কক্সবাংলা ডটকম(১ জানুয়ারি) :: পুঁজিবাজারের বিনিয়োগকারীদের জন্য বিদায়ী বছর তেমন কোনো লাভের মুখ দেখাতে পারেনি। দেশের শেয়ারবাজারের প্রধান সূচকগুলো ছিল নিম্নমুখী।
প্রতিদিনের লেনদেনেও তেমন কোনো প্রবৃদ্ধি ছিল না। লাভ করার মতো কোনো ভালো প্রতিষ্ঠানও পুঁজিবাজারে আসেনি এ বছর।
গত এক বছরে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) প্রধান সূচক ডিএসইএক্স কমেছে ১৬ শতাংশ। একই সময়ে ভালো প্রতিষ্ঠানগুলোর সূচক ডিএস৩০ কমেছে সাত শতাংশ।
২০২৩ সালটি ছিল এমন যে পুঁজিবাজারে সূচক একই জায়গায় আটকে ছিল। ফ্লোর প্রাইস আরোপের কারণে বাজার নিষ্প্রাণ হয়ে পড়ে।
২০২২ সালে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) পুঁজিবাজারে পতন থামাতে প্রতিটি শেয়ারের জন্য ফ্লোর প্রাইস বেধে দেয়। এই নিয়মে শেয়ারের সর্বনিম্ন দাম ধরে দেওয়া হয়।
করোনা মহামারি ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সৃষ্ট অনিশ্চয়তার মধ্যে এটি করা হয়েছিল।
সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করার পর বিএসইসির গুরুত্বপূর্ণ পদে রদবদল হলে ফ্লোর প্রাইস তুলে দেওয়া হয়। এতে অন্তত পুঁজিবাজার নিষ্প্রাণ অবস্থা থেকে ফিরে এসেছে।
এদিকে দীর্ঘদিন পর ফ্লোর প্রাইস তুলে দেওয়ার পর সূচক কমলেও ডিএসইর দৈনিক গড় লেনদেন এ বছর পাঁচ শতাংশ বেড়ে ৬৩২ কোটি টাকা হয়।
অপরদিকে ২০২৪ সালে দেশের শেয়ারবাজারে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বেনিফিশিয়ারি ওনার্স বা বিও অ্যাকাউন্ট কমেছে ৯০ হাজার ৭৫৩টি।
কমার সংখ্যা ২০২৩ সালের তুলনায়ও ২ হাজার ৬৫৬টি বেশি।
সার্বিক হিসাবে বছর শেষে ২০২৩ সালের তুলনায় বিও অ্যাকাউন্ট সংখ্যা কমে নেমেছে ১৬ লাখ ৮২ হাজার ৪৫১টিতে।
কেন্দ্রীয় ইলেকট্রনিক শেয়ার সংরক্ষণকারী প্রতিষ্ঠান সেন্ট্রাল ডিপোজিটরি বাংলাদেশ লিমিটেড (সিডিবিএল) প্রকাশিত তথ্য পর্যালোচনায় এমন চিত্র পাওয়া গেছে।
শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করতে অনুমোদিত ব্রোকারেজ হাউস বা মার্চেন্ট ব্যাংকের মাধ্যমে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের অ্যাকাউন্ট খুলতে হয়। এই অ্যাকাউন্টই বিও অ্যাকাউন্ট নামে পরিচিত।
২০০০ সালের আগস্টে সিডিবিএল কার্যক্রম শুরু করে।
২০০৪ সালে প্রথমবারের মতো বিও অ্যাকাউন্ট সংখ্যা ১ লাখ এবং ২০০৭ সালে ১০ লাখের মাইলফলক অতিক্রম করে।
সিডিবিএল প্রকাশিত বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত জুন পর্যন্ত ৭৯ লাখ ২ হাজার ৪৫৪টি বিও অ্যাকাউন্ট খোলা হয়েছে।
২০১৫ সালের জুন শেষে সর্বাধিক ৩১ লাখ ৯৫ হাজার ৮৫২টি অ্যাকাউন্ট সক্রিয় ছিল।
সিডিবিএল সূত্রে পাওয়া গত কয়েক বছরের বিও অ্যাকাউন্টের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, অর্থবছর শেষ হওয়ার প্রেক্ষাপটে প্রতিবছর জুন ও জুলাই মাসেই সবচেয়ে বেশি বিও অ্যাকাউন্ট বন্ধ হয়।
২০২৪ সালের ওই দুই মাসে ১ লাখ ২৩ হাজার ৩১৫টি বিও অ্যাকাউন্ট বন্ধ হয়। গত তিন বছরের মধ্যে এবার বন্ধ হয়েছে তুলনামূলক কম।
২০২৩ সালের জুন ও জুলাই মাসে ১ লাখ ২৯ হাজার ৬৬২টি বিও অ্যাকাউন্ট বন্ধ হয়। ২০২২ সালের একই সময়ে বন্ধ হয়েছিল ২ লাখ ৪৭ হাজার ১৯৬টি।
পর্যালোচনায় দেখা গেছে, শেয়ারবাজারে দর পতনের পাশাপাশি আইপিও আবেদনের ধরন বদলানোর পর ক্রমে বিও অ্যাকাউন্ট কমছে।
গত বছরে কমার প্রধান কারণ ছিল দর পতন। অব্যাহত দর পতনে বড় লোকসানের পর অনেকে সব শেয়ার বিক্রি করে বাজার ছেড়েছেন।
বিও অ্যাকাউন্টের সংখ্যা কমার ধারা গত আগস্ট পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। গত ২৯ আগস্ট বিও অ্যাকাউন্টের সংখ্যা কমে ১৬ লাখ ৬৬ হাজার ৮৬৮টিতে নামে।
এরপর শেষ চার মাসে ১৫ হাজার ৫৮৩টি বিও অ্যাকাউন্ট নতুন করে বাড়ে।
অবশ্য অ্যাকাউন্ট সক্রিয়, তবে একটিও শেয়ার নেই– এমন বিও অ্যাকাউন্ট সংখ্যা ৩৩ হাজার ৮০২টি বেড়ে ৩ লাখ ৪৩ হাজার ৯৭৪টিতে উন্নীত হয়েছে।
বলার অপেক্ষা রাখে না, নতুন খোলা কিছু বিও অ্যাকাউন্টের বাইরে পুরোনো অ্যাকাউন্ট থেকে সমুদয় শেয়ার বিক্রি করে দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে।
পর্যালোচনায় আরও দেখা গেছে, গত বছর বিও অ্যাকাউন্ট কমার প্রবণতা ব্যক্তির যৌথ অ্যাকাউন্টের ক্ষেত্রে বেশি দেখা গেছে।
সংখ্যা বিবেচনায় পুরুষ বিনিয়োগকারীদের অ্যাকাউন্ট বেশি কমলেও শতাংশ বিবেচনায় বেশি কমেছে নারীদের অ্যাকাউন্ট।
তবে অন্যান্য বছরের মতো প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের অ্যাকাউন্ট বেড়েছে। বৃদ্ধির হার আগের বছরের চেয়ে কমেছে। একক অ্যাকাউন্ট কমেছে ৪৩ হাজার ৩১২টি। যৌথ অ্যাকাউন্ট কমেছে ৪৭ হাজার ৮৪০টি।
ব্যক্তি বিও অ্যাকাউন্টের মধ্যে ২০২৩ সালের তুলনায় ২০২৪ সালে পুরুষ বিনিয়োগকারীদের অ্যাকাউন্ট ৬৫ হাজার ৫১০টি কমে ১২ লাখ ৬১ হাজার ১৯৮টিতে নেমেছে। আগের বছরের তুলনায় তাদের অ্যাকাউন্ট সংখ্যা কমেছে ৪ দশমিক ৯৪ শতাংশ।
অন্যদিকে নারীদের অ্যাকাউন্ট সংখ্যা ২৫ হাজার ৬৪২টি কমে নেমেছে ৪ লাখ ২৯ হাজার ৩৯৬টিতে, যা আগের বছরের তুলনায় ৫ দশমিক ৯৭ শতাংশ কম।
অন্য এক পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ব্যক্তি অ্যাকাউন্টের মধ্যে দেশীয় বিনিয়োগকারীদের অ্যাকাউন্ট কমেছে ৮২ হাজার ৪৯৫টি। ২০২৪ সালের শেষে এ ধরনের অ্যাকাউন্টের সংখ্যা ১১ লাখ ৯৯ হাজার ৩৯৭টি। একই সময়ে প্রবাসীদের অ্যাকাউন্ট ৮ হাজার ৬৫৭টি কমে ৪৬ হাজার ৬৯১টিতে নেমেছে।
এদিকে গত বছর প্রাতিষ্ঠানিক বিও অ্যাকাউন্ট সংখ্যা ৩৬৭টি বেড়ে ১৫ হাজার ৫৬৪টিতে উন্নীত হয়েছে। ২০২৩ সালে ৩৯৬টি অ্যাকাউন্ট বেড়েছিল। ২০২২ সালে বেড়েছিল ৯০৬টি।
২০২২ সালের তুলনায় সর্বশেষ দুই বছরে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীর সংখ্যা বৃদ্ধির হার তুলনামূলক কমেছে। তবে এখনও ইতিবাচক ধারায় আছে।
ডিএসই ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ডিবিএ) সভাপতি সাইফুল ইসলাম একে ‘অত্যন্ত হতাশার বছর’ বলে আখ্যা দিয়েছেন।
তার মতে, বছরের প্রথম তিন মাস ফ্লোর প্রাইস ছিল। এটি বাজার ও বিনিয়োগকারীদের ক্ষতি করেছে।
এরপর চরম বিতর্কিত জাতীয় সংসদ নির্বাচন হওয়ায় নির্বাচন পরবর্তীতে সাধারণত পুঁজিবাজারের বিনিয়োগকারীরা যেসব সুফল দেখতে পায়, তা এবার পায়নি।
সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘গণঅভ্যুত্থানের পর বাজার কিছুটা গতি পায়। কিন্তু, দুর্ভাগ্যজনক হচ্ছে সেটি স্থায়ী হয়নি।’
অন্তর্বর্তী সরকার যদি বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফেরাতে চায় তাহলে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। ভালো প্রতিষ্ঠানগুলোকে পুঁজিবাজারে আনতে হবে।
‘এটি পুঁজিবাজারের প্রধান সমস্যা। এখানে বিনিয়োগ করার মতো যোগ্য প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা কম।’
তিনি মনে করেন, শুধু নীতিগত সংস্কার দেখলে বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরবে না। বরং ভালো প্রতিষ্ঠানগুলোই বাজার চাঙ্গা করতে পারে।
‘সরকারের কার্যক্রম এমন হতে হবে, যাতে পুঁজিবাজার সম্পর্কে মানুষের ধারণার পরিবর্তন হয়।’
২০২৪ সালে এসএমই মার্কেটে দৈনিক গড় লেনদেন প্রায় দ্বিগুণ হয়ে ১৫ কোটি টাকা হয়েছে। একই বছর ট্রেজারি বন্ডের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় বিকল্প ট্রেডিং বোর্ডেও লেনদেন বেড়েছে।
দরপতনের সঙ্গে সঙ্গে বাজারের মূল্য-আয় অনুপাত (যা শেয়ারপ্রতি আয়ের তুলনায় বর্তমান শেয়ারের দাম পরিমাপ করে) দাঁড়িয়েছে সাড়ে নয় শতাংশ। আগের বছর তা ছিল ১৩ দশমিক ১২ শতাংশ।
এটি ইঙ্গিত দেয় যে পুঁজিবাজারে ভালো শেয়ারগুলোয় বিনিয়োগ করা হলে তা যথেষ্ট লাভজনক।
Posted ২:০৩ পূর্বাহ্ণ | বুধবার, ০১ জানুয়ারি ২০২৫
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta