বিশেষ প্রতিবেদক(২৬ জানুয়ারী) :: কক্সবাজারে পাহাড় দখল ও বন উজাড় করে কয়েক লাখ রোহিঙ্গা শুধু আশ্রয়ই নেয়নি, তারা নিজেদের মতো বিভিন্ন টিলার নাম দিয়েছে।
অন্তত চারটি টিলাকে ‘মক্কা’, ‘মদিনা’, ‘তুর্কি’ ও ‘ইরানি’ নামে ডাকা হচ্ছে—একাধিক সূত্রে এ তথ্য মিলেছে। মানবিক বিবেচনায় লাখ লাখ রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়েছে বাংলাদেশ।
কিন্তু রোহিঙ্গাদের মধ্যে প্রত্যাবাসনবিরোধী মনোভাব চাঙ্গা করে তুলতে স্বার্থান্বেষী বিভিন্ন মহল চেষ্টা চালাচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
গত ২৩ জানুয়ারি প্রত্যাবাসন শুরুর পূর্বনির্ধারিত তারিখের আগে প্রত্যাবাসনের পক্ষের একজন রোহিঙ্গা শিবিরে দুর্বৃত্তের হামলায় নিহত হয়। পরে আরো দুজন রোহিঙ্গা দুর্বৃত্তের হামলায় প্রাণ হারিয়েছে। প্রত্যাবাসন শুরু না হলেও যত দ্রুত সম্ভব শুরুর লক্ষ্যে কাজ করছে বাংলাদেশ। কিন্তু এরই মধ্যে রোহিঙ্গারা প্রত্যাবাসনের আগে মিয়ানমারে নাগরিকত্বসহ নানা ধরনের দাবি পূরণের শর্ত তুলছে। এ পরিস্থিতিতে স্থানীয় কর্তৃপক্ষও উদ্বিগ্ন।
ঢাকায় গত বুধবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ‘ডকুমেন্টবিহীন মিয়ানমারের নাগরিক’ বিষয়ক জাতীয় টাস্কফোর্সের বৈঠক এবং পরদিন বৃহস্পতিবার একই বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত বৈঠকে সার্বিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করা হয়।
টাস্কফোর্সের বৈঠকে কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক এম আলী হোসেন রোহিঙ্গা শিবির পরিস্থিতি নিয়ে তাঁর পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেন। তিনি রোহিঙ্গা শিবিরে কমপক্ষে পাঁচটি অস্থায়ী পুলিশ ক্যাম্প স্থাপনের প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছেন। বর্তমানে সেখানে দুটি পুলিশ ক্যাম্প আছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা বলেন, রোহিঙ্গা শিবিরে শৃঙ্খলা বজায় রাখা এবং যত দ্রুত সম্ভব প্রত্যাবাসন শুরু করা বাংলাদেশের জন্য বড় চ্যালেঞ্জই হয়ে গেছে। রোহিঙ্গাদের মধ্যে অনেকেই ফিরে যেতে চান। কিন্তু দেশি-বিদেশি বিভিন্ন গোষ্ঠী ও বেসরকারি সংস্থা প্রত্যাবাসনের বিরুদ্ধে রোহিঙ্গাদের উসকানি দিচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। রোহিঙ্গা সংকট জিইয়ে রাখার মাধ্যমে তারা নিজেদের স্বার্থ হাসিলের স্বপ্ন দেখছে।
জানা গেছে, রোহিঙ্গা শিবিরে নজরদারি বৃদ্ধির পাশাপাশি রোহিঙ্গাদের রাখাইনের প্রকৃত পরিস্থিতি তুলে ধরে তাদের প্রত্যাবাসনে উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টা চালাবে বাংলাদেশ।
ওই কর্মকর্তা বলেন, কিছু রোহিঙ্গাকে স্থায়ীভাবে প্রত্যাবাসন করা গেলে অন্যদের মধ্যেও ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
জানা গেছে, রোহিঙ্গাদের দেশে ফিরে না যেতে ইন্ধন দেওয়ার গুরুতর অভিযোগ উঠেছে রোহিঙ্গা শিবিরে কর্মরত বেশ কয়েকটি বেসরকারি সংস্থার (এনজিও) কর্মীদের বিরুদ্ধে। এনজিওগুলোতে কর্মরত কমপক্ষে পাঁচ হাজার রোহিঙ্গার মাধ্যমে প্রত্যাবাসনবিরোধী প্রচারণা চালানো হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এর মধ্যে বাংলাদেশের একটি এনজিওর একজন এরিয়া ম্যানেজারের বিরুদ্ধে অভিযোগ পাওয়ার পর এনজিওটির ঢাকা কার্যালয় তদন্ত শুরু করেছে।
কক্সবাজারের টেকনাফ ও উখিয়া উপজেলায় রোহিঙ্গা শিবিরে দেশি-বিদেশি ৯৩টি এনজিও কাজ করছে। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনবিরোধী উসকানি, স্থানীয় লোকজনকে কাজ না দিয়ে রোহিঙ্গাদের কাজ দেওয়া এবং পরিমাণে ত্রাণ কম দেওয়ার অভিযোগে সম্প্রতি ১২টি এনজিওকে রোহিঙ্গা শিবিরে নিষিদ্ধ করেছে এনজিও ব্যুরো।
জানা গেছে, এনজিওগুলো রোহিঙ্গাদের চাকরি দিলেও তাদের স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে দেখানো হয়, যাতে কোনো প্রশ্ন না ওঠে। বলা হচ্ছে, নিজেদের স্বার্থ টিকিয়ে রাখার জন্য অনেক এনজিও চায় না রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে ফিরে যাক। রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনবিরোধী উসকানি দেওয়ার কারণে স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছে।
গত ২৩ জানুয়ারি বিকেলে উখিয়া বাসস্টেশনে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সংগ্রাম কমিটির উদ্যোগে এক সমাবেশে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও রাজনীতিকরা অভিযোগ করেছেন যে এনজিওগুলো নিজেদের স্বার্থ হাসিলের জন্যই প্রত্যাবাসনবিরোধী কাজে জড়িত রয়েছে।
রোহিঙ্গা শিবিরে সরকারি অনুমোদন না নিয়েও অনেক এনজিও গোপনে কাজ করছে। সরকারিভাবে এনজিওর কাজ কঠোরভাবে তদারকি করা না হলে এ দেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গারা দেশে ফিরবে না।
গতকাল শুক্রবার উখিয়ার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. নিকারুজ্জামান এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, গত বছর রোহিঙ্গা ঢল শুরুর পর আসা বিদেশি এনজিওগুলোর মধ্যে তুরস্কের একটি সংস্থা টিলায় কিছু তাঁবু বানিয়ে দেয়।
এই সূত্রে টিলাটিকে রোহিঙ্গারা তুর্কি পাহাড় ডাকা শুরু করে। ইউএনও জানান, পাশের একটি টিলাকেও লোকজন ‘ইরানি পাহাড়’ ডাকে। কারণ ইরানি একটি সংস্থা এই টিলায় অনেক তাঁবু বানিয়ে দিয়েছে। ‘মক্কা’ ও ‘মদিনা’ নামেও টিলার নামকরণ হওয়ার কথা শুনেছেন বলে ইউএনও জানান।
মোহাম্মদ হোসেন নামের একজন রোহিঙ্গা বলেন, ‘দিন দিন আমাদের এখানে প্রত্যাবাসন বিরোধীদের তত্পরতা বাড়ছে। তুর্কি, মদিনা ও মক্কা পাহাড়ে গেলেই এর প্রমাণ পাবেন।’ নিরাপত্তার প্রশ্ন তুললে তিনি বলেন, ‘আপনি তো পুলিশ নিয়াই আসতে পারেন।’
উখিয়া থানার ওসি মো. আবুল খায়ের এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, তিন দিন আগে অ্যাডিশনাল ডিআইজি ঘুরে যাওয়ার পর পুলিশের সংখ্যা আরো বাড়ানো হয়েছে।
১১টি চেকপোস্ট থেকে এ পর্যন্ত ৪৬ হাজার রোহিঙ্গাকে চিহ্নিত করে শিবিরে ফেরত পাঠানো হয় বলে গত বৃহস্পতিবার কক্সবাজারের পুলিশ সুপার ড. কে এম ইকবাল হোসেন জানান।
গত সপ্তাহে উখিয়া ও টেকনাফ এলাকা ঘুরে রোহিঙ্গা এনজিওকর্মীদের বিরুদ্ধে প্রত্যাবাসন বিরোধী ইন্ধন দেওয়ার অভিযোগের কথা জানা গেছে।
টেকনাফের হোয়াইক্যং ইউনিয়নের উলুবুনিয়া গ্রামের বাসিন্দা চিংড়ি ব্যবসায়ী ফরিদুল আলম বলেন, ‘রোহিঙ্গারা ফিরে যেতে চায়। কিন্তু আমাদের লোকজনই ফিরে যেতে দিচ্ছে না। আমি নিজের চোখে দেখেছি একটি বড় এনজিওর একজন কর্মকর্তা রোহিঙ্গাদের বলছেন দেশে না ফিরতে। তিনি নাফ নদের ওপার থেকে রোহিঙ্গাদের নিয়ে আসার কাজেও জড়িত।’
হোয়াইক্যং ইউনিয়নের ১ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক সদস্য গোলাম আকবর বলেন, ‘একদিন আমার সামনেই এক দল রোহিঙ্গাকে একটি এনজিওর কর্মকর্তা কিছু বলছিলেন। তিনি চলে যাওয়ার পর আমি ওই রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা বলি। তারা বলে, লোকটি তাদের আর দেশে ফিরে না যেতে বলছিলেন। এরপর বিষয়টি আমি স্থানীয় ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ নেতাদের জানিয়েছি।’
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, এরই মধ্যে নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। ১০ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গাকে নিয়ন্ত্রণে এবং শৃঙ্খলার মধ্যে রাখা না গেলে বড় ধরনের ঝুঁকির আশঙ্কা করা হচ্ছে। এর আগেও বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে দেখা গেছে, এ ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ গোষ্ঠীকে উগ্রবাদী অপশক্তিগুলো কাজে লাগানোর চেষ্টা করে।
আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থাও প্রত্যাবাসনের আন্তর্জাতিক মান বজায় রাখার শর্ত দিয়ে এখনই রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। এতেও উদ্বুদ্ধ হচ্ছে অনেক রোহিঙ্গা।
Posted ৩:১৭ পূর্বাহ্ণ | শনিবার, ২৭ জানুয়ারি ২০১৮
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta