার করে। এমনকি ২০১৭ সালে মিয়ানমার সেনাবাহিনী কর্তৃক রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর পরিচালিত নির্মম অত্যাচারের পর তাথমাদাও-এর বিরুদ্ধে যখন বিশ্বসমাজ গণহত্যার অভিযোগ তোলে, তখন অং সান সু চি সেটি অস্বীকার করেন এবং সেনাবাহিনীর পক্ষে বিবৃতি দেন। কিন্তু পরবর্তী সময়ে সেই সেনাবাহিনীর হাতেই তাকে গ্রেপ্তার হতে হয় এবং নির্বাচনে জয়লাভের পরও এনএলডিকে সরকার গঠন করতে দেওয়া হয়নি।
যাহোক, ফেব্রুয়ারির সেনা অভ্যুত্থানের পরে তাথমাদাও প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক ও জাতিগত শক্তিগুলোকে দমনের মাধ্যমে তার ক্ষমতাকে দীর্ঘস্থায়ী করতে দেশের মধ্যে অত্যাচার ও হত্যাযজ্ঞ আরও বাড়িয়ে দেয়। দমন, নিপীড়ন এবং গৃহবন্দি থেকে শুরু করে এমন কোনো অপরাধ নেই, যা জান্তা-সরকার করেনি। অন্যদিকে, এনএলডি অন্যান্য রাজনৈতিক দল ও জাতিগত গোষ্ঠীগুলোর প্রতিনিধিদের নিয়ে জাতীয় ঐক্যের সরকার গঠন করে। এনএলডি গঠিত পিপলস ডিফেন্স ফোর্সসহ বিভিন্ন জাতিগত ও আঞ্চলিক সশস্ত্রগোষ্ঠী জান্তা-সরকারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম শুরু করে। ফলস্বরূপ দেশব্যাপী সংঘাত ছড়িয়ে পড়ে এবং তা গৃহযুদ্ধে রূপ নেয়। মিয়ানমার সেনাবাহিনী তার আধিপত্য টিকিয়ে রাখতে এবং বিরোধী শক্তি দমনে নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে যায়।
এ পরিস্থিতিতে মিয়ানমারের জান্তাপ্রধান মিন অং হ্লাইং সামরিক শাসনকে চিরস্থায়ী করতে তৃতীয়বারের মতো দেশটিতে জরুরি অবস্থার মেয়াদ আরও ছয় মাস বাড়িয়ে দেন এবং জাতীয় প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা পরিষদ তার অনুমোদন দিয়েছে। ২০২১ সালের ১ আগস্ট মিন অং হ্লাইং নিজেকে রাষ্ট্রীয় প্রশাসন কাউন্সিলের চেয়ারম্যান এবং তিনি যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের গঠন করেছিলেন,নিজেকে তার প্রধানমন্ত্রী হিসাবে ঘোষণা দেন।
পদাধিকার বলে তিনি নির্বাহী, আইন প্রণয়ন এবং বিচার বিভাগের প্রধান হন। তিনি ২০২৩ সালের আগস্টে নতুন নির্বাচন দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। কিন্তু এখন প্রশ্ন হলো, জান্তা-সরকার কেন সামরিক শাসনের মেয়াদ বৃদ্ধি করল এবং এর ফলাফল কী হতে পারে?
প্রথমত, জরুরি অবস্থার মেয়াদ ছয় মাস বাড়িয়ে দেওয়ার পেছনে মূল কারণ হলো, সামরিক শাসনকে দীর্ঘস্থায়ী করা এবং এর মাধ্যমে সামরিক স্বৈরতন্ত্রকে চিরস্থায়ীকরণের পথ সুগম করা।
দ্বিতীয়ত, মিন অং হ্লাইংয়ের লক্ষ্য হলো, ২০২০ সালের নির্বাচনের ফলাফলের বিশ্বাসযোগ্যতা নষ্ট করা।২০২০ সালের নির্বাচনে এনএলডি ইউনিয়ন পর্যায়ে ৮৩ শতাংশ ভোট পেয়ে ৪৭৬টি আসনের মধ্যে ৩৯৩টিতে জয়লাভ করে। বিপরীতে, তাথমাদাও-এর প্রক্সি ইউনিয়ন সলিডারিটি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি (ইউএসডিপি) মাত্র ৩৩টি আসন পেয়েছিল, যা সেনাবাহিনীর জন্য ছিল অপমানজনক।
তৃতীয় কারণটি হলো, জেনারেল মিন অং হ্লাইংয়ের উচ্চাভিলাষী ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক স্বার্থ। ইচ্ছাকৃত বিলম্বের কৌশল অবলম্বন করে বহুল জনপ্রিয় বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোকে ক্রমেই সরিয়ে দিয়ে সেনাবাহিনীর অধীনে নতুন একটি দল গঠন করে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে, ২০২৩ সালে মিন অং হ্লাইং সেনাবাহিনী থেকে অবসরে যাবেন এবং অবসরের পরে রাজনীতিতে আসার ইচ্ছা রয়েছে তার। ২০২০ সালের নির্বাচনকালে এমন একটি কথা ছড়িয়ে ছিল যে, অবসরের পর তিনি দেশটির প্রধানমন্ত্রী পদে আসীন হতে চান।
চতুর্থ কারণ হিসাবে ক্ষমতায় থাকার জন্য তাথমাদাওয়ের বিলম্বের কৌশলকে দেখানো যেতে পারে। জান্তা-সরকার হয়তো চাচ্ছে, ২০২৩ সালের আগস্টে জরুরি অবস্থার মেয়াদ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আনুষ্ঠানিকভাবে একটি অভ্যুত্থান ঘোষণা দেওয়া এবং পরবর্তী সময়ে ডিক্রি জারির মাধ্যমে সেনাশাসনকে স্থায়ীরূপ দেওয়া।
পঞ্চমত, সামরিক শাসনের মেয়াদ বৃদ্ধির মাধ্যমে জান্তা-সরকার এ সংকেত দিতে চাচ্ছে যে, আসিয়ানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সম্মেলনে মিয়ানমারের সামরিক প্রতিনিধিকে আমন্ত্রণ না দেওয়ার সিদ্ধান্ত এবং পশ্চিমা বিশ্বের নিষেধাজ্ঞাকে তারা তোয়াক্কা করে না।
ষষ্ঠত, এ সিদ্ধান্তের কারণ এমন হতে পারে যে, বিলম্বের কৌশলের মাধ্যমে আসিয়ানের সঙ্গে সামরিক জান্তা-সরকারের পাঁচ দফার শান্তি প্রস্তাবের সম্ভাব্যতা ও বাস্তবায়নের সম্ভাবনাকে প্রলম্বিত করা। কারণ, শান্তি প্রস্তাবের প্রতি জান্তা-সরকারের অনীহা ইতোমধ্যে প্রমাণিত এবং এ শান্তি প্রস্তাব বাস্তবায়নে ক্ষেত্রে আসিয়ানেরও মিয়ানমারের বিরুদ্ধে জোরালো কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখা যাচ্ছে না।
জান্তা-সরকারের সামরিক শাসনের মেয়াদ বৃদ্ধির এ সিদ্ধান্তের সুদূরপ্রসারী প্রভাব রয়েছে। এটি যেমন মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বাস্তবতায় পরিবর্তন আনবে, তেমনি আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় এর তাৎপর্য রয়েছে। অধিকন্তু, এটি রোহিঙ্গা সংকটকে আরও বেশি জটিল করে তুলতে পারে।
প্রথমত, জরুরি অবস্থার মেয়াদ বৃদ্ধির সবচেয়ে বড় প্রভাব হলো, এটি সামরিক জান্তার ক্ষমতা বৃদ্ধি করবে, যা প্রকারান্তরে স্থায়ী সামরিক শাসনের পথকে সুগম করবে।
দ্বিতীয়ত, তাথমাদাওয়ের ক্ষমতা বৃদ্ধি এবং শাসন স্থায়ীকরণের কারণে প্রভাব পড়বে দেশটির রাজনৈতিক অবস্থার ওপর। মিয়ানমারের জনগণ সামরিক স্বৈরতন্ত্রকে মেনে নেবে না।
তারা এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ অব্যাহত রাখবে, যা বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন ও জাতিগত সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর কার্যক্রমকে আরও শক্তিশালী করবে। সামরিক জান্তা এসব আন্দোলন দমনের জন্য কঠোর অবস্থান নেবে এবং অত্যাচার ও নিপীড়নের মাত্রা আরও বৃদ্ধি করবে। এটি ক্রমে দেশব্যাপী দীর্ঘস্থায়ী গৃহযুদ্ধে রূপ নেবে।
অ্যাসিস্ট্যান্স অ্যাসোসিয়েশন অব পলিটিক্যাল প্রিজনারস (এএপিপি) বলছে, গত ফেব্রুয়ারির সামরিক অভ্যুত্থানের পর থেকে মিয়ানমার সেনাবাহিনী ২১০০ জনেরও বেশি মানুষকে হত্যা করেছে। সামরিক সরকারের বিরোধিতা করায় তাথমাদাও হাজার হাজার রাজনৈতিক ও সুশীলসমাজের প্রতিনিধিদের আটক করেছে। গত সপ্তাহে জান্তা-সরকার চারজন গণতন্ত্রকর্মীকে মৃত্যুদণ্ড দেয়, যা কয়েক দশকের মিয়ানমারের ইতিহাসে প্রথম।
তৃতীয়ত, ক্ষমতা স্থায়ীকরণের কারণে মিয়ানমারে গণতন্ত্রীকরণ প্রক্রিয়া সম্ভাবনা অধরা রয়ে যাবে।
চতুর্থত, এটি রোহিঙ্গা সংকটের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে এবং সংকটকে আরও জটিল ও দীর্ঘায়িত করতে পারে। তাথমাদাও মিয়ানমারের অভ্যন্তরে বাস্তু হারানো রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর নতুন করে নিপীড়ন চালাতে পারে এবং তাদের পোড়ামাটির নীতি জোরদার করতে পারে।
আরও শঙ্কার ব্যাপার হলো, সামরিক জান্তার ক্ষমতা স্থায়ীকরণ প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়াকে দীর্ঘায়িত করবে।
পঞ্চমত, সামরিক জান্তার ক্ষমতার দীর্ঘায়ন এবং সামরিক শক্তি বৃদ্ধি আঞ্চলিক নিরাপত্তা ও উন্নয়নের জন্য হুমকি সৃষ্টি করবে।
সর্বোপরি, জান্তা-সরকারের এ সিদ্ধান্ত আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি চ্যালেঞ্জ। বিশেষ করে আসিয়ানের জন্য এটি হতাশাজনক; কারণ, দেশটিতে গণতান্ত্রিক পরিবেশ সৃষ্টি করতে ইতঃপূর্বে সংস্থাটির সঙ্গে জান্তা-সরকারের একটি সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছিল।
ড. দেলোয়ার হোসেন : আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞ ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক
Posted ২:২৩ পূর্বাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ১১ আগস্ট ২০২২
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta