কক্সবাংলা রিপোর্ট(১১ মে) :: কক্সবাজারের উখিয়ার বালুখালী রোহিঙ্গা ক্যাম্পে প্রকাশ্য দিবালোকে পরিবেশ বিধংসী পাহাড় কাটার মহোৎসব চালাচ্ছে আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থ্যা আইওএম সহ সাত-আটটি এনজিও। উখিয়ার এসব সংরক্ষিত বনভূমিতে প্রায় ৭ লক্ষাধিক রোহিঙ্গার আশ্রয় নিশ্চিত হওয়ার পরও থামছেনা তাদের পাহাড় কাটা।
রোহিঙ্গাদের প্রয়োজন ছাড়াও মানবিক সেবার নাম ভাঙিয়ে নিজেদের সুবিধার জন্য বনভূমির পাহার কেটে অফিস, গুদাম, গাড়ি পার্কিংসহ নানা প্রকার স্থাপনা তৈরি করছে।সংশি¬ষ্ট কর্তৃপক্ষের কোনো প্রকার অনুমতি ব্যতিরেকে নির্বিচারে পাহাড় কেটে তাদের ব্যক্তিগত গাড়ি চলাচলের জন্য তৈরি করা হচ্ছে রাস্তা।
আর পরিবেশ সংশি¬ষ্টদের অভিযোগ যত্রতত্র পাহাড় কর্তনের ফলে জীববৈচিত্র্য,বন্য পশু-প্রাণি বাস্তুচ্যুত হয়ে পড়েছে।পাশাপাশি অপরিকল্পিতভাবে পাহাড় ধ্বংসের কারণে আসন্ন বর্ষা মৌসুমে রোহিঙ্গাদের ব্যাপক প্রাণহাণি সহ মারাত্মক পরিবেশ বিপর্যয়ের আশঙ্কা করছেন পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো।
গত মঙ্গলবার কক্সবাজারের বালুখালী ১৮নং ক্যাম্পের ৫১ নং ব্লকের এসএস জোনে ঘুরে দেখা গেছে আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থ্যা আইওএম এর কয়েকজন কর্মকর্তার নির্দেশনায় শত ফুট উচ্চতার পাহাড়ে প্রকাশ্যে শত শত রোহিঙ্গা শ্রমিক তান্ডব চালাচ্ছে। আর পাহাড় ধ্বংসের জন্য বুলডোজার ও ভরাটের জন্য ব্যবহার হচ্ছে ট্রাক।এভাবে প্রায় দিনরাত পাহাড় কেটে শ্রেণী পরিবর্তন করলেও দেখার বা বলার কেউ নেই।
বনভূমির সংরক্ষণে দায়িত্বরত বনকর্তা ব্যক্তিরা সরকারি দায়িত্ব পালনের বাধ্য বাধকতা থাকলেও পাহাড় নিধন ঠেকানোর বেলায় এসব সরকারি বনবিভাগ,পরিবেশ অধিদপ্তরদের দেখা মেলেনি। এককালের ভয়াবহ গহীণ অরণ্য থাইংখালীর লন্ডাখালী, মধূরছড়া, লম্বাশিয়া এলাকায় নির্বিচারে পাহাড় কর্তনের দৃশ্য অবাক হওয়ার মতই।
আর দেশের স্বনামধন্য পরিবেশবাদী সংগঠন ও বিজ্ঞ পরিবেশবিদদের রহস্যময় নিরবতার কারণে কক্সবাজারে আবারও ভুমি ধ্বসে ব্যাপক প্রাণহানি এবং মারাত্মক পরিবেশ বিপর্যয়ের আশংকা রয়েছে।
উখিয়ার রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সংগ্রাম কমিটি সহ কয়েকটি পরিবেশবাদী সংগঠনের নেতৃবৃন্দরা সোমবার ও মঙ্গলবার দুই দিন পালংখালী ইউনিয়নের গভীর অরণ্য তাজনিমার খোলা রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অদূরে লন্ডাখালী, ময়নারঘোনা ঘুরে স্থানীয় সাংবাদিকদের জানান, তাজনিমারখোলা রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে প্রায় দুই কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে হাজার হাজার রোহিঙ্গা শ্রমিক ছোট-বড় প্রায় অর্ধশত পাহাড় কেটে শ্রেণী পরিবর্তন করছে।
তারা জানান, আইওএম, রেডক্রিসেন্ট(আইসিআরসি), কারিতাস, অক্সফার্ম, ওয়াল্ডভিশন, ডাব্লিউএফপি, ইউএনএইচসিআর সহ বেশ কিছু প্রভাবশালী বিদেশী এনজিও সংস্থার বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণের উদ্দেশ্যে এসব পাহাড় গুলো কেটে ন্যাড়া করা হচ্ছে।
উপজেলা সদর রাজাপালং ইউনিয়নের বন্যপশু প্রাণির অভয়ারন্য মধুরছড়া, লম্বাশিয়া এলাকায় অর্ধশত বুলডোজার দিয়ে পাহাড় কেটে শ্রেণী পরিবর্তন করা হচ্ছে, আর অর্ধশত ডাম্পার গাড়ীতে করে মাটিগুলো অন্যত্র নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। মাটি কাটার কাজে নিয়োজিত রোহিঙ্গা শ্রমিকদের সাথে কথা বলে জানা যায়, তারা দৈনিক সাড়ে তিনশত টাকা মজুরীতে পাহাড় কাটছে।
এসময় সেখানে উপস্থিত আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থ্যা আইওএম এর সুপারভাইজার মোঃ শরীফ জানান, প্রতিদিন ৩হাজার রোহিঙ্গা শ্রমিক মাটি কাটার কাজ করছে। পাহাড় কাটার অনুমতি নেওয়া হয়েছে কিনা জানতে চাওয়া হলে তিনি ওই সুপারভাইজার উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করতে বলে সেখান থেকে সরে পড়েন।
পরে মাটি কাটার শ্রমিকদের হেড মাঝি শরিফুল্লাহ জানান, এখানে প্রায় অর্ধশতাধিক পাহাড় কাটার জন্য গত একমাস আগে থেকে কাজ শুরু করেছে।এ পর্যন্ত প্রায় ৩০-৩৫টি পাহাড় কাটার কাজ শেষ হয়েছে।
ঘটনাস্থল লন্ডাখালী থেকে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের সড়কপথে প্রায় ৫ কিলোমিটার উত্তরে রাজাপালং ইউনিয়নের মধুরছড়া ও লম্বাশিয়া এলাকার ঘুরে দেখা যায়, প্রায় অর্ধশত বুলডোজার পাহাড় কেটে শ্রেণী পরিবর্তন করছে। সেখানে স্থানীয় কয়েকজন গ্রামবাসির সাথে কথা বলে জানা গেছে, এনজিওরা কারো বিধিনিষেধ মানছেনা। তাদের ইচ্ছামতো বনভূমির পাহাড় দখলও নির্বিচারে কর্তন করছে।
এ ব্যাপারে জানতে কক্সবাজার দক্ষিণ বিভাগীয় বন কর্মকর্তা আলী কবির জানান, রোহিঙ্গাদের আশ্রয়ের জন্য ৫ হাজার একর বনভূমি দেওয়া হয়েছে। ইতোমধ্যেই আরো ৫০০ একর বনভূমি চাহিদা দিয়েছে জেলা প্রশাসন। তিনি বলেন, রোহিঙ্গাদের থাকার জন্য বনভূমির জায়গা দেওয়া হলেও পাহাড় কাটার কোনো প্রকার অনুমতি দেওয়া হয়নি। কিন্তু কিছু এনজিও সংস্থা কারো আদেশ নির্দেশের তোয়াক্কা না করে নির্বিচারে পাহাড় কেটে শ্রেণি পরিবর্তন করায় বনসম্পদ, জীববৈচিত্র্য ও বন্য পশু-প্রাণি বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে চলে গেছে। তিনি পাহাড় কাটার ব্যাপারে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নিকট অবহিত করা হয়েছে বলে সাংবাদিকদের জানান।
কক্সাবাজর পরিবেশ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক সাইফুল আশরাফ কক্সবাংলাকে জানান, মানবিক কারণে সরকারি বনাঞ্চলে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়া হলেও পাহাড় কাটার কোনো অনুমতি দেওয়া হয়নি।
তিনি জানান, আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থ্যা আইওএম সহ কয়েকটি বিদেশী এনজিও’র বিরুদ্ধে ব্যাপক পাহাড় কাটার অভিযোগ রয়েছে।ইতিমধ্যে আমাদের মন্ত্রী মহোদয়,পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক সহ উর্দ্ধতন কর্মকর্তারা রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বিভিন্ন এলাকা সরজমিন পরিদর্শন করেছেন।আর পাহাড় কাটার দায়ে এনজিও কারিতাসকে নোটিশ প্রদান করা হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, এলাকার পরিবেশ, জীববৈচিত্র্য ও বন্য পশু-প্রাণি সংরক্ষণে নির্ধারিত অভয়ারণ্যের এসব পাহাড় কাটার ফলে পরিবেশ বিপর্যয়ের সম্ভাবনা থাকায় আরও পদক্ষেপ নেয়া হবে।
এ ব্যাপারে পরিবেশবাদী সংগঠন কক্সবাজার বন পরিবেশ সংরক্ষণ পরিষদের সাবেক সাধারন সম্পাদক সাংবাদিক চঞ্চল দাশগুপ্ত জানান,এনজিওরা বর্ষা মৌসুমে রোহিঙ্গাদের ব্যাপক প্রাণহানি হবে বলে প্রচার চালাচ্ছে তা মূলত অর্থসহায়তার জন্য। অথচ তাদের পরিবেশ বিধ্বংসী কর্মকান্ডের জন্যই ঘটবে উখিয়া ও বালুখালী জুড়ে পাহাড় ধ্বসের মৃত্যূর মিছিল। এ কারণেই তাদের অপকর্ম ঠেকাতে আগেভাগেই প্রচারনা চালানো হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, সরকারী প্রনোদনায় রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আইওএম সহ বিদেশী এনজিওরা যেভাবে পরিবেশ বিধ্বংসী কর্মকান্ডে লিপ্ত রয়েছে তার পরিণতি কক্সবাজারবাসীকেই ভোগ করতে হবে। আর বনবিভাগ ও পরিবেশ অধিদপ্তর যে কুম্ভকর্ণের ভূমিকা নিয়েছে তা খুবই হতাশার এবং লজ্জাজনক। তাই বসন্তের কোকিল এসব এনজিদের পাহাড় কাটা সহ পরিবেশ বিধ্বংসী কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে জেলাবাসীকে সোচ্চার সহ কঠোর আন্দোলন করতে হবে।
কক্সবাজার শরনার্থী ত্রাণও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোঃ আবুল কালাম জানান, ঝুকিপূর্ণ এলাকা থেকে রোহিঙ্গাদের সরিয়ে নিতে সরকার আরো ৫৪০একর বনভূমি-পাহাড় বরাদ্দ দিয়েছে। যেসব রোহিঙ্গা ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে তাদেরও নিরাপদ জায়গা সরিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা সরকারের রয়েছে। সেই হিসেবে বৃহত্তর স্বার্থ রোহিঙ্গা সমস্যাকে প্রাধান্য দিয়ে বনভূমির কিছুটা ক্ষতি হলেও রোহিঙ্গাদের স্বাভাবিক জীবনযাপন নিশ্চিত করতে সরকার যেকোনো কিছু ছাড় দিতে প্রস্তুত রয়েছে। তাই ওসব এলাকায় বর্ষার আগেই ঝুকিপূর্ণ রোহিঙ্গাদের নিরাপদ স্থানে স্থানান্তর করতে এনজিওরা কাজ করছে। তবে ঢালাও ভাবে পাহাড় কাটার বিষয়টি তিনি খতিয়ে দেখবেন বলে আশ্বস্থ করেন।
Posted ৬:৫৪ অপরাহ্ণ | শুক্রবার, ১১ মে ২০১৮
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta