কক্সবাংলা ডটকম(২০ মে) :: রাজধানীর বনানীতে দ্য রেইনট্রি হোটেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই শিক্ষার্থীকে ধর্ষণের ঘটনার ভিডিও ফুটেজ উদ্ধার করেছে পুলিশ। এ ঘটনায় দায়ের করা মামলায় প্রধান আসামি আপন জুয়েলার্সের মালিক দিলদার আহমেদ সেলিমের পুত্র সাফাত আহমেদের মোবাইল ফোন থেকে এই ভিডিও ফুটেজ উদ্ধার হয়েছে।
এ ঘটনায় সাফাতের বিরুদ্ধে বনানী থানায় আইসিটি অ্যাক্টে একটি মামলা দায়ের করবেন দুই অভিযোগকারীর একজন।
ভিডিও ফুটেজে ধর্ষণের দৃশ্য আছে কিনা-এ ব্যাপারে তদন্ত সংশ্লিষ্ট কোন কর্মকর্তাই মুখ খোলেনি। তবে সাফাতের মোবাইল ফোন থেকে দুই অভিযোগকারীর সঙ্গে সেলফি তোলা অনেক ছবি উদ্ধার করেছে। সাফাতের সঙ্গে অভিযোগকারীর জড়িয়ে ধরার ছবি রয়েছে।
ডিবি কর্মকর্তারা বলছেন, ভিডিও ফুটেজ ও ছবি উদ্ধারের বিষয়টি আইসিটি অ্যাক্টে মামলা দায়েরের পুলিশ গণমাধ্যম জানাবে।
অপরদিকে, সংসদ সদস্য বজলুল হক হারুনের মালিকানাধীন দ্য রেইনট্রি হোটেল থেকে উদ্ধার করা সিসি ক্যামেরার ভিডিও ফুটেজের কিছু তথ্য উদঘাটন করা গেছে বলে দাবি করেছেন মামলার তদন্ত সংশ্লিষ্টরা। ২৮ মার্চ ধর্ষণের ঘটনার পর ঐ হোটেলে সাফাত, সাকিফ ও নাঈম একাধিকবার যাওয়ার ভিডিও ফুটেজ পাওয়া গেছে।
উদ্ধার করা সিসি ক্যামেরার ফুটেজ যাচাই করা হচ্ছে বলে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের এক শীর্ষ কর্মকর্তা জানিয়েছেন।
সাফাতের মোবাইল ফোন থেকে ভিডিও ফুটেজ উদ্ধারের খবর জানিয়ে মামলার তদন্ত সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা জানান, গাড়ি চালক বিল্লাল দ্য রেইনট্রি হোটেলের ৭০১ নম্বর কক্ষের বাথরুম থেকে মোবাইল ফোন দিয়ে ধর্ষণের দৃশ্য ভিডিও করে। বাথরুমের দেয়ালের কাঁচের রুমের দিক থেকে কিছুই দেখা যাবে না। কিন্তু বাথরুম থেকে দেয়ালের কাঁচ দিয়ে রুমের ভিতরের সব কিছু দেখা যায়। ভিডিও করার পর সাফাত তার মোবাইল ফোনে ঐ ফুটেজ নিয়ে নেয়। ঘটনার কয়েকদিন পর সাফাত তার দেহরক্ষী রহমত আলীকে ঐ দুই ছাত্রীর বাসায় পাঠিয়েছিলেন।
এদিকে মামলার এজাহারভুক্ত দুই নম্বর আসামি নাঈম আশরাফের ৭ দিনের রিমান্ডের প্রথম দিন ছিল গতকাল। তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলেন, ডিবি কার্যালয়ে জিজ্ঞাসাবাদের সময় নাঈমের মুখোমুখি করা হয় সাফাতের গাড়ি চালক বিল্লাল ও দেহরক্ষী রহমত আলীকে।
তাদের জিজ্ঞাসাবাদের সময় সেখানে উপস্থিত ডিবির এক কর্মকর্তা বলেন, বিল্লাল আগেই দুই শিক্ষার্থীকে ধর্ষণের ঘটনার বিস্তারিত জানিয়েছেন। নাঈমের সামনে ফের একই ধরনের বক্তব্য দেন। এ সময় নাঈমের কাছে জানতে চাওয়া হয় বিল্লাল যা বলছে তা ঠিক কিনা, তখন নাঈম ‘ঠিক’ বলে সম্মত দেয়ে। সেই সঙ্গে নাঈম এক শিক্ষার্থীকে ধর্ষণের কথা স্বীকার করেন।
নাঈমের সঙ্গে একাধিক নারীর অনৈতিক সম্পর্কের তথ্য দিয়ে ঐ কর্মকর্তা আরো বলেন, ‘নাঈম আসলে সমাজের উচ্চবিত্ত শ্রেণীর তরুণীদের সঙ্গে অনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের পেশাদার দালাল।’ গুলশান ও বনানী এলাকার উচ্চবিত্ত শ্রেণীর বখে যাওয়া তরুণ-তরুণীর মধ্যে ইয়াবা সরবরাহ করতেন। ইয়াবা সরবরাহ করেই তিনি এই সোসাইটির খুব কাছে চলে যান। জিজ্ঞাসাবাদের সময় নাঈমের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছে, সাফাতের সঙ্গে তার কিভাবে পরিচয় হয়েছে।
অপরদিকে, বনানী থানার ওসির কর্তব্যে অবহেলা ও আসামিদের কাছ থেকে ২৫ লাখ টাকা ঘুষ গ্রহণের অভিযোগ তদন্তে গঠিত কমিটি আরো দুই-তিন দিন পর রিপোর্ট জমা দেবে পুলিশ কমিশনারের কাছে। কমিটির প্রধান হিসেবে রয়েছেন ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (অপারেশন অ্যান্ড ক্রাইম) মিজানুর রহমান। ইতিমধ্যে কমিটি বনানী থানার ওসি ফরমান আলীকে কয়েক দফা জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। এই কমিটিও অভিযোগের সত্যতা পেয়েছে। এর মধ্যে একটি কমিটি মামলা নিতে গড়িমশি, প্রাথমিক তদন্তে গাফিলতির অভিযোগ পেয়ে বনানী থানার ওসি ফরমান আলীকে কয়েকদফা জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। বনানী থানার ওসি অভিযোগের মৌখিক ও লিখিত জবাব দিয়েছেন তদন্ত কমিটিকে।
তদন্ত কমিটির প্রধান মিজানুর রহমান বলেন, এ ঘটনায় কারো গাফিলতির প্রমাণ মিললে, কাউকে ছাড় দেয়া হবে না।’
ওই দিন ‘দ্য রেইন ট্রি’ হোটেলে কী ঘটেছিল তার বিবরণ দিয়ে ধর্ষণের কথা স্বীকার করেছেন নাঈম। আলোচিত এ আসামি সাতদিনের রিমান্ডে রয়েছেন।
নাঈমকে জিজ্ঞাসাবাদ করছেন এমন এক পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, ‘‘ওইদিন ‘দ্য হোটেল রেইন ট্রি’র ঘটনা সম্পর্কে নাঈম আশরাফের কাছে জানতে চাওয়া হয়। নাঈম ওই রাতের বিবরণ দিয়েছেন।’’
গোয়েন্দা সূত্র জানায়, ‘‘ধর্ষণের ঘটনার প্রায় দু’সপ্তাহ আগে বন্ধু সাদমানের মাধ্যমে রাজধানীর একটি হোটেলে ওই দুই তরুণীর সঙ্গে তাদের পরিচয় ঘটে। এরপর প্রায়ই তাদের সঙ্গে দেখা হতো। জন্মদিনের অনুষ্ঠানে সাফাত তাদের নিয়ে পার্টি করার কথা বললে পাঁচ আসামি আয়োজনটি করেন। মদ খাওয়ার পর সাফাতকে নিয়ে দুই তরুণীকে ধর্ষণ করার কথা স্বীকার করেছেন নাঈম।’’
‘‘বিনোদন জগতের নামি-দামি মডেলের সঙ্গে কিভাবে পরিচয়’’ গোয়েন্দাদের এমন প্রশ্নে নাঈম জানান, ‘‘ইভেন্ট করতে গিয়েই তাদের সঙ্গে পরিচয় হয়।’’
সূত্র জানায়, ‘‘নানা প্রশ্নের মাঝে সিনে জগতের অনেক নামি-দামি মডেল সম্পর্কে নানা বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন নাঈম। এমনকি সাফাতকে সরবরাহ করা অনেক মডেলের নামও বলেছেন। অনেক মডেলকে সাফাতের শয্যা সঙ্গী করার কথাও স্বীকার করেন নাঈম। ৭ দিনের রিমান্ডে প্রথমদিন শেষ হয়েছে। রিমান্ডের বাকি দিনে আরো চাঞ্চল্যকর অনেক তথ্য পাওয়া যাবে বলে মনে করা হচ্ছে। এছাড়াও আরো কিছু তথ্য পাওয়া গেছে। যেগুলো তদন্তের স্বার্থে এখুনি প্রকাশ করা হচ্ছে না।’’
জানা যায়, ‘সিরাজগঞ্জের কাজীপুরে গ্রামের বাড়িতে নাঈম আশরাফের নাম হালিম। ঢাকায় এসে নিজের নাম পাল্টে হন নাঈম আশরাফ। এই নামে ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট প্রতিষ্ঠান খুলে ব্যবসা চালিয়ে আসছিলেন। চতুর প্রকৃতির নাঈম আশরাফ এ পর্যন্ত দুটি বিয়ে করেছেন। ‘ই-মেকার্স’ নামে একটি ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট প্রতিষ্ঠান খুলে ২০১৪ সালে ভারতের জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী অরিজিৎ সিংয়ের কনসার্টের আয়োজন করেন। এ ছাড়া গত বছর ভারতের আরেক শিল্পী নেহা কাক্কারকে নিয়ে ‘নেহা কাক্কার লাইভ ইন কনসার্ট’ অনুষ্ঠানের আয়োজনও করেন নাঈম আশরাফ। এসব অনুষ্ঠান আয়োজনের কারণে নাঈম আশরাফের সঙ্গে গ্ল্যামার জগতের নায়িকা, গায়িকা, মডেলসহ অনেক প্রভাবশালী ব্যক্তির সখ্য গড়ে ওঠে। তাদের সঙ্গে মাঝে মধ্যেই সেলফি তুলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দিতেন নাঈম আশরাফ।
আলোচিত ধর্ষক নাঈম আশরাফের সঙ্গে ছবি ভাইরালের ঘটনায় মডেল-অভিনেত্রী মৌসুমি হামিদ এক ফেসবুক স্ট্যাটাসে বলেছেন, ‘আমরা যারা মিডিয়াতে কাজ করি, প্রতিনিয়ত আমাদের অনেক কাজের জন্য অনেকে কল দেয়। কথা বলে। দেখা যায় সব কাজ হয় না। কিন্তু পরিচয় হয়। দ্বিতীয়বার কাজের জন্য একই মানুষ যদি কল দেয় বা দেখা করতে আসে তখন যদি সে একটা ছবি তুলতে চায় তখন কি না করা যায়। রেপিস্ট এর কপালে কি লেখা থাকে ও রেপিস্ট?’
গত ২৮ মার্চ রাজধানীর বনানীর ‘দ্য রেইন ট্রি’ হোটেলে আপন জুয়েলার্সের মালিকের ছেলে সাফাত আহমেদের জন্মদিনে যোগ দিয়ে ধর্ষণের শিকার হন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই ছাত্রী। ওই ঘটনার ৪০ দিন পর ৬ মে সন্ধ্যায় বনানী থানায় পাঁচজনকে আসামি করে মামলা করেন ধর্ষিত দুই তরুণীর একজন।
এজাহারভুক্ত পাঁচ আসামি হলেন, সাফাত আহমেদ, সাদমান সাকিফ, নাঈম আশরাফ, সাফাতের গাড়িচালক বিল্লাল ও তার দেহরক্ষী আবুল কালাম আজাদ।
সাফাত-সাদমান সিলেট থেকে, সাফাতের গাড়িচালক বিল্লাল ও তার দেহরক্ষী আবুল কালাম আজাদ গ্রেপ্তার হন ঢাকায়। ১৭ মে বুধবার রাতে ঢাকার মুন্সিগঞ্জের লৌহজংয়ে অভিযান চালিয়ে নাঈম আশরাফ ওরফে নাঈম ওরফে এইচএম হালিমকে গ্রেপ্তার করে পুলিশের বিশেষ টিম ও ডিবি পুলিশের একটি দল। গ্রেপ্তারের পর তাকে ডিবি কার্যালয়ে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেন উইমেন সাপোর্ট অ্যান্ড ইনভেস্টিগেশনের তদন্ত কর্মকর্তারা। জিজ্ঞাসাবাদে নাঈম ধর্ষণের বিষয়টি স্বীকার করেছেন।
Posted ২:০৪ পূর্বাহ্ণ | শনিবার, ২০ মে ২০১৭
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta