
কক্সবাংলা ডটকম(১১ অক্টোবর) :: কোনো নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর নির্বাচন কমিশনকে (ইসি) সহায়তা করা রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগের সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা রয়েছে। বিশেষ করে সংসদ নির্বাচনে তফসিল ঘোষণার আগে একটি সুবিন্যস্ত জনপ্রশাসন খুবই জরুরি। কারণ জাতীয় নির্বাচনের মতো একটি বিশাল কর্মযজ্ঞ প্রশাসনের সহযোগিতা ছাড়া অসম্ভব। নির্বাচনে তাদের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ হলেও তফসিল ঘোষণাকে সামনে রেখে লেজেগোবরে অবস্থা তৈরি হয়েছে জনপ্রশাসনে। সরকার ও ইসির ঘোষণা মতো জাতীয় নির্বাচনের আর মাত্র ১২০ দিন সময় বাকি থাকলেও প্রশাসনের পরিস্থিতি দিন দিন জটিল হচ্ছে।
নির্বাচনে সহযোগিতা দূরে থাক, নিজেই যেন চলতে পারছে না প্রশাসন। দুই সপ্তাহ ধরে প্রশাসনের কেন্দ্রবিন্দু জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সচিব পদ ফাঁকা পড়ে আছে। প্রত্যাহার করা হয়নি যুগ্ম সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করে যাওয়া জেলা প্রশাসকদের। বিভিন্ন স্থানে ডিসি পদে পদায়ন করলেও বিতর্কের জেরে আবার প্রত্যাহার করতে হয় আগের প্রজ্ঞাপন। শৃঙ্খলা, নেতৃত্ব, দক্ষতা ও সুচিন্তিত সিদ্ধান্তের অভাবে পদে পদে সংকটে পড়ছে প্রশাসন।
প্রশাসন চালাতে গিয়ে রীতিমতো সংকটে আছে অন্তর্বর্তী সরকার। তদবির ও চাপ সামলাতে পারছে না। অদক্ষতার ছাপ সামনে আসছে প্রতিনিয়ত। এর সর্বশেষ দৃষ্টান্ত হচ্ছেÑ গত ৫ সেপ্টেম্বর ওএসডি থাকা উপসচিবদের পদায়নের ঘটনা। মৎস্য ও প্রাণী সম্পদ মন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশ পাবলিক প্রকিউরমেন্ট অথরিটিতে (সাবেক সিপিটিইউ) শূন্যপদের অতিরিক্ত পদায়ন দিয়েছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। তা ছাড়া বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত কমপক্ষে ২০ জন ডিসি যুগ্ম সচিব পদে পদোন্নতি পাওয়ার সাত মাস পরও জেলায় দায়িত্ব পালন করছেন। আবার সচিবসহ বিভিন্ন পদে পদোন্নতি দিতে গিয়ে ঘোলাটে পরিস্থিতি তৈরি করা হচ্ছে দফায় দফায়। গেল সরকারের অন্যায্য সুবিধাভোগী হিসেবে সমালোচনা সামনে এলে পরক্ষণে ওএসডি করে বসিয়ে বসিয়ে বেতন-ভাতা দিতে হচ্ছে।
এ বিষয়ে জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ মোহাম্মদ ফিরোজ মিঞা বলেন, জনপ্রশাসনে কোনো শৃঙ্খলা নেই। প্রশাসনের সব স্তরে এক ধরনের স্থবিরতা দেখা দিয়েছে। এমনটা আগে কখনও ঘটেনি। বর্তমান সরকারের আমলে এমন করুণ অবস্থা আশা করেনি কেউ। আগামীতে কেমন হবে তাও বলা যাচ্ছে না।
সংশ্লিষ্টদের মতে, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচনে প্রশাসনের সর্বস্তরের ভূমিকা জরুরি। কিন্তু এ মুহূর্তে বড় সংকট দেখা দিয়েছে। দলীয় চাপ থেকে মুক্ত করা যায়নি প্রশাসনকে। পদোন্নতি ও বদলিতে নেই গ্রহণযোগ্য মানদণ্ড। দক্ষতা ও যোগ্যতার পরিবর্তে পছন্দের কর্মকর্তাকে পদায়ন নিয়ে ক্ষোভ ও বিতর্ক কাটছে না। তা ছাড়া পদোন্নতি বা ফিটলিস্টের জন্য সংস্থার মাধ্যমে গোপন প্রতিবেদনের চর্চিত পন্থা নিয়েও কর্মকর্তাদের মধ্যে আপত্তি রয়েছে। তাদের মতে, চাকরির পর কোনো কর্মকর্তার গ্রামের বাড়িতে গিয়ে পাড়ার চায়ের দোকানদার বা প্রতিবেশীর অভিমত নেওয়া হয়। সংস্থার গোপন প্রতিবেদন বলা হয় একে। আত্মীয়ের পরিচয় বা অবস্থানের জেরে নিরীহ কর্মকর্তাকে খেসারত দেওয়ার দৃষ্টান্ত নতুন নয়। বরং কর্মক্ষেত্রে তার ভূমিকাকেই বিবেচনায় নেওয়া উচিত। বিদ্যমান ব্যবস্থায় বিসিএস পরীক্ষায় কৃতকার্য
হওয়ার পরে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় চূড়ান্ত নিয়োগের আগে পুলিশ বিভাগের কাছে গোপনীয় প্রতিবেদন চাওয়া হয়। আবার পদোন্নতির ক্ষেত্রে গোয়েন্দা বিভাগের কাছে রাজনৈতিক পরিচয় জানতে চাওয়া হয়। জনপ্রশাসনে রাজনীতিকীকরণ এ স্তর থেকেই শুরু হয়। জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন মনে করে, এ নিয়ম বাতিল হওয়া প্রয়োজন।
জনপ্রশাসনে দলীয়করণের ধাপটা দৃশ্যমান হয় জনতার মঞ্চের মাধ্যমে। নব্বইয়ের দশকের ঘটনা। ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর, এইচটি ইমাম, আবু আলম মোহাম্মদ শহীদ খানদের হাত ধরে দলীয়করণ প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়। দেখা গেছে, ডিসি নিয়োগে মৌখিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া কর্মকর্তাদের মধ্যে নির্দিষ্ট কিছু ব্যক্তিকে নিয়োগ দেওয়া হতো। সবাইকে নয়। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, সংস্থার গোপন প্রতিবেদন ও দলীয় আনুগত্যের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে সিদ্ধান্ত নিত জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনেও এই চিত্র উঠে এসেছে।
দেখা গেছে, বিগত বছরগুলোয় জনপ্রশাসনে দলীয় লোকদের নিয়োগ ও দলীয় কর্মকর্তাদের পদোন্নতি প্রদান, সরকারি কর্মকাণ্ডে প্রায় সব আইনানুগ সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ এবং আইনানুগ সিদ্ধান্তের পরিবর্তে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গুরুত্ব পায়। এর ফলে আইনের শাসন ভূলুণ্ঠিত হওয়া ও দুর্নীতির ব্যাপকতা বৃদ্ধির পাশাপাশি গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠায় একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনের জন্য নিরপেক্ষ প্রশাসনের অস্তিত্ব পাওয়া যায় না।
এই অবস্থায় নির্বাচন সামনে রেখে মাঠ পর্যায়ের অফিসার বাছাই ও পদায়নে ব্যস্ত থাকার বদলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় নিজেই গতিহীন হয়ে আছে। জনপ্রশাসনের সচিব পদটি ২১ সেপ্টেম্বর থেকে শূন্য। রুটিন দায়িত্বে আছেন একই মন্ত্রণালয়ের একজন অতিরিক্ত সচিব। থমকে গেছে অতিরিক্ত সচিব ও যুগ্ম সচিব পদোন্নতি প্রক্রিয়া। জনপ্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নিয়োগ, বদলি ও শৃঙ্খলার বিষয়ে পরামর্শ দিতে গঠিত জনপ্রশাসনবিষয়ক কমিটি থেকে প্রধান উপদেষ্টার মুখ্য সচিবকে বাদ দিয়েছে সরকার। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ২৩ সেপ্টেম্বর রাতে এই কমিটি পুনর্গঠন করে প্রজ্ঞাপন জারি করে।
প্রশাসনের বিশৃঙ্খলার আরেকটি চিত্র হচ্ছেÑ গত বছরের শেষের দিকে চট্টগ্রাম ও ময়মনসিংহ বিভাগে দুজন জেলা প্রশাসক দায়িত্ব নেওয়ার পর তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও অসদাচরণের অভিযোগ ওঠে। কিন্তু সরকার তাদের দুজনকে প্রত্যাহার করে তদন্তের আওতায় আনতে এক বছরেরও বেশি সময় নেয়। কক্সবাজারে ডিসির সর্বশেষ পদায়নে দেখা যায়- অভ্যন্তরীণ কোন্দলে, নবনিযুক্ত ডিসিকে প্রথমে কর্মস্থলে যোগদানে বাধা দেওয়া হয়। অবশেষে নির্ধারিত তারিখের আট দিন পরে তিনি দায়িত্ব গ্রহণ করেন। পৃথক প্রজ্ঞাপনে পূর্ববর্তী ডিসিকে প্রত্যাহারের পর নওগাঁর ডিসিকে চট্টগ্রামে বদলি করা হয়েছিল, তবুও নতুন ডিসিকে যোগদান না করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে।
এদিকে পদ ছাড়া পদোন্নতি চলছে এখনও। জনপ্রশাসনে এখন নিয়মিত উপসচিব পদ রয়েছে এক হাজারের মতো। কিন্তু এই পদে কর্মকর্তা রয়েছেন ১ হাজার ৫৯৬ জন। পদের চেয়ে কর্মকর্তার সংখ্যা আগে থেকেই বেশি ছিল। সর্বশেষ ২৬৮ জনকে উপসচিব পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়। পদোন্নতিতে শুধু বাড়ে বেতন ও ভাতা। পাশাপাশি উপসচিব পদে তিন বছর চাকরির পর গাড়ি কেনার জন্য বিনা সুদের ঋণসুবিধা পাওয়া যায়।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুযায়ী, বর্তমানে সহকারী সচিব থেকে সচিব পর্যন্ত প্রশাসনে মোট কর্মকর্তা আছেন ৬ হাজার ৫১৮ জন। এর মধ্যে সিনিয়র সচিব, সচিব বা সমপর্যায়ের কর্মকর্তা আছেন ৮৪ জন এবং গ্রেড-১ পদের কর্মকর্তা আছেন ১৫ জন। এই পদে নির্দিষ্ট পদসংখ্যা নেই। অতিরিক্ত সচিবের নিয়মিত পদ রয়েছে ২১২টি। এর সঙ্গে বিভিন্ন দপ্তরে প্রেষণে থাকা প্রায় ১২৫টি পদ মিলে মোট পদ দাঁড়ায় ৩৩৭টি। অথচ সংখ্যাটা অন্তত ৩৪৩ জন। অন্যদিকে যুগ্ম সচিবের পদ রয়েছে ৫০২টি। কিন্তু কর্মকর্তা আছেন ১ হাজার ২৭ জন। সিনিয়র সহকারী সচিব আছেন ১ হাজার ৮৭৩ জন এবং সহকারী সচিবের সংখ্যা ১ হাজার ৫৩৩। এ ক্ষেত্রে নিয়মিত কোনো নির্দিষ্ট পদসংখ্যা নেই।
বিগত সরকারের সময়ও চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ হতো, এখনও হচ্ছে। বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) করে রেখে অনেককে বসিয়ে বসিয়ে বেতন দেওয়া হচ্ছে। বর্তমানে সচিব পদের ১০ কর্মকর্তা ওএসডি (প্রশাসনিক) রয়েছেন। একই পদে ১২ জন রয়েছেন চুক্তি ভিত্তিতে। অন্তর্বর্তী সরকারের এ প্রশাসনে দরকার দৃঢ় পদক্ষেপ নেওয়া, যা সম্ভব হয়নি এখনও। বদলি/পদায়ন ও ভূতাপেক্ষ পদোন্নতিসহ নানা সিদ্ধান্তে নিরপেক্ষ অবস্থান দেখাতে পারেনি প্রশাসন। পতিত শেখ হাসিনা সরকারের সুবিধাভোগীরাও পেয়ে যাচ্ছে পদোন্নতি। আবার দুর্নীতির দায়ে শাস্তিপ্রাপ্তরাও ক্ষেত্রবিশেষে সুবিধা বাগিয়ে নেওয়ার অভিযোগ আছে।

Posted ১০:৩৫ পূর্বাহ্ণ | শনিবার, ১১ অক্টোবর ২০২৫
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta