কক্সবাংলা ডটকম(৩ সেপ্টেম্বর) :: ছোট্ট দেশ আমাদের। ঘুরাফেরার জায়গা খুব বেশি নেই। যা আছে এর মধ্যে কক্সবাজারকে সেরা বললে অত্যুক্তি হবে না। বন-পাহাড়-সমুদ্র সবই আছে সেখানে। আছে পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত, যাকে নিয়ে কিছুকাল আগেও আমরা বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় নেমেছিলাম শ্রেষ্ঠত্বের দাবি নিয়ে। প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিনেরও অবস্থান সেই জেলায়। একসময় টেকনাফ থেকে সেন্টমার্টিন যাতায়াত খুব দুরূহ ছিল। যেতে হতো ট্রলারে সমুদ্রের ঢেউয়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে। এতে ঝুঁকি থাকত। এখন সে অবস্থা নেই।
জাহাজের প্রচলন হওয়ায় টেকনাফ-সেন্টমার্টিন ভ্রমণ ঝুঁকিমুক্ত। টেকনাফও যথেষ্ট চিত্তাকর্ষক। পাহাড়, সমুদ্র ও নাফ নদের মিলনস্থল। সেখানকার সৈকত লাগোয়া সমুদ্রের পানি কক্সবাজারের মতো ঘোলা নয়, স্বচ্ছ টলটলে। দক্ষিণে দেশের সীমানার শেষপ্রান্ত টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ যথেষ্ট মনোহর।
কক্সবাজারে পর্যটকদের জন্য সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোর দাবি দীর্ঘদিনের। আবাসন সমস্যা প্রকট ছিল একসময়, সে সমস্যা আপাতত মিটেছে বলা যায়। ব্যক্তি উদ্যোগে গড়ে উঠেছে প্রচুর হোটেল। তবে পরিকল্পনাহীন যে যেখানে সুযোগ পেয়েছেন হোটেল উঠিয়েছেন। এভাবে চলতে থাকলে একসময় হয়তো হোটেল নামক ‘বস্তিতে’ ভরে যাবে গোটা এলাকা। কর্তৃপক্ষকে দ্রুত এদিকে দৃষ্টি দিতে অনুরোধ করি। শুধু সমুদ্র দেখে দিন পার করা যায় না, বিনোদনের অন্য ব্যবস্থাও প্রয়োজন। হয়ে যাবে হয়তো তাও।
তাছাড়া বিদেশি পর্যটক টানতে চাইলে তাদের চাহিদামতো আলাদা ব্যবস্থাও করতে হবে। অতি রক্ষণশীল হলে বিদেশিদের পাওয়া সম্ভব হবে না। সত্যি কথা বলতে কি দেশের পর্যটন শিল্প এখনো দেশীয় পর্যটকদের ওপর নির্ভরশীল। বিদেশিদের পাওয়া যাচ্ছে না শুধু সুযোগ-সুবিধার ঘাটতির কারণে নয়, নিরাপত্তার প্রশ্নও এখানে গভীরভাবে যুক্ত। যতই সুযোগ-সুবিধা বাড়ানো হোক, নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে না পারলে বিদেশি কেন, দেশীয়রাও যেতে সাহস করবেন না। পরিস্থিতি সে রকমই হয়ে উঠছে যেন ওখানে যা উদ্বেগের কারণ।
কক্সবাজার হতে টেকনাফ পর্যন্ত সড়ক নির্মাণ বা মেরিন ড্রাইভ তৈরি নিঃসন্দেহে একটি চমৎকার কাজ। কিন্তু এর সুফলপ্রাপ্তি মাঠে মারা যেতে বসেছে নিরাপত্তার অভাবে। প্রায় এক যুগের প্রচেষ্টায় ৮০ কিলোমিটার দীর্ঘ দৃষ্টিনন্দন সড়কটি নির্মাণ করা হয়েছে সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে। খরচ পড়েছে ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা। ‘ইকোপার্ক’ নির্মাণসহ এর আরো কিছু কাজ বাকি। সেসব সম্পন্ন করতে পারলে দেশি-বিদেশি পর্যটকের আনাগোনা বহুগুণে বেড়ে যেত। সে রকম লক্ষণই দৃষ্ট হচ্ছিল ২০১৭ সালে প্রকল্পটি উন্মুক্ত করে দেয়ার পর। হুমড়ি খেয়ে পড়ল মানুষ পৃথিবীর দীর্ঘতম এই মেরিন ড্রাইভটি উপভোগের জন্য।
উল্লাসে অনেকে রাত কাটাতেও শুরু করলেন সেখানে। মানুষের স্বাভাবিক আগ্রহ বাধাগ্রস্ত হতে লাগল মিয়ানমার থেকে আগত রোহিঙ্গাদের কারণে। তারা যেন ক্যাম্পের বাইরে আসতে না পারে সেজন্য চেকপোস্ট বসানো শুরু হলো। চেকপোস্ট ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকল যখন দেখা গেল সড়কটি মাদক ও মানব পাচারের রুট হিসেবেও ব্যবহৃত হচ্ছে। এতে স্বাভাবিকতা আরো বিনষ্ট হলো। সর্বশেষ এক হিসাবে দেখা যাচ্ছে মেরিন ড্রাইভে পুলিশ, বিজিবি ও সেনাবাহিনীর মোট ১১টি তল্লাশিচৌকি রয়েছে। এতসব তল্লাশিচৌকি ডিঙিয়ে ভ্রমণ সময়সাপেক্ষ ও ঝক্কিবহুল। মানুষ যেমন অপরাধপ্রবণতা দেখতে চায় না, নিরাপত্তা চায়, তেমনি চায় না ঘুরতে গিয়ে বিড়ম্বনা সইতেও। ঘাটে ঘাটে প্রশ্নের মুখে পড়া নিরপরাধ মানুষের কাছে বিরক্তিকর। ভ্রমণের আনন্দ এতে ম্লান হয়।
এখন সেখানে দেখা দিয়েছে ভিন্নতর সমস্যা। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটছে। ৩১ আগস্ট রাতে পুলিশের হাতে সেনাবাহিনীর এক অবসরপ্রাপ্ত মেজর নিহত হওয়ার পর বেরিয়ে আসছে অনেক অজানা তথ্য। একটি দৈনিক পত্রিকার অনুসন্ধানী প্রতিবেদন থেকে দেখা যাচ্ছে, বছর দুয়েকের মাদকবিরোধী অভিযানকালে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ দেশে মোট ৫৮৬ জন নিহত হয়েছেন। মেরিন ড্রাইভে শতাধিকসহ এদের ২৩০ জনই কক্সবাজারের (প্রথম আলো, ১৬ আগস্ট ২০২০)। মনে হয় পর্যটনের বদলে কক্সবাজার অপরাধের আখড়া হয়ে উঠেছে। এ অবস্থা আরো কিছুদিন অব্যাহত থাকলে পর্যটক-সংযুক্তির বদলে পর্যটক-বিযুক্তির দৃষ্টান্ত লক্ষ করা যাবে সেখানে।
বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড কোথাও কোনো অবস্থাতেই গ্রহণযোগ্য নয়। এতে নতুন অপরাধের জন্ম হয়। সুযোগসন্ধানীরা সুযোগ নেয়। অনেক পরিবার নিঃস্ব হয়, ফুলেফেঁপে উঠে গুটিকতক। তাছাড়া ‘বন্দুকযুদ্ধ’ বলতে মানুষ যা বুঝতে আরম্ভ করেছে তা কোনো বাহিনীর জন্যই মঙ্গলজনক নয়। অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহার ঘটনা ব্যক্তিবিশেষের দায় হলেও ঘটনাটি প্রকারান্তরে পুলিশ বাহিনীর ভাবমূর্তি নষ্ট করেছে। এ বাহিনীর কারো দ্বারা যেন এ রকম ঘটনা ভবিষ্যতে না ঘটে, কোনো বাহিনীর কেউ যাতে এ ধরনের হত্যাকাণ্ডে সম্পৃক্ত না হয় সেটিই কাম্য। হত্যাকাণ্ডটির দ্রুত বিচার ও সরকারের কঠোর মনোভাব পরিবর্তনের সূচনা ঘটাতে পারে। মানুষ সে রকমটিই দেখতে চায়।
মেরিন ড্রাইভে সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের ঘটনা কক্সবাজারকে খাদের কিনারে ঠেলে দিয়েছে। নিরাপত্তাহীনতার বার্তা ছড়িয়েছে দেশে-বিদেশে। এত নজরকাড়া একটি প্রকল্প, যেটি বাস্তবায়িত হতে না হতেই মানুষের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হলো, যাকে ঘিরে প্রাণচাঞ্চল্য দেখা গেল অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে সেখানে নৃশংসতা দেশের স্বার্থের ওপর কশাঘাত। এটি মেনে নেয়া যায় না কোনোমতেই। পরিস্থিতির রূপ পাল্টাতে হবে দ্রুত। এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধ করে নিরাপত্তাবোধ সৃষ্টি করতে হবে পর্যটকদের মনে। আবার নিরাপত্তার নামে বাড়াবাড়ি যেন ভ্রমণের আনন্দকে মাটি না করে দেয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। করোনা পরিস্থিতির কারণে যেসব খাত প্রবল ক্ষতিগ্রস্ত তার একটি দেশের পর্যটন খাত। বাংলাদেশের পর্যটন শিল্প বস্তুত কক্সবাজারনির্ভর। অনেকেই বিনিয়োগ করেছেন সেখানে। হত্যাকাণ্ডের ঘটনা মড়ার উপর খাঁড়ার ঘায়ের মতো হলো তাদের কাছে।
অর্থনীতিতে জোরালো ভূমিকা রাখা সত্ত্বেও কক্সবাজারকে বারবার দুঃখবরণ করতে হয়েছে। ১৯৭৮ সালে একবার রোহিঙ্গারা এলো আনুমানিক ২ লাখ, ১৯৯২ সালে আবার ৩ লাখ। ফিরে যাওয়ার সুযোগ এলেও সবাই সে সুযোগ নেয়নি। একটি অংশ মিশে গিয়েছিল এখানকার জনারণ্যে। তখনই একবার ঘুরতে গিয়ে স্থানীয় জনগণের অভিযোগ শুনেছিলাম প্রকৃতি ধ্বংসের, সামাজিক পরিবেশ বিপন্নের। ২০১৭ সালে যা ঘটল তা একেবারই অভাবিত। অনুপ্রবেশ ঘটল ১১ লাখের। তাদের যেখানে ঠাঁই দেয়া হলো সেখানে স্থানীয় মানুষের সংখ্যা ৫ লাখ। নিজ বাসভূমেই পরবাসী বলা যায় এখন স্থানীয়রা। ক’দিন পর স্থানীয় জনগণের সেখানে কর্তৃত্ব থাকবে কিনা আশঙ্কা অমূলক নয়। আলামত ভালো নয়। অপরাধপ্রবণতা বাড়ছে, পরিবেশ বিপন্নই শুধু নয়- উচ্ছন্নে যাচ্ছে।
মিয়ানমারের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী যারা এখানে এসে আশ্রয় নিয়েছে তাদের ফেরত পাঠানোর মধ্যে প্রকৃত সমাধান নিহিত। দায়িত্ব সরকারের। তাদের সফলতার প্রতিফলন দেখছি না। অথচ প্রত্যাশিত সাফল্যের বিকল্প নেই। যতদিন না সফলতা আসবে ততদিন কক্সবাজারের দুঃখ দূর হবে না।
মজিবর রহমান : কলাম লেখক।
mojibsb@gmail.com
Posted ৩:১২ পূর্বাহ্ণ | শুক্রবার, ০৪ সেপ্টেম্বর ২০২০
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta