কক্সবাংলা রিপোর্ট(২৫ ফেব্রুয়ারী) :: যেখানে ইচ্ছা ছোটাছুটি, দৌড়ঝাঁপ করতাম। এখন পারি না। মা বেরোতে দেন না। একনাগাড়ে বলে যায় রহিম। ১২ বছর বয়স ওর, তানজিমের খোলায় বাড়ি। রহিমের চেয়ে দুই বছরের বড় আজিজা। ঘর থেকে বেরোনো বন্ধ তারও। বরমাপাড়ার বাড়িতে আটকে থাকতে হয়। খেলাধুলা তো বটেই, পানি আনতে, লাকড়ি কুড়াতে যাওয়াও বন্ধ। শিশু পাচারের খবর আসে প্রায়ই। চারপাশে এত মানুষ। এ কারণে মা-বাবা তাকে বেরোতে দেন না।
রহিম আর আজিজার মতো অবস্থা ওদের সমবয়সী অনেকের। নিরাপত্তা জনিত শঙ্কায় বাধা পড়েছে তাদের স্বাধীনতা। শরণার্থীর ভিড়ে অর্থনৈতিক চাপে ছন্দ হারিয়েছে তাদের পরিবারের জীবনযাত্রা। সব মিলিয়ে ব্যাহত হয়েছে শৈশব, হারাতে চলেছে সারল্য।
কক্সবাজারে রোহিঙ্গা সংকটে স্থানীয় শিশুদের এ দুর্যোগের কথা উঠে এসেছে তাদেরই জবানিতে। এ নিয়ে ওয়ার্ল্ড ভিশন, সেভ দ্য চিলড্রেন ও প্ল্যান ইন্টারন্যাশনালের এক গবেষণা প্রতিবেদন রাজধানীতে প্রকাশ হয়েছে।
‘চাইল্ডহুড ইন্টারাপটেড: চিলড্রেন’স ভয়েসেস ফ্রম দ্য রোহিঙ্গা রিফিউজি ক্রাইসিস’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনে আলো পড়েছে রোহিঙ্গা সংকটে অত্যন্ত কম আলোচিত একটি বিষয়ে। দেশত্যাগের আগে-পরে রোহিঙ্গা শিশুদের দুর্ভোগের কথা উঠে আসছে প্রায়ই। কিন্তু শরণার্থী সংকটের কারণে প্রতিনিয়ত আতঙ্ক আর ভয়ে হারাতে যাওয়া স্থানীয় শিশুর শৈশবের চিত্রটি এ প্রতিবেদনে স্পষ্ট হয়েছে।
লাম্বাশিপাড়ার শিশু ফয়সাল। আগস্টের শেষ দিকে রোহিঙ্গা শরণার্থীর ঢল নামে। টেকনাফের পথে-ঘাটে উদ্বাস্তু মানুষের ভিড় জমে। মাথাগোঁজার জায়গা নেই কারো। ফয়সালের বাবা সহানুভূতিশীল হয়ে একটি আশ্রয়হীন পরিবারকে নিজের বাড়ির উঠানে ঠাঁই দেন। শরণার্থীর ঢল থামেনি। উঠান-বাড়ি ছাপিয়ে চাষের জমিতেও আশ্রয় নেয় মানুষ। চারপাশে আশ্রয়হীন মানুষের ছাউনি। সেই সঙ্গে অচেনা চোখের চাহনি।
এদিকে অপহরণ-নির্যাতনের খবর শোনা যায়। কাকে বিশ্বাস আর কাকে সন্দেহ করতে হয় তার ফারাক বোঝা দুষ্কর হয়ে পড়ে। ফয়সাল ও তার বোনের চলাফেরা বাঁধা পড়ে চার দেয়ালের ভেতর।
শরণার্থীরা জমিজমায় আশ্রয় নেয়ায় ব্যাহত হয় চাষাবাদ। পরিবারের আয়ে টান পড়ে। মানুষের ভিড় ও চাহিদার কারণে বেড়ে যায় যানবাহনের ভাড়া। ভিড় ঠেলে শিশুদের রিকশা ও ভ্যানে স্কুলে নেয়া আরো ব্যয়বহুল হয়ে ওঠে। রোহিঙ্গারা আশ্রয় নেওয়ায় অনেক স্কুলে ক্লাসও বন্ধ হয়েছিল। মাঠে-জমিতে আশ্রিত মানুষের আবর্জনা-মলমূত্রের কারণে কলুষিত হয় খালের আর কুয়ার পানি। কিন্তু অচেনা মানুষের ভিড়ে অন্য কোথাও পানি আনতে যাওয়াও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ে।
আরেক শিশুর কথা বলা যায়। ধরা যাক তার নাম রেহানা। রান্নার জন্য পানি, লাকড়ি আনতে রেহানা মায়ের সঙ্গে যেত। বনে-বাদাড়ে কাঠ-লাকড়ি সংগ্রহ নিয়ে রোহিঙ্গাদের সঙ্গে স্থানীয়দের মৃদু টানাপড়েন চলে। তাছাড়া বাড়ির উঠানে অনিরাপদ মনে হলে অতদূর যাওয়ার সাধ্য কার। খেলাধুলা-দৌড়ঝাঁপে বাধার কারণে হারাচ্ছে শিশুর উচ্ছ্বাস। নিয়মিত আতঙ্ক আর শঙ্কায় হারিয়ে যাচ্ছে সারল্য। বর্ণহীন দিনযাপনের ধারাবাহিকতায় মুছে যাচ্ছে শৈশব।
গবেষণায় দেখা গেছে, শরণার্থী শিবিরের পরিবারগুলো শিশু-কিশোরের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে শৌচাগার, স্নানঘরে যেতে ভয় পায় কিশোরী-তরুণীরা। শরণার্থীপ্রবণ অনেক লোকালয়েও পরিস্থিতি তেমন হতে চলেছে।
রোহিঙ্গা পরিবারের কিশোরীকে নিরাপত্তাজনিত শঙ্কায় ত্রাণ আনতে যেতে বারণ করে পরিবার। স্থানীয় পরিবারের কিশোরীকে স্কুলে যেতে বারণ করা হয়েছে একই উদ্বেগ থেকে। রোহিঙ্গা ক্যাম্প ও আশ্রয়কেন্দ্রে থাকা অনেক পরিবার নিজেদের ছাউনি বা ঘরের ভেতরেও সন্তানের অপহরণের ভয়ে শঙ্কিত থাকে। নিজ ঘরে থেকেও এ শঙ্কার আওতামুক্ত থাকতে পারছে না কক্সবাজারের অনেক পরিবার।
Posted ২:১৯ পূর্বাহ্ণ | সোমবার, ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৮
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta