তানভীর মোর্শেদ তামীম(২১ মার্চ) :: আকাশকুসুম কল্পনা করার স্বীয় অধিকার প্রত্যেকের আছে, সেদিক পুনর্বিবেচনা করে আপনাকে সরাসরি, ‘না’ বোধক শব্দ চয়ন করার দুঃসাহস দেখাতে চাই না। তবে আলোচনা করতে চাই যৌক্তিক এবং প্রাসঙ্গিক বিষয়বস্তু সম্মুখে রেখে।
সম্প্রতি কানাডার সরকার প্রধানের করোনা ভাইরাস সম্পর্কিত একটি বক্তব্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ সুনাম কুড়িয়েছে। যার উপর ভিত্তি করে বাংলাদেশের কিছু মানুষ বলছে, কানাডার মতন বাংলাদেশ সরকারের উচিত করোনা ভাইরাস প্রতিরোধ করার জন্য সকল শিক্ষা- প্রতিষ্ঠান, ব্যাংক, কলকারখানা, অফিস-আদালতসহ সকল যাবতীয় প্রতিষ্ঠান বন্ধ এবং প্রত্যেক পরিবারের জন্য এক মাসের সকল চাহিদা সরকারীভাবে সরবরাহ করতে ; যা কখনো গঠনমূলক আলোচনা হিসেবে মূল্যায়িত করার দাবি রাখে না। কেন এটি মূল্যায়ন করারর দাবি রাখে না তা এখন ধারাবাহিকভাবে বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করবো।
কানাডা বিশ্বের শিল্পোন্নত দেশগুলোর একটি – এটি জি-৭ এবং অর্গানাজেশন অব ইকোনমিক কো-অপারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (ওইসিডি)-র সদস্য।
একটি দেশের অর্থনীতি কতটা শক্তিশালী তা কয়েকটা সূচকের মাধ্যমে প্রকাশ করা যায়। এই সূচকগুলোর মধ্যে রয়েছে মোট মাথাপিছু জাতীয় আয়, মোট প্রবৃদ্ধির হার, মোট দেশজ উৎপাদন ইত্যাদি। একটি দেশের উৎপাদিত পণ্য বা সেবার মোট বাজার মূল্য হলো মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপি। মানুষের ভোগ ব্যয়, বিনিয়োগ ব্যয় ও সরকারি ব্যয় মিলে জিডিপি নির্ধারিত হয়। রপ্তানি থেকে আমদানি বিয়োগ করে যা থাকবে, তাও এখানে যোগ হয়।
বিশ্বব্যাংকের হিসাবে ২০১৭ সালে কানাডার মোট দেশজ উৎপাদন ছিল ১.৬৪৭ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার, যেখানে বাংলাদেশের জিডিপি ছিল মাত্র ২৪৯.৭২৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। আবার, বিশ্বব্যাংকের ২০১৭ সালের হিসাবে কানাডার মাথাপিছু মোট দেশজ উৎপাদন ৪৪,৮৭০.৮ মার্কিন ডলার হলেও, বাংলাদেশের এই আয় ১,৫১৬.৫ মার্কিন ডলার। মোট দেশজ উৎপাদনের সঙ্গে বিদেশে অর্জিত অর্থ যোগ করার পর তা থেকে অন্য দেশে চলে যাওয়া অর্থ বাদ দিলে যে ফলাফল পাওয়া যায়, তা-ই মোট জাতীয় আয়। কানাডার ২০১৭ সালে মাথাপিছু মোট জাতীয় আয় ৪২,৭৯০ মার্কিন ডলার, যেখানে বাংলাদেশের আয় ১,৪৭০ মার্কিন ডলার।
উপরের আলোচনার মূল সুর একটাই। বাংলাদেশ এবং কানাডার অবস্থান এক নয়। তাই আমরা চাইলে করোনা ইস্যুতে যখন যা ইচ্ছে তেমন সিদ্ধান্ত নিতে পারব না। কারণটা একদম সহজ এবং সাবলীল। বস্তুত, কানাডার সরকার দেশের মানুষের জন্য তাদের সামর্থ্য অনুযায়ী কাজ করার ঘোষণা দিয়েছে। সেদিক বিবেচনা করলে বাংলাদেশ সরকার আশা করি তাদের সাধ্যমত যা যা করা যায় তার কিছুই বাকি রাখবে না।
কিন্তু একটা কথা আমাদের সবসময় মাথায় রাখতে হবে, আমাদের দেশটা অর্থনৈতিকভাবে অনেক দ্রুত এগিয়ে গেলেও আমরা এখনো অতটা সমৃদ্ধ নয়।কাজেই চাইলে এক মাসের জন্য স্কুল- কলেজ, কল-কারখানা সবকিছু বন্ধ করে দিয়ে করোনা ইস্যুতে আরাম-আয়েশ করে ঘরে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে কাটানো যাবে এমন চিন্তা অবান্তর ঠেকে। আমি নিশ্চিত এক মাস যদি সমস্ত কিছু বন্ধ করে দেওয়া হয় তাহলে দেশের মানুষ করোনা থেকে বাঁচলেও খাদ্য সংকটের দিকে এমনভাবে ধাবিত হবে যা অনেক ভয়াবহ আকার ধারণ করবে।
আর তখন কি হবে? একবার ভেবে দেখুন। আসলে আমরা শুধু সমালোচনা করতে জানি। সরকারের দোষ খুঁজতে জানি। অথচ জাতির এই ক্রান্তিকালে আমরা একটুও সচেতন নই। এমন দূর্যোগ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য অন্যান্য দেশগুলো সাধারণ মানুষ যেভাবে এগিয়ে আসছে, আমরা সেভাবে এখনো প্রস্তুত নই। এই পর্যন্ত আমাদের দেশে ২৪ জন করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত এবং দুই জন এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছে বলে জানা গেছে ।
এটি সামনে আরো ভয়ংকর রূপ ধারণ করবে বলে, ইতোমধ্যে বিশেষজ্ঞরা মত দিয়েছেন। আসলে আমরা এখন একটা জাতীয় সংকটের মধ্যে আছি। সবকিছু বন্ধ করে দিলে যে এই মহামারী থেকে উত্তরণ সম্ভব, সেটা কিন্তু অস্পষ্ট। তবে আমাদের সবসময় সচেতন হতে হবে। এই যে, স্কুল -কলেজ বন্ধ করে দিল? এরপর কি হলো! সবাই দলবেধে ঘুরতে গেলো, যা স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনার সম্পূর্ণ বিপরীত। এই বিষয়গুলোর কথা কি বলবেন? মোদ্দাকথা হচ্ছে, কোন একটা দেশকে চাইলে সবকিছুতে অনুকরণ করা যায় না।
অনুকরণ করা যেতো ; যদি আমরা সবদিকে তার সাথে তাল মিলিয়ে চলতে পারতাম। কিন্তু এখন আমাদের সংস্কৃতি, অর্থনীতি, রাজনীতি, শিক্ষানীতি, পররাষ্ট্রনীতি সবকিছু আলাদা। আমরা এখনো পৃথিবীর অন্যান্য সমৃদ্ধশালী দেশগুলোর তুলনায় অনেক পিছিয়ে আছি বলা যায়। তাই এখন আমাদের এটা চিন্তা করতে হবে কিভাবে সহজে অর্থনৈতিক অবস্থা দৃঢ় রেখে এই সংকট মোকাবেলা করা যায়! শুধু আওয়ামীলীগেরর নেতারা এগিয়ে আসলে এই মহামারী থেকে রেহায় পাওয়া যাবে না। আমাদের মনে রাখতে হবে দেশটা কেবল তাদের নয়, সকলের। সকলকে সম্মিলিতভাবে এগিয়ে আসতে হবে। আরো আন্তরিক হতে হবে। প্রয়োজনীয় বিধি – নিষেধ মেনে চলতে হবে। সরকার অবশ্যই সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাবে এই মহামারি থেকে জাতিকে রক্ষা করবার জন্য এবং প্রয়োজনমতো সব ব্যবস্থা গ্রহণ করবে বলে আশা রাখছি। এটা সরকারের জন্য বিশাল একটা চ্যালেঞ্জও।
এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে পারলে নিঃসন্দেহে তাঁরা সাধারণ মানুষের বিশ্বাস এবং আস্থা অর্জন করতে পারবে। তবে এক্ষেত্রে কোন ধরণের আতঙ্ক এবং বিভ্রান্তি ছড়ানো যাবে না। সেই সঙ্গে প্রশশাসনকে সজাগ থাকতে হবে যেন কোন অসাধু চক্র জাতির দুর্দিনে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস- পত্রের মূল্য বাড়িয়ে কৃত্রিম সংকট তৈরী করতে না পারে। ইতোমধ্যে অনলাইন মিডিয়ায় এসেছে, অসাধু চক্র দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি করে সাধারণ মানুষকে অর্থ-কষ্টের দিকে ধাবিত করছে।
পরিশেষে আবারো বলবো আসুন, আমরা জাতির এই দূর্যোগে একটু সচেতন হই, সকল নিয়ম- কানুন, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলি এবং অহেতুক সমালোচনা না করে গঠনমূলক বাস্তবমুখী সমালোচনা করি। এতে করে এই কঠিন দূর্যোগ থেকে জাতির মুক্তি লাভের পথ সুগম হবে।
—
তানভীর মোর্শেদ তামীম, তরুণ লেখক।
Posted ১:১২ পূর্বাহ্ণ | রবিবার, ২২ মার্চ ২০২০
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta