কক্সবাংলা ডটকম(১ ডিসেম্বর) :: সৌদি আরবে বছর পাঁচেক কাজ করেছেন সোনিয়া বেগমের (ছদ্মনাম) স্বামী। দুই বছর আগে তিনি দেশে ফিরে আসেন এবং কয়েক নি পরই অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাকে হাসপাতালে নেওয়ার পর রক্ত পরীক্ষায় এইডস ধরা পড়ে। কিছুদিন পর সোনিয়া বেগমও অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন। পরীক্ষার পর তার দেহেও ধরা পড়ে এইচআইভির সংক্রমণ। এ ঘটনায় পুরো পরিবারটি ভেঙে পড়ে। আত্মীয়স্বজনও তাদের এড়িয়ে চলেন। গত বছর সোনিয়ার স্বামীর মৃত্যু হলে ছেলেমেয়ে নিয়ে অসহায় হয়ে পড়েন তিনি। সোনিয়া এখন আশার আলো সোসাইটির মাধ্যমে চিকিৎসা নিচ্ছেন।
সম্প্রতি আশার আলো সোসাইটিতে তার সঙ্গে কথা হয় এ প্রতিবেদকের। সোনিয়ার মতো চিকিৎসা নিতে আসা দু’জন এইচআইভি আক্রান্তের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিদেশে কয়েক বছর চাকরি করেছেন তারা। এরে একজন বিদেশে থাকাকালে এবং আরেকজন দেশে ফিরে পরীক্ষা করে এইচআইভি সংক্রমণের কথা জানতে পারেন।
এভাবেই অভিবাসনের মাধ্যমে দেশে এইচআইভি/এইডস ছড়িয়ে পড়ছে। তথ্য-উপাত্ত বিশ্নেষণে দেখা গেছে, এইচআইভি আক্রান্তদের ৩০ শতাংশেরও বেশি অভিবাসী অথবা তাদের পরিবারের সদস্য। অনিরাপদ যৌন সম্পর্ক, একই সুচ ব্যবহার করে শিরায় মাদক গ্রহণসহ বিভিন্ন মাধ্যমে এইডস সংক্রমণ হলেও অভিবাসনের মাধ্যমে সংক্রমণের ঘটনা নতুন করে উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আন্তর্জাতিক সংস্থা সেভ দ্য চিলড্রেনও অভিবাসনের মাধ্যমে বাংলাদেশে এইডস সংক্রমণের হার বাড়ছে বলে জানিয়েছে।
সংস্থাটির কর্মকর্তারা বলছেন, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কাজের সন্ধানে যাওয়া ব্যক্তিরে মাধ্যমে বাংলাদেশে এইডস ছড়িয়ে পড়ছে। এ প্রেক্ষাপটে আন্তর্জাতিক ও সরকারি-বেসরকারি অর্থায়ন বাড়ানোর মাধ্যমে দেশে এইডস আক্রান্তের ঝুঁকি হ্রাসের পাশাপাশি চিকিৎসা নিশ্চিত করার পরামর্শ দিয়েছেন তারা।
সেভ দ্য চিলড্রেনের কর্মকর্তা শেখ মাসুল আলম বলেন, বিদেশে কাজ করতে যাওয়া মানুষের মধ্যে ৩০ শতাংশেরও বেশি এইচআইভি/এইডস ছড়াচ্ছে। আক্রান্তদের মধ্যে অন্তত ৫০ শতাংশকে সেবার আওতায় আনার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হলেও তা সম্ভব হয়নি।
এ অবস্থায় রবিবার পালিত হচ্ছে বিশ্ব এইডস দিবস। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর আজ দেশে এইচআইভি/এইডস সংক্রমণের নতুন বার্ষিক তথ্য প্রকাশ করবে। এবার দিবসটির প্রতিপাদ্য ‘এইডস নির্মূলে প্রয়োজন জনগণের অংশগ্রহণ’। দিবসটি উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পৃথক বাণী দিয়েছেন।
এইডস পরিস্থিতি : স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জাতীয় এইডস/এসটিডি প্রোগ্রামের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, দেশে মোট জনগোষ্ঠীর মধ্যে এইচআইভি সংক্রমণের হার শূন্য শমিক ১ শতাংশের নিচে। দেশে প্রথম ১৯৮৯ সালে এইচআইভি রোগী শনাক্ত হয়। সেই থেকে গত বছরের ৩০ অক্টোবর পর্যন্ত মোট ছয় হাজার ৪৫৫ জন আক্রান্তকে চিহ্নিত করা হয়েছে। তারে মধ্যে এক হাজার ৭২ জনের মৃত্যু হয়েছে। কর্মসূচির সঙ্গে যুক্তরা ধারণা করা করছেন, দেশে এইচআইভি আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় ১৩ হাজার।
২০১৫-১৬ সালের জরিপ অনুযায়ী ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর মধ্যে সংক্রমণের হার ৩ শমিক ৯ শতাংশ। রাজধানী ঢাকার কয়েকটি স্পটে শিরায় মাক গ্রহণকারীদের মধ্যে সংক্রমণ অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। ঝুঁকিপূর্ণ অন্যান্য জনগোষ্ঠী, নারী যৌনকর্মী, সমকামী ও হিজড়াদের মধ্যে সংক্রমণের হার ১ শতাংশ।
আশার আলো সোসাইটির নির্বাহী পরিচালক হাবিবা আক্তার জানান, অভিবাসনের মাধ্যমে এইডস সংক্রমণের বিষয়টি নিয়ে সরকারকে ভাবতে হবে। চাকরি বা কাজের সূত্রে বিদেশে বসবাস ও যাতায়াত করা মানুষকে সচেতন করে তুলতে হবে। এইচআইভি/এইডস সংক্রমণ থেকে কীভাবে রক্ষা পাওয়া যায়, সে সম্পর্কে তাদের ধারণা দিতে হবে।
ভাইরোলজিস্ট ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, এইডস মোকাবিলায় সরকারকে বাস্তবভিত্তিক পদক্ষেপ নিতে হবে। জনসচেতনতা বাড়াতে হবে। সরকারি ব্যবস্থাপনায় যেসব জায়গায় চিকিৎসা শুরু হয়েছে, তা মানুষকে জানানোর পাশাপাশি এ সেবাকে আরও সম্প্রসারণ করতে হবে।
জাতিসংঘের এইডস বিষয়ক শাখা ইউএনএইডসের তথ্যমতে, সারাবিশ্বে তিন কোটি ছয় লাখ ৯০ হাজার মানুষ এইডসে আক্রান্ত। তবে ২০০০ সালের তুলনায় আক্রান্তের হার ৩৫ শতাংশ কমেছে।
সেবার আওতায় যারা : গ্লোবাল ফান্ডের সহায়তায় সেভ ্য চিলড্রেন এবং আইসিডিডিআর,বির ব্যবস্থাপনায় ও এইডস/এসটিডি কর্মসূচির তত্ত্বাবধানে ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর জন্য এইচআইভি প্রতিরোধ সেবান অব্যাহত রয়েছে। বর্তমানে শিরায় মাদক গ্রহণকারী ৯ হাজার ৫০০ জন, নারী যৌনকর্মী ১৮ হাজার ৫০০, সমকামী ২৮ হাজার এবং হিজড়া জনগোষ্ঠীর ৪ হাজার ৬২ জনকে সেবার আওতায় আনা হয়েছে। শিরায় মাদক গ্রহণকারী এক হাজার ৭০০ জনকে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সুই-সিরিঞ্জ কর্মসূচির আওতায় মুখে খাওয়ার মেথাডন দেওয়া হচ্ছে।
ভয় জাগাচ্ছে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী: মিয়ানমার থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মধ্যে এইচআইভি সংক্রমিত রোগী পাওয়া যাচ্ছে। এই রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী নতুন করে উদ্বেগের জন্ম দিয়েছে। এ পর্যন্ত এইচআইভি আক্রান্ত ৩৬৮ জন রোহিঙ্গাকে চিহ্নিত করা হয়েছে। তাদের মধ্যে ৩২০ জনকে বিনামূল্যে কক্সবাজার আড়াইশ’ শয্যার হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে।
ঝুঁকিতে ২৩ জেলা : দেশের ২৩ জেলা সবচেয়ে বেশি এই ঘাতক ব্যাধির ঝুঁকিতে রয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এইডস/এসটিডি কর্মসূচি থেকে সারাদেশে জরিপ করে ঢাকা, সিলেট, চট্টগ্রাম. দিনাজপুর, কুমিল্লা, যশোর, মৌলভীবাজার, কক্সবাজার, খুলনা, নারায়ণগঞ্জ, বাগেরহাট, সিরাজগঞ্জ, পাবনা, চাঁদপুর, সাতক্ষীরা, মুন্সীগঞ্জ, গাজীপুর, পটুয়াখালী, কিশোরগঞ্জ, বগুড়া, রাজশাহী, বরিশাল এবং ময়মনসিংহ- এই ২৩ জেলায় এ ঘাতক ব্যাধির অধিকমাত্রায় সংক্রমণ দেখা গেছে।
এইডস/এসটিডি কর্মসূচির লাইন ডিরেক্টর অধ্যাপক ডা. শামিউল ইসলাম বলেন, অভিবাসী এলাকাপ্রবণ জেলাগুলোতে এইচআইভি আক্রান্তের সংখ্যা বেশি পাওয়া গেছে।
Posted ২:৫৮ অপরাহ্ণ | রবিবার, ০১ ডিসেম্বর ২০১৯
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta