কক্সবাংলা ডটকম(১০ সেপ্টেম্বর) :: বালাদেশের প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে আগুন জ্বলছে। সেদেশের সেনাবাহিনী ও পুলিশের নির্মম নির্যাতনের মুখে বাড়িঘর ছেড়ে পালাতে বাধ্য হচ্ছে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর লাখ লাখ মানুষ। সর্বত্র ওত পেতে বসে আছে ভয়ংকর মৃত্যু; কিন্তু জীবন থাকতে বাঁচার আশা কে ত্যাগ করে!
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে বাংলাদেশের অবস্থান। ভৌগোলিকভাবে রাখাইন রাজ্যের সবচেয়ে নিকটতম রাষ্ট্র বাংলাদেশে। তাই আশ্রয় লাভের আশায় ঝাঁকে ঝাঁকে ছুটে আসছে নির্যাতিত মানুষ।
জাতিসংঘের তথ্যমতে সেনাবাহিনীর অভিযান থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত প্রাণ বাঁচাতে প্রায় তিন লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থী হিসেবে বাংলাদেশে আশ্রয় গ্রহণ করেছে। এছাড়া হাজার হাজার রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ ও শিশু আশ্রয়ের আশায় বাংলাদেশ সীমান্তে এসে অপেক্ষার প্রহর গুনছে।
গত বছরের অক্টোবর মাসে একটি বিজিপি (বর্ডার গার্ড পুলিশ) সেনা চৌকিতে সন্ত্রাসী হামলার জের ধরে মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও পুলিশ সন্ত্রাস দমনের নামে রোহিঙ্গা নিধন অভিযান শুরু করে। তাদের সঙ্গে এ অভিযানে যোগ দেয় উগ্রপন্থি বৌদ্ধ গ্রুপগুলো। তারা নারী-পুরুষ ও শিশুদের নির্মম নির্যাতনের মাধ্যমে হত্যা করার ফলে সেসময় বিপুল সংখ্যক (প্রায় এক লাখ) রোহিঙ্গা প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে বাংলাদেশে এসে আশ্রয় গ্রহণ করে।
রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের জন্য জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনানের নেতৃত্বে একটি তদন্ত টিম মিয়ানমারে পাঠানো হয়। দীর্ঘদিন রাখাইন ও আরাকান রাজ্য পরিদর্শনসহ রোহিঙ্গাদের মতামতের ভিত্তিতে উক্ত কমিশন গত ২৪ আগস্ট প্রতিবেদন প্রকাশ করে। উক্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, মিয়ানমারের নাগরিক হিসেবে রোহিঙ্গাদের স্বীকৃতি দিতে হবে এবং তাদের মানবাধিকার রক্ষায় সরকারকে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে।
মনে করা হচ্ছিল, এর মাধ্যমে হয়ত রোহিঙ্গা সমস্যার একটি স্থায়ী সমাধান সম্ভব হবে; কিন্তু তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশের ঠিক একদিন পর আবারো সন্ত্রাসী হামলার জের ধরে রোহিঙ্গা নিধন অভিযান শুরু করা হয়। এর আগে সেনাবাহিনী তাদের অবরোধ করে রেখেছিল।
রোহিঙ্গাদের আবাসভূমি আরাকান একটি স্বাধীন রাজ্য ছিল; কিন্তু ১৭৮৪ সালে বার্মিজ রাজা বোডপায়া এটি দখল করে বার্মার করদ রাজ্যে পরিণত করে। তখন থেকেই বার্মিজ রাজার শাসন ও শোষণে নিষ্পেষিত হতে থাকে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা সম্প্রদায়।
পরবর্তীকালে ব্রিটিশ শাসন অবসানের পর ১৯৬২ সালে সামরিক ক্যু’র মাধ্যমে রাষ্ট্রের শাসন ক্ষমতা করায়ত্ত করে সামরিক জান্তা। ১৯৭০ সালে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব সনদ দেওয়া বন্ধ করা হয়। ১৯৭৪ সালে তাদের ভোটাধিকার কেড়ে নেওয়া হয়। এমনকি ১৯৮২ সালের নাগরিক ফরমানে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্বের স্বীকৃতি বাতিল করা হয়।
বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের প্রথম দিকে আশ্রয় দিতে রাজি না হলেও পরে শুধু মানবিক দিক বিবেচনা করে সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়। এক্ষেত্রে অসহায় মানুষগুলোর মুখের দিকে তাকিয়ে না বলার উপায় থাকে না;
কিন্তু প্রশ্ন জাগে, এই যে বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গার বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ এবং পূর্ব থেকে বাংলাদেশে অবস্থান করা প্রায় পাঁচ লক্ষাধিক রোহিঙ্গার চাপ সামাল দিতে সক্ষম হবে বাংলাদেশ সরকার? এত সংখ্যক মানুষের প্রতিদিনের বেঁচে থাকার মতো আহার এবং প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সরবরাহ করা সহজ ব্যাপার নয়।
শুধু মানবিকতার খাতিরে বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিতে বাধ্য হয়েছে। কারণ অসহায় মানুষগুলোকে পুনরায় গুলির মুখে ছুঁড়ে দেওয়া কোনো বিবেকবান মানুষের পক্ষে কিছুতেই সম্ভব নয়। মিয়ানমারের নিকটতম প্রতিবেশী দেশ হিসেবে বাংলাদেশের ভূমিকা এখন প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছে।
এমনিতে মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশ একটি সুসম্পর্ক বজায় রেখে আসছে। এখন বাংলাদেশ না পারছে রোহিঙ্গাদের জোরপূর্বক দেশে ফেরত পাঠিয়ে দিতে আর না পারছে তাদের বাংলাদেশে আশ্রয় দান করে ভরণপোষণের ব্যবস্থা করতে। ফলে বাংলাদেশ এ মুহূর্তে উভয় সংকটে রয়েছে।
মানবিক দিক বিবেচনা করে এত বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গাকে সাময়িক আশ্রয় প্রদান করা হলেও চিরদিন তাদের এদেশে অবস্থান করার কোনো উপায় নেই। একসময় তাদের নিজ দেশে অবশ্যই ফিরে যেতে হবে। এক্ষেত্রে কীভাবে তাদের নিজ দেশে ফেরত পাঠানো যায় সে ব্যাপারে সরকারকে জোর কূটনৈতিক তত্পরতা চালাতে হবে। যতবেশি সম্ভব বিভিন্ন দেশকে এ ব্যাপারে সম্পৃক্ত করার চেষ্টা করতে হবে।
কারণ রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের দায় শুধু বাংলাদেশের একার নয়। এখন এটি একটি বৈশ্বিক সমস্যা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। ফলে বৈশ্বিকভাবেই এর মোকাবিলা করতে হবে। এক্ষেত্রে জাতিসংঘ কী পদক্ষেপ গ্রহণ করে সেটাও দেখার বিষয়।
ইতোমধ্যে টেকনাফ, উখিয়া, নাইক্ষ্যংছড়িসহ কক্সবাজারের বিস্তৃত অঞ্চলে পূর্ব থেকে অবস্থান করা রোহিঙ্গারা হাত-পা গেড়ে বসেছে। নানা প্রকার অনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে তারা জড়িত হয়ে পড়ছে।
বিভিন্ন সন্ত্রাসবাদী গ্রুপের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা, মানব পাচার, দেশের অভ্যন্তরে মাদক সরবরাহসহ নানা সমাজবিরোধী কার্যকলাপে লিপ্ত হয়ে পড়ছে। ফলে সরকারের জন্য এটা একটা বড় ধরনের মাথা ব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের ব্যাপারে সরকারকে তাই বুঝে শুনে পদক্ষেপ নিতে হবে। আমরা আশা করবো দ্রুত রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে এবং এ অঞ্চলে অচিরেই স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হবে।
লেখক-আরাফাত শাহীন : শিক্ষার্থী, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী
Posted ৩:০৮ পূর্বাহ্ণ | সোমবার, ১১ সেপ্টেম্বর ২০১৭
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta