কক্সবাংলা রিপোর্ট(১৫ সেপ্টেম্বর) :: কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফের বিভিন্ন সীমান্ত পয়েন্ট দিয়ে দলে দলে ঢুকছে রোহিঙ্গা। সরকারি উদ্যোগে নিবন্ধন কার্যক্রম শুরুর পর একটি পরিচয়পত্র পেতে তাদের মধ্যে আগ্রহ বাড়ছে। দুই হাতের ১০ আঙুলের ছাপ দিয়ে নিবন্ধিত হয়ে পরিচয়পত্র নিচ্ছে তারা।
উখিয়ার কুতুপালং আর টেকনাফের নয়াপাড়া ক্যাম্পে ১০টি স্টেশনে চলছে রোহিঙ্গা নিবন্ধন। তাই এ দুই ক্যাম্পে রোহিঙ্গাদের উপচে পড়া ঢল। গত সোমবার থেকে শুক্রবার সন্ধ্যা পর্যন্ত পাঁচ দিনে ২০০০ রোহিঙ্গা নিবন্ধিত হয়েছে। রোহিঙ্গাদের বায়োমেট্রিক নিবন্ধন শুরু হয়েছে গত সোমবার রাত থেকে।
সরেজমিনে দেখা যায়, গত পাঁচ দিনে মাত্র ২ হাজার রোহিঙ্গার নিবন্ধন সম্পন্ন করা গেছে। উখিয়া এবং টেকনাফে বেশ কয়েকটি কেন্দ্র খোলার কথা থাকলেও এখন পর্যন্ত কুতুপালং এবং নয়াপাড়া এ দুটি কেন্দ্রেই বায়োমেট্রিক নিবন্ধন কার্যক্রম চলছে।
এছাড়া ধীরগতির কারণে নিবন্ধনের জন্য ঘন্টার পর ঘন্টা লম্বা লাইনে বসে অপেক্ষা করতে হচ্ছে নতুন রোহিঙ্গাদের। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশের প্রয়োজনেই দ্রুত নিবন্ধন কার্যক্রম শেষ করতে হবে। তা না হলে সারাদেশে ছড়িয়ে পড়তে পারে রোহিঙ্গারা। যার প্রভাব হবে সূদুরপ্রসারী।
বাংলাদেশ ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তর এ নিবন্ধন কার্যক্রম পরিচালনা করছে।বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) ও জেলা প্রশাসনের সহযোগিতায় টাইগার আইটি বাংলাদেশ লিমিটেড নামের প্রতিষ্ঠান নিবন্ধন কার্যক্রমে কারিগরি সহযোগিতা দিচ্ছে।
টাইগার আইটির সহকারী মহাব্যবস্থাপক (বিক্রয় ও বিপণন) রাজীব চৌধুরী। রাজীবসহ পাঁচ কর্মকর্তা নিবন্ধন কাজের জন্য উখিয়া গিয়েছিলেন। গত বুধবার রাজীব ঢাকায় ফিরেছেন। গত বৃহস্পতিবার ও শুক্রবার সঙ্গে নিবন্ধন পরিস্থিতি নিয়ে আলাপকালে রাজীবের মুখে ঘুরে ফিরে এসেছে রোহিঙ্গাদের দুর্দশার কথা।
গত বুধবার রাত থেকে টেকনাফের নয়াপাড়া ক্যাম্পে নতুন চারটি নিবন্ধন স্টেশন চালু হয়েছে। তার আগে কুতুপালংয়ে ছয়টি স্টেশনে নিবন্ধন শুরু হয়েছিল। সোমবার রাতে কুতুপালংয়ে নিবন্ধন শুরু হয়। ওই রাতে ১০ জন রোহিঙ্গা নিবন্ধিত হয়। পরদিন একই ক্যাম্পে আরো দুটো স্টেশন স্থাপন করা হয় এবং বিকেলে ১০০ জন রোহিঙ্গা নিবন্ধিত হয়। গত বুধবার আরো দুটো স্টেশন কুতুপালংয়ে চালু করা হয়।
রাজীব চৌধুরী জানান, নিবন্ধনের জন্য রোহিঙ্গাদের দুই হাতের ১০টি আঙুলের ছাপ ও ছবি নেওয়া হচ্ছে। তবে দুই চোখের মণির (আইরিশ) ছবি ধারণ করা সম্ভব হচ্ছে না ডিভাইসের অভাবে। নাম, বাবার নাম, মায়ের নাম, জন্ম তারিখ (যদি বলতে পারে), বয়স—এসব তথ্য সংগ্রহ করে নিবন্ধন করে রোহিঙ্গাকে একটি অংশ দেওয়া হচ্ছে। ১২ বছর ও তার বেশি বয়সীদের বায়োমেট্রিক নিবন্ধন নেওয়া হচ্ছে। তার কম বয়সীদের ক্ষেত্রে কেবল নাম, ঠিকানা ও ছবি নেওয়া হচ্ছে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, এবার এ পর্যন্ত নতুন করে প্রায় চার লাখ রোহিঙ্গা ঢুকেছে। তার আগে বিভিন্ন সময় এসেছে পাঁচ লাখ রোহিঙ্গা। সব রোহিঙ্গাকেই নিবন্ধনের আওতায় আনা হবে।
প্রত্যক্ষদর্শী ও সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নিবন্ধনের এ হার আরো বাড়ানো সম্ভব। পাঁচ দিনে ২০০০ রোহিঙ্গা নিবন্ধন হলে গড়ে প্রতিদিন নিবন্ধন হচ্ছে ৪০০।
নিবন্ধনের এ হার বাড়ানোর বিষয়ে টাইগার আইটির বিশেষজ্ঞ, বিজিবি ও স্থানীয় প্রশাসনের কর্মকর্তারা জানান, রোহিঙ্গাদের শৃঙ্খলাবদ্ধ করে রাখা কঠিন হয়ে পড়েছে, যখন তখন যথেষ্ট বিদ্যুৎ না পাওয়া, তাঁবুঘেরা নিবন্ধন কেন্দ্র তৈরিতে বিলম্ব হচ্ছে, রোহিঙ্গাদের ভাষা অনুধাবনে বেশি সময় লাগছে, নিবন্ধনকাজে বিজিবি সদস্যদের দক্ষতার অভাব আছে—এসব কারণে কাজে গতি পুরোদমে দেখা যাচ্ছে না।
শুক্রবার বিকেলে কুতুপালংয়ে বিদ্যুৎ না থাকায় জেনারেটর চালিয়ে নিবন্ধনকাজ চলছিল। স্টেশন বাড়ানো হলে আরো জনবল নিয়োগ হলে নিবন্ধনে গতি বাড়বে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। গত সোমবার কুতুপালংয়ে একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার কম্পিউটার ল্যাবে নিবন্ধন শুরু করা হয়েছিল।
মিয়ানমার থেকে আসা এসব রোহিঙ্গাকে নিবন্ধন তিন মাসের মধ্যে শেষ করার সুপারিশ করেছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি। গত বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদ ভবনে অনুষ্ঠিত কমিটির সভায় এ সুপারিশ করা হয়েছে।
টাইগার আইটি বাংলাদেশ লিমিটেডের কর্মকর্তা রাজীব চৌধুরী জানান, এক বছরের মধ্যে সব রোহিঙ্গার নিবন্ধন শেষ করা সম্ভব হবে।
রাজীব চৌধুরী বলেন, জার্মানি যে পদ্ধতি ব্যবহার করে সিরিয়ার শরণার্থীদের নিবন্ধন করেছে, তার আদলে সফটওয়্যার তৈরি করেছে টাইগার আইটি। নিবন্ধিত রোহিঙ্গাদের একটি করে পরিচয়পত্র থাকবে। তাতে বারকোড থাকবে। তার মাধ্যমে তাদের পরিচয় নিশ্চিত করা যাবে।
সফটওয়্যারটির মাধ্যমে ছবি, বয়স, নাম-ঠিকানা, বাবা-মায়ের নাম পরিচয়, জাতীয়তা, ধর্ম, দেশ, লিঙ্গসহ আরো বেশ কিছু তথ্য সংরক্ষণে থাকবে। এসব তথ্য সংরক্ষণের জন্য তাত্ক্ষণিকভাবে একটি সার্ভারে যুক্ত হয়ে যাবে।
রাজীব জানান, সীমান্ত দিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের মধ্যে শিশু ও মহিলাই বেশি। কুতুপালংয়েই আছে আড়াই লাখ রোহিঙ্গা। হাজার হাজার মানুষকে শৃঙ্খলায় এনে নিবন্ধন করা কঠিনতম একটি কাজ।
কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট এ কে এম লুৎফর রহমান বলেন, কুতুপালং ও নয়াহাটে যে পরিমাণ রোহিঙ্গা নিবন্ধনের জন্য সারিতে দাঁড়াচ্ছে তাদের অর্ধেকও নিবন্ধন করা যাচ্ছে না। তার বড় কারণ—রোহিঙ্গাদের মধ্যে প্রতিযোগিতা।
কুতুপালং ও নয়াহাটে নিবন্ধনকেন্দ্র স্থাপনের বিদ্যুৎ ও অবকাঠামো সুবিধা যা আছে তা অন্যত্র নেই। শাহ পরীর দ্বীপ থেকে কুতুপালং সর্বত্রই যেন ছোট ছোট ক্যাম্প।
বালুখালীতে দুই হাজার একর জমিতে সব রোহিঙ্গা একত্রে রাখার জন্য প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। তাতে দুই-তিন মাস লাগবে। তখন যথেষ্ট শৃঙ্খলা আসবে সব পরিকল্পনা বাস্তবায়নে। রোহিঙ্গাদের বিষয়ে তথ্য ও ত্রাণ বিতরণের জন্য এ নিবন্ধন কাজে আসবে।
Posted ৯:২৭ পূর্বাহ্ণ | শনিবার, ১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৭
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta