কক্সবাংলা ডটকম(২ জানুয়ারি) :: আগামী বছর থেকে অর্থাৎ ২০২৬ সাল থেকে আবারো পড়াশোনায় পরিবর্তনের পরিকল্পনা করছে সরকার। এই পরিবর্তনের ফলে প্রাথমিক স্তরে চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রমের আলোকে নতুন পাঠ্যবই পড়তে হবে।
অপরদিকে ফিরে আসার এক বছরের মাথায় আবার নবম শ্রেণিতে বিভাগ বিভাজন উঠিয়ে দেয়ার পরিকল্পনা করা হচ্ছে। নতুন করে পড় শোনায় পরিবর্তনের কথা শুনে শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও অভিভাবকরা বুঝতে পারছেন না, কীভাবে পড়াশোনা হবে? সংশ্লিষ্ট সূত্রে এমন আভাস পাওয়া গেছে।
প্রসঙ্গত, আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে ২০২৩ সালে ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে বাস্তবায়ন শুরু হয়েছিল নতুন শিক্ষাক্রম। ২০২৪ সাল থেকে বিভাগ বিভাজন উঠিয়ে দিয়ে নবম শ্রেণিতে ওই শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন শুরু হয়। তারপর থেকে শিক্ষাক্রম নিয়ে অভিভাবকদের মধ্যে তুমুল সমালোচনা শুরু হয়; যার একটি অংশ বিভাগ বিভাজন উঠিয়ে দেয়ার বিরুদ্ধেও কথা বলেছিলেন।
নোবেল বিজয়ী মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হওয়ার পর গত ১ সেপ্টেম্বর নতুন শিক্ষাক্রম ‘বাস্তবায়ন যোগ্য’ নয় বলে ঘোষণা দিয়ে নবম শ্রেণিতে বিভাগ বিভাজন ফিরিয়ে আনার সিদ্ধান্ত জানায় শিক্ষা মন্ত্রণালয়। একই সঙ্গে নতুন শিক্ষাক্রম বাতিল করে ফিরিয়ে নিয়ে আসে ২০১২ সালের শিক্ষাক্রম।
সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, ২০২৫ সালে নবম শ্রেণিতে বিভাগ বিভাজন ফিরেছে। বিভাজন ছাড়া যেসব শিক্ষার্থী সদ্য সমাপ্ত ২০২৪ সালে নবম শ্রেণিতে পড়েছিলেন তারাও নতুন বছরে বিজ্ঞান, মানবিক ও ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগে বিভাজিত হয়ে দশম শ্রেণিতে পড়বেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) গত বছরের নভেম্বরের মাঝামাঝি সময় থেকে অনেকটা নীরবে পড়াশোনায় নতুন করে পরিবর্তনের কাজ শুরু করে।
এরই মধ্যে গত বুধবার চলতি বছরের পাঠ্যবইয়ের অনলাইন সংস্করণের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে মাধ্যমিক পর্যায়ে বিভাগ বিভাজন ফিরে আসার পর তা আবার উঠিয়ে দেয়ার কথা আলোচনায় এনেছেন শিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ। আগামী বছর থেকে এই পরিবর্তন হলে নবম শ্রেণির সব শিক্ষার্থীকে অন্তত ১০টি বিষয় পড়তে হবে।
এর মধ্যে আবশ্যিকভাবে ৬টি এবং বাকি ৪টি ঐচ্ছিক বিষয় হিসেবে পড়বে। ঐচ্ছিক বিষয়ের জন্য ‘গুচ্ছ’ হিসেবে অপশন থাকবে। সেই অপশন থেকে পছন্দমতো চারটি বিষয় বেছে নিতে পারবে।
অর্থাৎ নবম শ্রেণিতে একজন শিক্ষার্থী চাইলে ঐচ্ছিক বিষয় হিসেবে পদার্থ বিজ্ঞানের সঙ্গে যেমন অর্থনীতিও পড়তে পারবে তেমনি জীব বিজ্ঞানের সঙ্গে ব্যাংকিং বিষয়ও পড়তে পারবে। অপরদিকে প্রাথমিক স্তরে নতুন শিক্ষাক্রমে এবার তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত নতুন পাঠ্যবই দেয়া হয়েছে। ২০২৬ সালে চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণিতে নতুন পাঠ্যবই দেয়া হবে।
জানতে চাইলে এনসিটিবির চেয়ারম্যান অধ্যাপক এ কে এম রিয়াজুল হাসান বলেন, ২০২৬ সালের পাঠ্যবই এবং পড়াশোনা নিয়ে কাজ শুরু হয়েছে। তার মতে, আগামী বছর থেকে নবম শ্রেণিতে বিভাগ বিভাজন না রাখার আলোচনা চলছে।
যদি এটি চূড়ান্ত হয় তাহলে একজন শিক্ষার্থীকে বাংলা, গণিত, ধর্ম, ইতিহাস ও বিশ্বপরিচয়, ইংরেজি ও সাধারণ বিজ্ঞানের মতো ৬টি বিষয়কে আবশ্যিকভাবে পড়তে হবে। এই ৬ বিষয়ের সঙ্গে পছন্দমতো চারটি বিষয় ঐচ্ছিকভাবে পড়বে। সেক্ষেত্রে একজন শিক্ষার্থী উচ্চতর গণিত, পদার্থ ও অর্থনীতির মতো বিষয়কেও একসঙ্গে বাছাই করতে পারবে। আবার পদার্থ, রসায়ন এবং জীববিজ্ঞানের মতো বিষয়কেও বাছাই করতে পারবে।
তবে সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, শিক্ষা ব্যবস্থায় নতুন কোনো পদ্ধতি যুক্ত করার পর শিক্ষার্থী ও শিক্ষকরা যখন অভ্যস্থ হতে শুরু করেন তখনই আবার পরিবর্তন শুরু হয়। ঘন ঘন পরিবর্তনের প্রভাব পড়ছে শিক্ষার্থীদের ওপর। বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থায় শিক্ষার্থীদের গিনিপিগ বানানো হচ্ছে। নতুন নতুন পদ্ধতির সঙ্গে মানিয়ে নিতে হচ্ছে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের। শিক্ষার মান নিয়ে প্রশ্ন উঠছে বারবার।
তাদের মতে, স্বাধীনতার সাড়ে ৫ দশক সময় পার হলেও দেশের শিক্ষাক্রম কী হবে- তা এখনো দেশের বাস্তবতার নিরিখে সুনির্দিষ্টভাবে নির্ধারণ হয়নি। শিক্ষা ব্যবস্থাকে যুগোপযোগী করতে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ছাড়াই ঘন ঘন শিক্ষাক্রম পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে শিক্ষার্থীদের ওপর।
একটি নতুন শিক্ষাক্রমে অভ্যস্ত হতে শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের অনেক সময় চলে যায়। এভাবে একের পর এক নতুন শিক্ষাক্রমের সঙ্গে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের বাধ্য হয়ে মানিয়ে নিতে হচ্ছে। তারা বলেন, স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে খ্যাতনামা শিক্ষাবিদ ও বিজ্ঞানী কুদরাত-ই-খুদাকে প্রধান করে দেশে প্রথম শিক্ষা কমিশন গঠন করেছিল। কমিশন প্রতিবেদন জমা দিলেও ওই শিক্ষানীতি বাস্তবায়িত হয়নি। এরপর নানা সরকারের সময় সব মিলিয়ে কমপক্ষে আটটি শিক্ষা কমিশন ও কমিটি হলেও কোনোটিই আলোর মুখ
দেখেনি। সাবেক রাষ্ট্রপতি এইচ এম এরশাদ আমলে মজিদ খান শিক্ষা কমিশন, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ১৯৯৭ সালে শামসুল হক শিক্ষা কমিশন, বিএনপি সরকারের আমলে ২০০২ সালে এম এ বারী কমিশন ও ২০০৩ সালে মনিরুজ্জামান মিঞা কমিশন গঠন করা হয়। সবশেষ ২০০৯ সালের ৮ এপ্রিল জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরীর (বর্তমানে প্রয়াত) নেতৃত্বে সবশেষ শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটি হয়।
২০১০ সালের মে মাসে কমিটির সুপারিশ করা শিক্ষানীতি মন্ত্রিসভায় অনুমোদিত হয়। এ শিক্ষানীতির বেশকিছু সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হলেও অনেক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত এখনো বাস্তবায়ন হয়নি। এখন আবার নতুন করে পরিবর্তনের কথা ভাবা হচ্ছে।
জানতে চাইলে শিক্ষা গবেষক রাখাল রাহা বলেন, বর্তমানের পাঠ্যবই, প্রশ্নপদ্ধতি এবং মূল্যায়ন পদ্ধতিতে বড় ধরনের পরিবর্তন না হলে ২০২৬ সাল থেকে যে পরিবর্তনের কথা বলা হচ্ছে; তাতে কোনো সমস্যা হওয়ার কথা নয়। তিনি বলেন, বিভাগ বিভাজন উঠিয়ে দিলেও ঐচ্ছিক বিষয় নেয়ার জন্য পছন্দসই অথবা গুচ্ছভিত্তিক বিষয় নেয়ার সুবিধা থাকলে নতুন পরিবর্তনে ঝাঁকুনি হবে না। তবে পরিবর্তন করার আগে নতুন পদ্ধতির জন্য রুটিন, প্রয়োজনীয় শিক্ষক প্রস্তুত করা এবং অবকাঠামোগত উন্নয়নসহ বাজেটের মতো বিষয়ে পূর্ব প্রস্তুতি না থাকলে খুব একটা সুবিধা পাওয়া যাবে না বলে তিনি মনে করেন।
এনসিটিবি সূত্র জানিয়েছে, বর্তমানে পড়াশোনা বৃটিশদের দেখানো পথ ধরেই চলছে। অথচ সেই বৃটিশরা পড়াশোনায় বহু পরিবর্তন এনে প্রায় সব কিছু ‘ওপেন’ করে দিয়েছে। যারা ‘ও’ এবং ‘এ’ লেভেলে পড়াশোনা করেন তারা বৃটিশদের নতুন পদ্ধতিতেই মেনে নিয়ে পড়াশোনা করছেন। অপরদিকে দেশের সাধারণ শিক্ষার্থীরা এখনো পুরনো পদ্ধতিতেই রয়ে গেছেন। এখন নতুন পদ্ধতি বাস্তবায়ন করতে গেলেও নানা সংকট দেখা দেবে। বিশেষ করে শিক্ষক সংকট ভয়াবহ আকার ধারণ করবে। পাশাপাশি পর্যাপ্ত বাজেটও লাগবে।
তবে শিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, নবম শ্রেণিতে মানবিক, ব্যবসা ও বিজ্ঞান বিভাজন উঠিয়ে দিলে মানবিক শাখায় যে শিক্ষার্থী আছে, সেও ইচ্ছা করলে বিজ্ঞান নিতে পারে যাতে ভবিষ্যতে সে যে কোনো কিছু হতে পারবে। তিনি বলেন, নবম ও দশম শ্রেণিতে আমরা উচ্চতর গণিত ও উচ্চতর বিজ্ঞান রাখছি, কিন্তু সবচেয়ে ভালো হয়, এবার তো পারলাম না; কিছু বিষয় আবশ্যিক রেখে, অনেক বিষয়, যেগুলোকে আমরা বিজ্ঞান শাখা বলছি, মানবিক শাখা বা বাণিজ্যিক শাখা বলছি; এ শাখাগুলোকে তুলে দেয়া যায়। তবে এটারও সমালোচনা হবে।
তিনি বলেন, এতগুলো বিষয় আছে যার সব ঐচ্ছিক করে দিলে রুটিনে সমস্যা হবে; আর আমাদের স্কুল ঘরের সংকট হবে- এই কারণে এবার করা যায়নি। তবে আগামীতে এটি সম্ভব; বইগুলো আরো কম করে দেয়া যাবে। বিজ্ঞানের চারটা-পাঁচটা বইয়ের বদলে আরো দুটো বই কম করে দেয়া যাবে। তবে উচ্চতর গণিত রাখতেই হবে, এটি আমার নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলছি। বিষয়গুলো আরো কমিয়ে নিতে পারলে বিজ্ঞান গণিতও পড়া হবে, কিছুটা বাণিজ্যও পড়া হবে। এটি আমাদের পরবর্তী লক্ষ্য। কিন্তু এসবে যেন ধারাবাহিকতা নষ্ট না হয়।
সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, ১৯৭৭ সালে প্রথম শিক্ষাক্রম প্রণয়নের পর ১৯৮৬ সালে পাঠ্যবইয়ে পরিমার্জন করা হয়। ১৯৯২ সালে প্রাথমিক স্তরে যোগ্যতাভিত্তিক শিক্ষাক্রমে রূপান্তর করা হয়, ১৯৯৫ সালে মাধ্যমিক স্তরে উদ্দেশ্যভিত্তিক শিক্ষাক্রমে পরিবর্তন করা হয়। পরে ২০০২ সালে প্রাথমিক শিক্ষাক্রমের কিছু পাঠ্যবইয়ের পরিমার্জন করা হয়। এরপর ২০১২ সালে সৃজনশীল পদ্ধতি চালু করা হয়। এরপর থেকে এইচএসসি পর্যন্ত সব বিষয়ে সৃজনশীল প্রশ্নপত্রে পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। ২০২৬ সাল থেকে প্রাথমিকে পাঠ্যবইয়ের পরিবর্তন এবং নবম শ্রেণি থেকে বিভাগ বিভাজন উঠিয়ে দেয়ার কথা বলা হলেও মূল্যায়ন পদ্ধতির পরিবর্তনের বিষয়ে কিছু বলা হয়নি।
Posted ১:৪১ পূর্বাহ্ণ | শুক্রবার, ০৩ জানুয়ারি ২০২৫
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta