রাজিবুল ইসলাম মোস্তাক(১২ সেপ্টেম্বর) :: মিয়ানমারের সেনা ও বর্ডার গাড (বিজিপি)’র নির্যাতনের শিকার হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের দেখতে ১২ সেপ্টেম্বর ১১টা ৩০মিনিটের সময় কক্সবাজারের উখিয়ার কুতুপালং শরনার্থী ক্যাম্পে পৌঁছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
পৌঁছেই প্রধানমন্ত্রী কুতুপালং নিবন্ধিত রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরির্দশন শেষে জনসভায় স্থলে উপস্থিত হয়ে তিনি বলেন, মিয়ানমার সেনাবাহিনীর অত্যাচার নির্যাতনে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের মানবিক দিক বিবেচনা করে বাংলাদেশে আশ্রয় দেওয়া হয়েছে। তাদের নিজ দেশে ফিরিয়ে নিতে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক মহলের জোরালো কূটনৈতিক চাপ প্রয়োগের চেষ্টা করা হচ্ছে।
১৯৭১ সালে পাকিস্তানী বাহিনী যেভাবে নির্যাতন করেছে সে দৃশ্য ভেসে ওঠছে। আমাদের জন্য কঠিন এত মানুষ রাখা, আশ্রয় দেওয়া। তারা মানুষ, তাদের ফেলে দিতে পারি না। আমারওতো রিফিউজি ছিলাম। রিফিউজি থাকার যন্ত্রণতা কি তা আমরা বুঝি।’
এসময় হানাদার বাহিনীরা আমাদের বাড়িঘর জ¦ালিয়ে দিয়েছিল এবং গণহত্যা চালিয়েছিল। ঠিক একই ভাবে মিয়ানমার সরকার রাখাইন (আরকান) রাজ্যে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের উপর দমন,নিপীড়ন শুরু করেছে। তাদের বাড়ী ঘর জ¦ালিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
এ কারনে লাখ লাখ রোহিঙ্গা আমাদের দেশে আশ্রয় নিয়েছে। আমরা তাদেরকে সাময়িক সময়ের জন্য আশ্রয় দিয়েছি। আমরা মিয়ানমার সরকারকে অনুরোধ করছি অবিলম্বে নির্যাতন বন্ধ করে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের খাদ্য, আশ্রয় দেওয়া হচ্ছে। আমি রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে মিয়ানমারের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোকে আহ্বান জানাচ্ছি। তবে প্রতিবেশী দেশ হিসেবে আমাদের যা করার দরকার আমরা সেটি করবো। মিয়ানমারে যেভাবে মানুষ হত্যা করা হচ্ছে তাতে কি তাদের বিবেককে নাড়া দেয় না? একজনের ভুলে এভাবে লাখ লাখ মানুষ ঘরহারা হচ্ছে। আমরা শান্তি চাই।’
রোহিঙ্গা সংকটকে কেন্দ্র করে কেউ যেন রাজনৈতিক ফায়দা বা আর্থিক সুবিধা নেওয়ার চেষ্টা না করেন, সেই আহ্বান জানান প্রধানমন্ত্রী তিনি বলেন, ১৬ কোটি মানুষের খাবার দিই সেই সঙ্গে কয়েক লাখ মানুষকে খাবার দেওয়ার সক্ষমতা বাংলাদেশের আছে। সত্যিকার যারা এসেছে তাদের ছবিসহ তালিকা করা হবে।
প্রধামন্ত্রী বলেন, মিয়ানমারকে স্পস্ট করে মানতে হবে, এরা তাদের নাগরিক। বাঙ্গালিতো শুধু বাংলাদেশে নেই, পশ্চিমবঙ্গেও আছে। তিনি বলেন, কারো সঙ্গে সম্পর্ক বৈরী হোক চাই না। শত শত বছর ধরে রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে বাস করছে। হঠাৎ তাদের বিতাড়িত করার ফলাফল কী দাড়াতে পারে, তারা কি সেটা চিন্তা করছে? প্রধানমন্ত্রী মিয়ানমার সেনাবাহিনীর ওপর আক্রমণেরও সমালোচনা করেন। তিনি এসব বন্ধ করারও আহ্বান জানান।
রোহিঙ্গাদের দুর্দশার কথা বলতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, নারী শিশু, নৌকা ডুবি হয়ে লাশ ভাসছে। এমনিক গুলি খাওয়া লাশ নদীতে সাগরে ভেসে আসছে। সেখানে আগুন দিয়ে ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেওয় হচ্ছে। একটা জাতির প্রতি এ আচরণ কেন, তা বোধগম্য নয়।
এ সময় তিনি স্থানীয়দের উদ্দেশে বলেন, এখন যারা যুবক তারা হয়তো মুক্তিযুদ্ধ দেখেননি। কিন্তু আমরা দেখেছি। তাই রোহিঙ্গাদের যেন কোনও কষ্ট না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। তিনি প্রশাসনকে নির্দেশ দিয়ে বলেন, ‘আমি জেনেছি যারা আশ্রয় নিতে এসেছেন তাদের অনেকেই অসুস্থ। তাদের দ্রুত চিকিৎসা ব্যবস্থা দেওয়া হোক।
এ সময় রোহিঙ্গাদের যেন কোনও কষ্ট না হয় এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি যেন ভালো থাকে সেজন্য প্রশাসনকে সহযোগিতা করার জন্য অনুরোধ জানান তিনি।প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, ‘বেসরকরি সংস্থা বা অন্য কোনও সংগঠন রোহিঙ্গাদের ত্রাণ বা সাহায্য সহযোগিতা করতে চাইলে তা জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে করতে হবে।’
প্রধানমন্ত্রী মিয়ানমারকে উদ্দেশ্য করে বলেন, ২৪আগষ্ট রাতের ঘটনায় যারা জড়িত তাদের খোঁজে বের করে শাস্তি দেওয়া হোক। কিন্তু এই জন্যে পুরো রাখাইন রাজ্যে অবস্থানকারী লাখো লাখো রোহিঙ্গাদের উপর এই দুষ চাপিয়ে দেওয়া যায়না।
তিনি বলেন, ‘রোহিঙ্গা সংকটের সুযোগ নিয়ে কেউ যেন কোনও ধরনের বাণিজ্য করতে না পারে সে ব্যাপারে সবাইকে সজাগ থাকার আহবান জানান। বক্তব্য শেষে প্রধানমন্ত্রী মিয়ানমার থেকে আগত সেনা ও বিজিপি এবং রাখাইনের নানান নির্যাতনের শিকার ও গুলিবৃদ্ধ কয়েকজন রোহিঙ্গাদের সাথে কথা বলেন। এবং আশ্রিত রোহিঙ্গাদের মাঝে ত্রাণ বিতরণ করেন। প্রধানমন্ত্রীকে কাছে পেয়ে রোহিঙ্গা নারী-পুরুষেরা মা’ মা’ শব্দ করে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। তখন কুতুপালং শরনার্থী ক্যাম্প জুড়ে এক হৃদয় বিদারক দৃশ্যের অবতারণা সৃষ্টি হয়।
দীর্ঘ ১৩মিনিটের বক্তব্য শেষে প্রধানমন্ত্রী বেলা ১২ টা ১৩মিনিটের কক্সবাজারের উদ্দেশ্যে গাড়ী যোগে কুতুপালং শরনার্থী ক্যাম্প ত্যাগ করেন। প্রধানমন্ত্রীর সাথে রয়েছে ছোট বোন শেখ রেহেনা, পরাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মুহাম্মদ আলী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া, গণপূর্তমন্ত্রী মোশারফ হোসেন, ভূমিপ্রতিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী, চীফ হুইফ আ স ম ফিরোজ, হুইফ ইকবালুর রহমান, মন্ত্রী পরিষদ সচিব শফিউল আলম, প্রধানমন্ত্রীর মূখ্য সচিব কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী, সেনা বাহিনীর প্রধান আবু বেলাল মোহাম্মদ শফিউল হক, পুলিশের আইজি একেএম শহিদুল হক, বিজিবি’র মহা পরিচালক মেজর জেনারেল আবুল হোসেন, প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের সিনিয়র সচিব সুরাইয়া বেগম, প্রেস সচিব ইহসানুল করিম, সংসদ সদস্য সাইমুন সরওয়ার কমল, আশেক উল্লাহ রফিক, আব্দুর রহমান বদি, আবু রেজা মুহাম্মদ নিজামুদ্দিন নদভি।
এর আগে সকাল ১০টায় বিমান যোগে কক্সবাজার এয়াপোর্টে পৌঁছলে প্রধানমন্ত্রীকে বরণ করে নেন বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের।
এদিকে টানা দ্বিতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী থাকা অবস্থায় এটি তার অষ্টম বারের মতো কক্সবাজার সফর। তবে কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে এটাই দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে প্রথম সফর।
গত ২৪ আগস্ট মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে পুলিশ ক্যাম্পে হামলা চালায় দেশটির একটি বিদ্রোহী গ্রুড। এ ঘটনায় মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সেনা অভিযানের নামে সাধারণ মানুষকে হত্যা, ধর্ষণ, তাদের বাড়িঘরে আগুন দেওয়াসহ নানা নির্যাতন চালানো হচ্ছে। নির্মম নির্যাতন, স্বজনের মৃতদেহ রেখে টানা না খেয়ে প্রাণ নিয়ে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে এ দেশে আশ্রয় নিয়েছেন কয়েক নতুন,পুরাতন মিলে ৭লাখ রোহিঙ্গরা।
Posted ১২:২৮ পূর্বাহ্ণ | বুধবার, ১৩ সেপ্টেম্বর ২০১৭
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta