কক্সবাংলা ডটকম(২৫ জুলাই) :: জুনের তৃতীয় সপ্তাহে পালিত হয়েছে বিশ্ব শরণার্থী দিবস। এ উপলক্ষে নিজ দেশ ছেড়ে যাদের আশ্রয় হয়েছে অন্য দেশে, সেসব শরণার্থী বড় বড় শোভাযাত্রা ও সমাবেশ করেছে। শরণার্থীর জীবন এক দুর্ভাগ্যজনক পরিস্থিতি। এ পরিস্থিতি বজায় রাখতে বৈশ্বিক উদাসীনতা ও নিষ্ক্রিয়তা নিয়ে একটা সাধারণ সমালোচনা ছিল।
কক্সবাজার জেলার চৌহদ্দির মধ্যে উখিয়া ও টেকনাফের ৩৪টি শরণার্থী শিবিরেও আমরা রোহিঙ্গাদের শোভাযাত্রা ও সমাবেশ করতে দেখেছি। তারা সেখানে নিজের স্বদেশ মিয়ানমারের আরাকানে তাদের নিরাপদে ও মর্যাদার সঙ্গে ফিরে যাওয়ার সুযোগ দিতে হবে বলে দাবি জানিয়েছেন। একই সঙ্গে তারা এ প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জাতিসংঘ এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নকে আরো সক্রিয় ভূমিকায় যুক্ত হওয়ার ব্যাপারে জোর দিয়েছে।
এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, জাতিসংঘ মহাসচিব এন্তোনিও গুতেরেসের ছয় মাস আগে নিযুক্ত মিয়ানমারবিষয়ক বিশেষ উপদেষ্টা নোলিন হেইজার বলেছেন ও ইঙ্গিত করেছেন, তিনি আশিয়ান দেশগুলোর মাধ্যমে শান্তি আলোচনা চালিয়ে যাওয়া এবং রোহিঙ্গাদের প্রতি মিয়ানমারের নীতি পরিবর্তনে দৃষ্টি দিচ্ছেন। আরো বৈশ্বিক যুক্ততা বাড়লে এ দুটি প্রচেষ্টায় অবশ্য সুফল মিলবে।
তিনি আরো বলেন, ‘এথনিক আর্মড অর্গানাইজেশনের (ইএও) সঙ্গে আলোচনাকালে আমি বাস্তবতা বিবেচনায় নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রয়োজনীয়তার ওপরও গুরুত্বারোপ করেছি।’ মনে হয় এর সঙ্গে রোহিঙ্গাদের দাবির অনেক মিল আছে।
বিশ্লেষকরা উল্লেখ করেছেন, ইউক্রেনে বিবর্তনশীল সামাজিক, রাজনৈতিক পরিস্থিতি বৈশ্বিক মনোযোগ আকর্ষণ করছে বেশি। বিশেষ করে ইউরোপীয় ইউনিয়ন এ সংকটকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। ফলে অনেকটা আড়ালে পড়ে গেছে রোহিঙ্গা সংকট। গত পাঁচ বছরে এ সমস্যা সমাধানে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের বলিষ্ঠ উদ্যোগ দেখা যায়নি। এখন আরো প্রলম্বিত হচ্ছে সংকটটি। এ থেকে পরিত্রাণে প্রয়োজন নতুন করে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা বাড়ানো। রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের মধ্যে এই জরুরত্বের বোধ মনে হয় ইউক্রেন সংকটের প্রভাবের কারণে হয়েছে। সরবরাহ শৃঙ্খল ব্যাহত মানে হলো জনগোষ্ঠীর সাহায্য পাওয়ার ব্যয় এমন এক সময় বেড়েছে, যখন প্রতিশ্রুত তহবিল ‘বৃহত্তর উদ্বেগের’ অঞ্চলে প্রবাহিত করা হচ্ছে।
এ প্রেক্ষাপটে নাগরিক সমাজের কিছু প্রতিনিধি এ বিষয়টি সামনে এনেছে, বৈশ্বিক প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও বিশ্বের সব শরণার্থী একই রকমভাবে গণ্য হচ্ছে না। তাদের সঙ্গে সমান আচরণ করা হচ্ছে না। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য প্রয়োজন ৪৪১ মিলিয়ন ডলার, এর মাত্র ১৩ শতাংশ অর্থায়িত হয়েছে; যা রোহিঙ্গাপ্রতি দৈনিক ৩০ সেন্টেরও কম।
স্মরণ করা যেতে পারে, গত ১১ জুন সিঙ্গাপুরে অনুষ্ঠিত আইআইএসএস শাংগ্রি-লা ডায়ালগে বক্তৃতা দেয়ার সময় হেইজার স্থানীয় থেকে বৈশ্বিক, সব পর্যায়ে অবনতিশীল নিরাপত্তা ও মানবিক পরিস্থিতি অ্যাড্রেস করার ওপর জোর দিয়েছেন। সেখানে তিনি মিয়ানমারের শিশু ও নারীদের সুরক্ষা এবং সমর্থন প্রদানে জরুরি সহায়তা নিয়ে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছেন। এ প্রচেষ্টায় তিনি ইন্দোনেশিয়ার সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী, কূটনীতিক রেত্নো মাসুদির সঙ্গে কাজ করছেন।
১৪ জুলাই জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার মিশেল ব্যাচেলেট মিয়ানমারের পরিস্থিতির ওপরও দৃষ্টি দিয়েছেন। তিনি ১৮ মাস আগে সামরিক অভ্যুত্থানের পর থেকে শুধু ১ হাজার ৯০০ মানুষকে টার্গেটেড হত্যার বিষয়ে মিয়ানমার সেনাবাহিনীকে দায়ী করেননি, আরো পর্যবেক্ষণ করেছেন, সেখানে মানবতাবিরোধী যুদ্ধ অপরাধ সংঘটনের যুক্তিসংগত ভিত্তি আছে। এটি তার কমিশন বিশ্বাসও করে।
দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে ‘হস্তক্ষেপের’ অভিযোগ এনে মিয়ানমারের শাসকরা ১৭ জুন তাত্ক্ষণিকভাবে জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলের প্রধানের উপস্থাপিত মানবাধিকার রেকর্ডের সমালোচনার বিষয়টি খারিজ করেছেন। যেমনটা প্রত্যাশিত ছিল, এক বিবৃতিতে দেশটির সরকার সংস্থাটির বিবৃতিকে ‘এক পক্ষীয় এবং ভিত্তিহীন’ বলে প্রত্যাখ্যান করেছে। এ ধরনের প্রতিক্রিয়া থেকে বোঝা যাচ্ছে, রোহিঙ্গাদের স্বদেশে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শিগগিরই হচ্ছে না।
এখানে মনে রাখা দরকার, ১৯৪৮ সালে বার্মার স্বাধীনতার পর থেকে রোহিঙ্গাদের ওপর দেশটির শাসকরা নির্যাতন অব্যাহত রেখেছে। ১৯৮২ সালের জাতীয়তা আইনের মাধ্যমে তাদের নাগরিকত্ব অস্বীকার করা হয়েছে। একই সঙ্গে রাষ্ট্রীয় শিক্ষা ও সরকারি চাকরিতে প্রবেশসহ চলাফেরার স্বাধীনতার ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে। দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনের সংগঠক এবং নোবেলজয়ী বিশপ ডেসমন্ড টুটুসহ কিছু শিক্ষাবিদ, বিশ্লেষক ও রাজনৈতিক ব্যক্তিরা মিয়ানমারে মুখোমুখি হওয়া আইনি অবস্থাকে বর্ণবাদের সঙ্গে তুলনা করেছেন।
১৯৮২ সালে সামরিক অভ্যুত্থানের পর থেকে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর নির্যাতন ও সাঁড়াশি অভিযান শুরু হয়েছে। ফলে ১৯৭৮, ১৯৯১-৯২ এবং ২০১২ সালে তারা বাংলাদেশে পালিয়ে আসে কিংবা আইডিপি ক্যাম্পে আশ্রয় নেয়। এক্ষেত্রে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শিবির এবং রাখাইন রাজ্যে থাকা আইডিপি ক্যাম্পে ভাগ হয়ে যায়।
অবশ্য ২০১৭ সালে নির্মম সেহা অভিযান এবং হত্যাযজ্ঞ বাংলাদেশে ৭ লাখের বেশি রোহিঙ্গার গণপলায়ন বেগবান করেছে। রোহিঙ্গাদের এ গণবাস্তুচ্যুতি ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিন্যাল কোর্টকে কেবল মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধ সম্পর্কে তদন্ত শুরু করতে নয়, উপরন্তু আন্তর্জাতিক বিচার আদালতকে কথিত গণহত্যার সঙ্গে যুক্ত সম্ভাব্য বিষয়গুলো খতিয়ে দেখতে চালিত করেছে।
ইউএনএইচসিআরের এক বড় কর্মকর্তা ফিলিপো গ্রান্ডি গত মে মাসে রোহিঙ্গা সমস্যার বর্তমান পরিস্থিতি মূল্যায়নে পাঁচদিন বাংলাদেশে কাটিয়েছেন। কক্সবাজারে শরণার্থী শিবির এবং ভাসানচর ঘুরে তিনি বলেছেন, গত পাঁচ বছরে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে বাংলাদেশ যে নানামুখী সংকটে পড়ছে সেটি ‘বিশ্বকে অবশ্যই মনে রাখতে হবে’।
রোহিঙ্গাদের উপস্থিতির প্রতিক্রিয়ায় যে গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি হয়েছে তার জন্য গ্রান্ডি বাংলাদেশ সরকারের নেতৃত্বের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। তার পর্যবেক্ষণ, প্রায় এক মিলিয়ন রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে আশ্রয় দিতে বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের মানবিক সাড়া প্রদানের বিষয়টি ইউএনএইচআরসিকে তার প্রাধিকার সহযোগীতে পরিণত করেছে। তিনি উল্লেখ করেছেন, জীবন বাঁচানোর সহযোগিতা এবং আশা সঞ্চারে অব্যাহত আন্তর্জাতিক সমর্থন গুরুত্বপূর্ণ।
জাতিসংঘের হাইকমিশনার আরো বলেছেন, রোহিঙ্গাদের জীবন নির্ভর করছে তাদের প্রতি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় কেমন নজর দিচ্ছে, তার ওপর। এজন্য যত দিন নিজ দেশে নিরাপদে না ফিরছে তত দিন রোহিঙ্গাদের সুরক্ষায় নমনীয় অর্থায়নসহ আন্তর্জাতিক সমর্থন প্রয়োজন।
বাংলাদেশের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ শাহরিয়ার আলম সাম্প্রতিক এক বিবৃতিতে বলেছেন, স্থানীয় সংকট হিসেবে না দেখে রোহিঙ্গা সংকটকে একটি বৈশ্বিক ও সামষ্টিক সমস্যা হিসেবে দেখতে হবে। তিনি আরো বলেছেন, বাংলাদেশ একা এক মিলিয়নের বেশি মিয়ানমারের নাগরিককে প্রতিপালন করতে পারবে না। এজন্য বৈদেশিক সমর্থন গুরুত্বপূর্ণ ও আবশ্যক।
মিয়ানমারকে কীভাবে সামলাবে সে বিষয়ে আশিয়ান দেশগুলোর মধ্যে বিবর্তনশীল বিভাজনের বিষয়টি উল্লেখ ছাড়া কেউ রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে আলাপ করতে পারবে না। অনেক কৌশলবিদের মতে, এটা ওই গ্রুপের প্রভাব আরো হুমকির মুখে ফেলছে। এক্ষেত্রে সামরিক অভ্যুত্থান-পরবর্তী মিয়ানমারে আশিয়ানের দেয়া আনুষ্ঠানিক ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও এ বছর কম্বোডিয়ার কর্তৃত্ববাদী প্রধানমন্ত্রী হুন সুনের মিয়ানমারের জেনারেল মিন হেলেঙ্গের সঙ্গে সাক্ষাতের বিষয়টি উল্লেখ করা যায়।
আশিয়ানের বর্তমান প্রধান হুন সুন এবং মিয়ানমারের বিতর্কিত নেতার মধ্যকার এ বৈঠক আশিয়ানের অন্য দেশগুলোর সরকারের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে। এর মধ্যে মালয়েশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সাইফুদ্দিন আব্দুল্লাহ, সিঙ্গাপুরের কর্মকর্তা ও ইন্দোনেশিয়ার প্রতিক্রিয়া ছিল লক্ষণীয়। বিশেষ করে স্বাভাবিক চর্চার বাইরে গিয়ে সিঙ্গাপুর এ বিষয়টির নিন্দা জানিয়েছে। তাদের অবস্থান ব্যক্ত করেছে। আঞ্চলিকভাবে বেশ শক্তিশালী রাষ্ট্র ভিয়েতনাম ও থাইল্যান্ড এ ব্যাপারে নীরব ছিল।
আশিয়ানের মধ্যে এ কূটনৈতিক সম্পৃক্ততা অতি সম্প্রতি আরো বিবর্তিত হয়েছে। গত জুনে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী নিযুক্ত প্রতিরক্ষামন্ত্রী জেনারেল মায়া তুন উ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সহযোগীদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। আশিয়ানের কোনো সম্মেলনে মিয়ানমারের জান্তা সরকারের কোনো প্রতিনিধিকে অংশগ্রহণে বিরত রাখতে গণতন্ত্রপন্থী গ্রুপগুলো এবং আঞ্চলিক ব্লকের কিছু দেশের চাপ সত্ত্বেও এটা ঘটেছে।
গত বছর ক্ষমতা দখলের পর থেকে মিয়ানমারে বিরোধীদের ওপর চালানো নির্যাতন, নিষ্পেষণকারী সামরিক শক্তিকে কীভাবে মোকাবেলা করবে তা নিয়ে আশিয়ানের ১০টি দেশের মধ্যে বিভাজন বিরাজ করছে। মালয়েশিয়ার প্রতিরক্ষামন্ত্রী বলেছেন, সেনা সরকারের সঙ্গে সাম্প্রতিক বৈঠকটি হলেও তার মানে এ নয় ‘মালয়েশিয়া মিয়ানমারের বৈধ সরকার হিসেবে জান্তা সরকারকে স্বীকৃতি দেয়।’
কম্বোডিয়ার প্রতিরক্ষামন্ত্রী টি বানাহ অবশ্য উল্লেখ করেছেন, মিয়ানমারের জেনারেলের উপস্থিতি একটি একীভূত ব্লক ইঙ্গিত করে। তিনি আরো বলেছেন, এ সম্মেলনের মাধ্যমে ১০টি পূর্ব এশীয় প্রতিরক্ষামন্ত্রীদের পাশাপাশি তাদের চীনা ও জাপানি প্রতিপক্ষের সঙ্গেও ভার্চুয়ালি মতবিনিময় হয়েছে। প্রতিরক্ষামন্ত্রীদের আলোচনার বিস্তারিত সহজলভ্য না হলেও সংবাদমাধ্যমে আসা তাদের যৌথ বিবৃতি থেকে ইঙ্গিত মেলে, ‘মিয়ানমারে স্বাভাবিকতা ফিরিয়ে আনতে একটা শান্তিপূর্ণ উত্তরণে’ যথাযথ সমর্থন প্রদানে সবাই অঙ্গীকারাবদ্ধ। মিয়ানমারসহ সব জায়গার গণতন্ত্রপন্থী কর্মীরা অবশ্য জান্তা সরকারের সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়াকে একে বৈধতা দেয়ার এক ধাপ বলেছেন এবং স্বভাবত এটা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
তথাপি বর্তমানে পরিবর্তনশীল দৃশ্যপটের বিষয়ে একটা উপসংহারে পৌঁছার আগে ওআইসির পক্ষ থেকে গাম্বিয়ার করা মামলায় আনীত গণহত্যার অভিযোগ দেশটির নির্বাচিত সরকারের প্রধান এবং নোবেলজয়ী নেতা অং সান সুচি কেন আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে ডিফেন্ড করেছিলেন, তা এখনো বেশ গোলমেলে।
পাঁচ বছর পেরিয়ে রোহিঙ্গা সংকটের একটি গ্রহণযোগ্য সমাধানে পৌঁছতে বিশ্বকে সার্বিকভাবে ব্যর্থ মনে হচ্ছে।
Posted ৮:০১ অপরাহ্ণ | মঙ্গলবার, ২৬ জুলাই ২০২২
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta