কক্সবাংলা ডটকম(৩ জুলাই) :: বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে ফিরিয়ে দিতে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করে দেওয়া হাইকোর্টের রায় বহাল রেখেছেন আপিল বিভাগ। এর ফলে এখন থেকে উচ্চ আদালতের বিচারকদের যে কোনও অসদাচরণের তদন্তের ক্ষমতা সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের হাতে ফিরে গেল বলে জানিয়েছেন রিটকারী পক্ষের আইনজীবী মনজিল মোরশেদ।
যদিও রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা মাহবুবে আলম বলেছেন, ‘সেই সুযোগ নেই। যে সংবিধান সংসদ বাতিল করেছে সেটা আপনা-আপনি পুনর্বহাল হওয়ার প্রশ্ন ওঠে না।’ আর আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলছেন, ‘ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের ফলে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল পুনর্বহাল হয়নি, পূর্ণাঙ্গ রায় পেয়ে করণীয় নির্ধারণ করা হবে।’
আজ সোমবার (৩ জুলাই) ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করে দেওয়া হাইকোর্টের রায় বহাল রেখে রাষ্ট্রপক্ষের আপিল সর্বসম্মতক্রমে বাতিল করে দিয়েছেন আপিল বিভাগ।
সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল কী?
বিচারকরা যদি সংবিধান লঙ্ঘন করেন কিংবা গুরুতর অসদাচরণের দায়ে অভিযুক্ত হন, সে ক্ষেত্রে তাদের অপসারণের জন্য সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল কর্তৃক তদন্ত করা হবে। সুপ্রিম কোর্টের প্রধান ও জ্যেষ্ঠ বিচারকদের সমন্বয়ে গঠিত এ কাউন্সিল বিচারকদের আচরণবিধিও নির্ধারণের কাজ করবে। বাংলাদেশ সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদের ৩ নম্বর দফায় বলা আছে, ‘‘একটি সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল থাকবে যা এই অনুচ্ছেদে ‘কাউন্সিল’ বলে উল্লিখিত হবে এবং বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি এবং অন্যান্য বিচারকের মধ্যে পরবর্তী যে দুজন কর্মে প্রবীণ তাদের নিয়ে গঠিত হবে।
এই পদ্ধতিতে শর্ত থাকে যে, কাউন্সিল যদি কোনও সময় কাউন্সিলের সদস্য এরকম কোনও বিচারকের সামর্থ্য বা আচরণ সম্পর্কে তদন্ত করেন, অথবা কাউন্সিলের কোনও সদস্য যদি অনুপস্থিত থাকেন, অথবা অসুস্থতা কিংবা অন্য কোনও কারণে কাজ করতে অসমর্থ হন, তাহলে কাউন্সিলের যারা সদস্য আছেন, তাদের মধ্যে পরবর্তী যে বিচারক কর্মে প্রবীণ তিনিই অনুরূপ সদস্য হিসেবে কাজ করবেন।’’
সোমবারের আদেশের মধ্য দিয়ে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল পুনর্বহাল হয়েছে বলে রিটকারী আইনজীবীর বক্তব্যের বিষয়ে জানতে চাইলে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, ‘ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের ফলে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল পুনর্বহাল হয়নি।’
তিনি আরও বলেন, ‘বিচারপতিদের অপসারণে সামরিক সরকারের করা সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলকে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনার সঙ্গে আদালত কেন সাংঘর্ষিক মনে করছেন না, তা আমার বোধগম্য নয়। বিচারপতি অপসারণের বিষয়ে সংসদের হাতে যে ক্ষমতা ছিল সেটি ১৯৭২ সালের মূল সংবিধানের অন্তর্ভুক্ত।’
যেভাবে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠিত হয়েছিল
১৯৭২ সালের সংবিধানে ৯৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী অদক্ষতা, অযোগ্যতা, দুর্নীতিসহ অসদাচরণের কারণে বিচারপতিদের অভিশংসনের ক্ষমতা জাতীয় সংসদের হাতে ছিল। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সময় সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির হাতে ন্যস্ত করা হয়। ১৯৭৮ সালে সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান এক সামরিক ফরমানে বিচারপতিদের অপসারণে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা বাতিল করেন।এ সময় বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা দেওয়া হয় সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের কাছে।
সংবিধানের অনুচ্ছেদ নং ৯৬(২)-এর বিধানে উল্লেখ ছিল, ‘প্রমাণিত অসদাচরণ বা অসামর্থ্যের কারণে সংসদের মোট সদস্য সংখ্যার অন্যূন দুই-তৃতীয়াংশ গরিষ্ঠতার দ্বারা সমর্থিত সংসদের প্রস্তাবক্রমে প্রদত্ত রাষ্ট্রপতির আদেশ ব্যতীত কোনও বিচারককে অপসারিত করা যাবে না।’
১৯৭২ সালে যারা সংবিধান প্রণয়নের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন তাদেরই কেউ কেউ আদালতের বন্ধু হিসেবে ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণার পক্ষে কথা বলেছেন। কেন এই পরিবর্তন জানতে চাইলে ব্যারিস্টার আমির উল ইসলাম বলেন, ‘আমি আদালতের কাছেই বলেছি। ১৯৭২ সালে জুডিশিয়ারি প্রস্তুত ছিল না। অনেক দেশই সংসদের মাধ্যমে অপসারণের পদ্ধতির চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছে। সেই উদাহরণগুলো আদালতকে জানানো হয়েছিল।’
যদিও রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন কর্মকর্তা বলেছেন, ‘ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের ফলে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল পুনরুজ্জীবিত হয় না। বরং এখন বিচারপতিদের অপসারণ পদ্ধতিতে শূন্যতা তৈরি হলো।’ষোড়শ সংশোধনীর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে করা রিটকারীদের পক্ষের আইনজীবী মনজিল মোরশেদ বলছেন, ‘এ বিষয়ে রায়ে কোনও নির্দেশনা দেওয়ার বা কিছু বলার অপেক্ষা রাখে না। কারণ, আমরা ষোড়শ সংশোধনীর বিরুদ্ধে আদালতে গিয়েছি। সেটি বাতিল হওয়ায় স্বয়ংক্রিয়ভাবেই আগেরটি কার্যকর হয়ে যাবে ।’
সোমবারের রায়ের মধ্যদিয়ে বিচার বিভাগের জন্য নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হলো বলে মনে করেন রিটকারীদের পক্ষের আইনজীবী মনজিল মোরশেদ। তিনি বলেন,‘যদি বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে থাকতো, তাহলে বিচার বিভাগ স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারতো না বলেই এই সংশোধনী চ্যালেঞ্জ করা হয়েছে।’ এ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণার মধ্যদিয়ে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল বহাল হয়েছে বলেই মত দিয়েছেন মামলার আইনজীবী মনজিল মোরশেদ।
এ রায়ের মধ্যদিয়ে সংসদ ও বিচার বিভাগের মধ্যে কোনও দ্বন্দ্ব তৈরি হলো কিনা প্রশ্নে এই আইনজীবী বলেন, ‘যে কোনও আদালতের বিষয়ে দ্বন্দ্ব হলে আপিল বিভাগের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত, এটি সংবিধানই বলে দিয়েছে। সেখানে বিরোধের কোনও সুযোগ নেই। বরং যে বিরোধ ছিল সেটি সুরাহা হলো।’
সংসদ সার্বভৌম এই কথাটি কার্যকর থাকছে কিনা, এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এ কথাটি সঠিক নয়। এ বিষয়ে অ্যামিকাস কিউরিরা বিস্তারিত বলেছেন। বিচার বিভাগ বা সংসদ উভয়েই সংবিধানের অধীনে কাজ করে। বরং আর্টিকেল ৭ -এ বলা আছে, জনগণ সার্বভৌম এবং এই ক্ষমতা বলে প্রতিনিধিরা সেই ক্ষমতা প্রয়োগ করেন।’
এই সংশোধনী বাতিল হওয়ায় আগেরটা বহাল হয়ে যাবে বলে রিটকারী আইনজীবী মনজিল মোরশেদ যে বক্তব্য দিয়েছেন, তার বিপরীতে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, ‘এটি কোনোভাবেই পুনঃস্থাপিত হয়ে যাওয়ার কথা নয়। আমার মতে, যে সংবিধান সংসদ বাতিল করেছে সেটা আপনা-আপনি পুনর্বহাল হওয়ার প্রশ্ন ওঠে না। বর্তমানে শূন্যতা বিরাজ করছে।’ তিনি হতাশা ব্যক্ত করে বলেন, আমাদের যে আশা ছিল ও স্বপ্ন ছিল সংবিধানের মূল অনুচ্ছেদ ৯৬ তে ফিরে যাবো, আজকে এই রায়ের ফলে সেটা আর হলো না।’
Posted ৭:৩১ অপরাহ্ণ | সোমবার, ০৩ জুলাই ২০১৭
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta