কক্সবাংলা রিপোর্ট(১৫ সেপ্টেম্বর) :: কক্সবাজারের উখিয়ার বালুখালীতে দুই হাজার একর জমিতে রাখাইন থেকে অনুপবেশকারী সব রোহিঙ্গা একত্রে রাখার জন্য প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।এর মধ্যে কুতুপালংয়েই আছে নতুন আড়াই লাখ রোহিঙ্গা। আর সরকারি জায়গায় রোহিঙ্গাদের আশ্রয়দানের নামে ক্যাম্প স্থাপনসহ রোহিঙ্গা পরিবারের কাছ থেকে নগদ অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে স্থানীয় একটি অসাধু চক্র।
শুক্রবার সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত রোহিঙ্গাদের আশ্রয়দানের নামে টাকা নেওয়ার অভিযোগে আটক করা হয় ছয়জনকে।
রাব-৭কে সঙ্গে নিয়ে জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট উখিয়ার থাইংখালী এলাকায় এ অভিযান পরিচালনা করে তাদের আটক করেন। ভ্রাম্যমাণ আদালতে আটককৃতরা দোষ স্বীকার করায় বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ডাদেশ দিয়ে জেলহাজতে প্রেরণ করা হয় তাদের।
সরেজমিনে দেখা গেছে, উখিয়ার কুতুপালং থেকে টেকনাফ উপজেলার হোয়াইক্যং ইউনিয়ন পর্যন্ত প্রায় ২০ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে প্রায় চার লাখ রোহিঙ্গা অবস্থান নিয়েছে। এদের অধ্যে অন্তত তিন লাখ রোহিঙ্গার বসবাসের জন্য সরকারি বনভূমিতে বস্তি নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে।
রোহিঙ্গারা জানায়, কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফে রোহিঙ্গাদের বস্তিঘর নির্মাণের সময় তারা নীরব চাঁদাবাজির শিকার হচ্ছে। বস্তি নির্মাণের জন্য কোথাও গর্ত খোঁড়া বা গাছ-বাঁশ উঁচু করতে দেখলেই সেখানে হামলে পড়ছে চাঁদাবাজরা।
ভুক্তভোগী রোহিঙ্গারা জানায়, দুই হাজার থেকে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত টাকা নেওয়া হচ্ছে ‘সেলামি’ তথা অগ্রিম হিসেবে। পরে প্রতি মাসে জায়গার পরিমাপ অনুযায়ী জায়গাভেদে ২০০, ৪০০ থেকে শুরু করে ১০০০ টাকা পর্যন্ত ভাড়া দিতে হবে বলেও তাদের বলা হচ্ছে।
এই চাঁদাবাজি চক্রে উখিয়ার কুতুপালং টিঅ্যান্ডটি এলাকার নবী হোসেন, আয়েশা, মনির আহমদ ও রোহিঙ্গা আবু মাঝি, কুতুপালং এলাকার ভুট্টো, নুরুজ্জামান, জাফর আলম, আলী আকবর, মো. রশিদ, লম্বাশিয়া এলাকার শাহজাহান, আবদুস ছবি, জসীম উদ্দিন, মধুরছড়া এলাকার রোহিঙ্গা ডাকাত মো. ইউনুস ও সেলিম জড়িত বলে শোনা যাচ্ছে।
এ ছাড়া কুতুপালং গ্রামের বাসিন্দা আবদুর রহমান বিশ্বাস ও ফিরোজ মিয়াও গ্রামসংলগ্ন এলাকায় দুই শতাধিক রোহিঙ্গা বন্তি নির্মাণের বিপরীতে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিয়েছে বলেও অভিযোগ করেছে রোহিঙ্গারা।
কুতুপালং এলাকায় বনভূমিতে ১২ হাত দৈর্ঘ্য ও ৮ হাত প্রস্থ জায়গায় বস্তি নির্মাণের সময় আবদুর রহমান বিশ্বাস ও ফিরোজ মিয়াকে টাকা দিয়েছে এমন কয়েকজন রোহিঙ্গার নামও পাওয়া গেছে। তারা হলো মো. শফি (তিন হাজার), মো. জোহার (আড়াই হাজার), মো. নবী হোসেন (চার হাজার) নুর মোহাম্মদ (দুই হাজার) ও জাহেদ হোসেন (দুই হাজার)।
রোহিঙ্গা বসতি স্থাপনের নামে রোহিঙ্গাদের কাছ থেকে চাঁদাবাজি করার দায়ে গত ৭ সেপ্টেম্বর পালংখালী ইউনিয়নের থাইংখালী এলাকার দুই মেম্বার নুরুল আলম ও জয়নাল আবেদীনের বিরুদ্ধে মামলা হয়।
এদিকে চাঁদাবাজির সঙ্গে জড়িত স্থানীয় এক ব্যক্তি বলেন, খুপরি তোলার সময় টাকা আদায়ের বিষয়টি বন বিভাগের কর্মকর্তারাও জানেন এবং তাঁরা ভাগ পাচ্ছেন। তবে এই অভিযোগ সত্য নয় বলে দাবি করেছেন উখিয়া সদর বনবিট কর্মকর্তা আশরাফুল আলম।
তিনি বলেন, ‘যেখানে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা রয়েছে, সেখানে বিপন্ন রোহিঙ্গাদের কাছ থেকে বন বিভাগের নামে টাকা আদায়ের প্রশ্নই আসে না। কারোর বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ উঠলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ’
মিয়ানমারের মংডু জেলার ফকিরা বাজার থেকে আসা রোহিঙ্গা ছাবের আহমদ অভিযোগ করে বলেন, ‘আমি যখন বনভূমিতে বস্তিঘর তুলতে যাই তখনই স্থানীয় কয়েকজন এসে আমার কাছ থেকে সেলামি হিসেবে তিন হাজার টাকা দাবি করে। পরে বাধ্য হয়ে সেই টাকা দিয়ে ঝুপড়ির মতোই একটি বস্তি ঘর তুলেছি। ’
কুতুপালং রোহিঙ্গা শিবিরের ডি ফোরের পাশে একটি বস্তিঘর তুলতে যান মিয়ানমারের নাপ্পোড়া এলাকার খাইরুল বশরের পুত্র রোহিঙ্গা ছৈয়দ আহমদ। তিনি বলেন, ‘বনভূমিতে বস্তিঘর নির্মাণ করতে গেলে স্থানীয় এক মেম্বারসহ দুইজন লোক এসে ১০ হাজার টাকা দাবি করে সেলামি হিসেবে।
আমি তাদের বলি, অঁবাজি আঁই ত বর্মাত্তুন আইবার সমত কিছুই আনিত ন পারি। এডে আঁইয়েরে আত্মীয়স্বজনত্তুন ধাঁর গরিয়েরে হনঅবতে এই বাঁশ, গাছ, পলিথিন জোগাড় গরিত পাইজ্জি। আঁই এহন এদুন টেয়া হডে পাইয়ম।
(অর্থাৎ বাবা আমি তো মিয়ানমার থেকে আসার সময় কোনো কিছুই আনতে পারিনি। এখানে এসে স্বজনদের কাছ থেকে টাকা ধার নিয়ে কোনোভাবে কিছু বাঁশ, গাছ ও পলিথিন জোগাড় করে ঘর বাঁধতে এসেছি)। ’
অভিযোগের সত্যতা নিশ্চিত করে উখিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও রাজাপালং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর কবির চৌধুরী বলেন, ‘কয়েক দিন ধরে শুনে আসছি রোহিঙ্গাদের কাছ থেকে স্থানীয় কিছু চাঁদাবাজ টাকা আদায় করছে।
টাকা আদায়ের বিষয়টি জানার পর তা রোধ করার চেষ্টা করলেও চাঁদাবাজরা আমার বারণ শুনছে না। নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ায় রোহিঙ্গাদের কাছ থেকে টাকা আদায়ের বিষয়টি উপজেলা প্রশাসনকে জানিয়েছি। ’
উখিয়ার কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্প ইনচার্জ রেজাউল করিম এ ধরনের অভিযোগ শোনার কথা জানিয়ে বলেন, ‘নাম সংগ্রহ করে আমি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সরবরাহ করব। যাতে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া যায়। ’
এ ব্যাপারে কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মো. আলী হোসেন জানিয়েছেন, সরকার প্রাথমিকভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছে উখিয়া উপজেলার বালুখালী এলাকায় দেড় হাজার একর বনভূমিতে রোহিঙ্গাদের থাকার ব্যবস্থা করা হবে। পরে বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা রোহিঙ্গাদের এই এলাকায় নিয়ে আসা হবে।
Posted ৯:৪৮ পূর্বাহ্ণ | শনিবার, ১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৭
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta