কক্সবাংলা রিপোর্ট(১৬ নভেম্বর) :: কক্সবাজারে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের নিয়ে সম্প্রতি নানা জটিলতায় প্রত্যাবাসন কার্যক্রম ব্যাহত হওয়ায় স্থানীয় ক্ষতিগ্রস্ত লোকজনের মাঝে উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা ও ক্ষোভ দেখা দিচ্ছে।
জানা যায়,কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফে বর্তমানে প্রায় বার লাখ রোহিঙ্গা অস্থায়ীভাবে আশ্রয় নিয়ে অবস্থান করছে। এরমধ্যে উখিয়ার কুতুপালং ও বালুখালী সংযুক্ত আশ্রয় শিবিরের অবস্থান করছে প্রায় ৬লক্ষাধিক রোহিঙ্গা।
পাশাপাশি উখিয়ার বালুখালী–২, তাছনিমার খোলা, হাকিমপাড়া, জামতলী ও গয়ালমারায় অস্থায়ী শিবিরে অবস্থান করেছে দুই লক্ষাধিক রোহিঙ্গা। টেকনাফের চাকমারকূল, উনচিপ্রাং, লেদা, নয়াপাড়া ও শামলাপুরে অবস্থান করছে প্রায় দুই লক্ষের কাছাকাছি রোহিঙ্গা।
উখিয়া ও টেকানাফে বিভিন্ন স্থানীয়দের সাথে গ্রামে অবস্থান করছে আরও প্রায় লক্ষাধিক রোহিঙ্গা। এ সব রোহিঙ্গাদের খাদ্য, বস্ত্র, আশ্রয়স্থল, চিকিৎসা, শিক্ষাসহ বিভিন্ন সহায়তা প্রদান করছে বাংলাদেশ সরকার সহ জাতিসংঘের বিভিন্ন্ সংস্থা, দেশি–বিদেশী এনজিও।
জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা, আইএনজিও এবং এনজিওগুলোর অধিকাংশ রোহিঙ্গাদের বিভিন্ন কাজে ও চাকরিতে নিয়োজিত করেছে। এধরণের অন্তত পাঁচ হাজারের অধিক রোহিঙ্গা আয়বর্ধক কাজে নিয়োজিত রয়েছে।
এসব কারণে উখিয়া ও টেকনাফে রোহিঙ্গাদের গোপনে ও প্রকাশ্যে সাহায্য-সহযোগিতা করার মাধ্যমে স্বদেশে ফিরে যেতে নিরুৎসাহিত করে চলছে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন এনজিও। আর নিজ স্বার্থে বাংলাদেশের ওপর চাপ বাড়াচ্ছে ইউরোপসহ অন্য পশ্চিমা দেশগুলো। রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের আগে নানা শর্ত জুড়ে দিয়ে সরকার তথা বাংলাদেশের ওপর চাপ বাড়াচ্ছে এসব দেশ।
ইউরোপীয় পার্লামেন্টের সদস্য মেরি ক্রিস্টিন ভারজিয়াট গত বৃহস্পতিবার বাংলাদেশে মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনার সময় মিয়ানমারের সঙ্গে প্রত্যাবাসন চুক্তি বাস্তবায়ন না করতে বাংলাদেশের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি ওই চুক্তিকে ‘মৃত্যু পরোয়ানা’ হিসেবে অভিহিত করেছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাংলাদেশি এক কূটনীতিক শুক্রবার আলাপকালে এ প্রসঙ্গে বলেন, ইউরোপীয় পার্লামেন্টের ওই সদস্য যদি প্রত্যাবাসনের বিরোধিতা করেন তাহলে তিনি আসলে কী প্রত্যাশা করছেন? তিনি কী চান, রোহিঙ্গারা নিজ দেশ ছেড়ে বাংলাদেশেই থাকুক? ইউরোপের দেশগুলো কি তাদের নেবে?
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ার জটিলতা প্রসঙ্গে ঢাকার কর্মকর্তারা বলেছেন, সাধারণত যত দ্রুত এ সংকট সৃষ্টি হয়, তত দ্রুত কোনোভাবেই সমাধান করা যায় না। এ ধরনের সংকটে আশ্রয় নেওয়া সবাই হয়তো ফিরেও যায় না।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ও বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা (এনজিও) রোহিঙ্গাদের এ দেশে আশ্রয় পাওয়া নিয়ে যতটা সরব ছিল, ফেরত পাঠানোর বিষয়ে ততটা সরব নয়। যেমন—শরণার্থী বা শরণার্থীর মতো পরিস্থিতিই যদি না থাকে তাহলে এ দেশে জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থার (ইউএনএইচসিআর) কার্যক্রম গুটিয়ে নিতে হবে।
সরেজমিন দেখা গেছে রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে ইউএনএইচসিআর,আইওএম,এমএসএফ, টিকা, মোয়াস,ফয়জুল্লাহ ফাউন্ডেশন,ইসলামিক রিলিফ,আফাড,সেভ দ্যা চিলড্রেন, ডাব্লউএফপি, হিড,সলিডারিটি,ফেন্ডশিপ,মুসলিম হেন্ড, আইএইসএইস, ওয়াল্ডভিশন,মুসলিম চেরিটি, ডিএসকে,এসকেবি সহ বিভিন্ন সেবা সংস্থার কয়েক হাজার বিদেশী সহ শত শত রোহিঙ্গাদের বিভিন্ন্ আয়বর্ধক কাজে নিয়োজিত রেখেছে।
আর শরণার্থী বা শরণার্থীর মতো ব্যক্তিদের আনা ও ফেরত পাঠানো—এ দুটি কাজই মূলত এ ধরনের সংস্থার করার কথা। কিন্তু তারা শরণার্থী আনতে যতটা আগ্রহী, ফেরত পাঠাতে ততটা নয়। এর সঙ্গে তাদের কর্মীদের জীবিকার বিষয়ও জড়িত।
একজন কর্মকর্তা বলেন, বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা (এনজিও) এখনো দেশ-বিদেশে অভিযোগ করে বেড়াচ্ছে যে এনজিও আইনের কারণে তাদের কার্যক্রম ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, বিদেশি অনুদান পেতেও সমস্যা হচ্ছে।
সরকারের অবস্থান হলো, জঙ্গি অর্থায়নের মতো বিষয় ঠেকানো এবং বিদেশি অনুদানের অর্থ ব্যয়ের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতেই ওই আইন করা হয়েছে। কাউকে হয়রানি করার জন্য নয়।
ওই কর্মকর্তা বলেন, গত বছরের আগস্ট থেকে নতুন করে রোহিঙ্গা ঢল শুরুর পর এনজিওগুলোর মানবিক তৎপরতায় আগ্রহ বেড়েছে। কারণ রোহিঙ্গা শিবিরে এনজিওগুলোর কাজের সৃষ্টি হয়েছে।
তবে মানবিক তৎপরতার নামে বিদেশি বিভিন্ন সংস্থার গাড়ি কেনা ও অধিক হারে বিদেশিদের নিয়োগ করা নিয়েও বিভিন্ন মহলে অসন্তোষ রয়েছে।
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সংগ্রাম কমিটির সেক্রেটারি পালংখালী ইউপি গফুর উদ্দিন চৌধুরী অভিযোগ করে বলেন– দেশি বিদেশী এনজিও এবং জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা রোহিঙ্গাদের উল্লেখযোগ্য বেতনে চাকরি দিয়ে প্রত্যাবাসন বিরোধী কর্মকান্ডে নিয়োজিত রয়েছে। এ ধরনের অন্তত পাঁচ হাজারের মত রোহিঙ্গা দিনে এনজিও কর্মী ও রাতে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী গ্রুপ’র কর্মী হিসাবে কাজ করে যাচ্ছে। এরা রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের প্রত্যাবাসন বিরোধী নানা ষড়যন্ত্রে ইন্দন দিচ্ছে।
এদিকে গত বৃহস্পতিবার ফাঁস হওয়া ইউএনএইচসিআরের একটি অভ্যন্তরীণ প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফিরিয়ে নিয়ে আশ্রয় শিবিরে রাখার মেয়াদ স্বল্প সময়ের না হলে তারা সেখানে কোনো সহযোগিতা দেবে না। সংস্থাটি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কেও এই পথ অনুসরণ করার আহ্বান জানিয়েছে।
ইউএনএইচসিআর জোর দিয়ে বলছে, রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরার পরিবেশ সৃষ্টি হয়নি। অন্যদিকে ওই পরিবেশ সৃষ্টির জন্য মিয়ানমারকে বাধ্য করার মতো আন্তর্জাতিক উদ্যোগও নেই। এখন পর্যন্ত যেসব প্রস্তাব জাতিসংঘের বিভিন্ন ফোরামে গৃহীত হয়েছে সেগুলোতে মিয়ানমারের প্রতি আহ্বান জানিয়েই দায় সারা হয়েছে।
মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ফেরার পরিবেশ সৃষ্টি না হলে বা ফিরতে আগ্রহী না হলে তারা কি বাংলাদেশেই থাকবে?—এমন প্রশ্নের জবাবে কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, পরিবেশ সৃষ্টি না হওয়া বা ফিরতে আগ্রহী না হওয়া সাময়িক। এত বিপুলসংখ্যক লোককে আশ্রয় দিয়ে বাংলাদেশ ইতিমধ্যে বিশ্বে দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করেছে।
Posted ৫:১৬ পূর্বাহ্ণ | শনিবার, ১৭ নভেম্বর ২০১৮
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta