ভালো আমার লাগে নি কোনদিন, আজও লাগে না । কিন্তু পরিস্থিতির ছোবল এমনই যে ভালো না লাগলেও আর ফিরে যাওয়া সম্ভব হয় নি । তারপর তো বাবা মা’কে ও এখানেই নিয়ে এলাম । বাবা মা এখানেই আমাদের সাথে আছেন তাও তো এক যুগ পার হয়ে গেলো । বাবার কদিন আগে ৯০তম জন্মদিন গেলো । তাঁর খুবই ইচ্ছে, একবার দেশে যাবেন – দেশে তাঁর একমাত্র মেয়ের ঘরের নাতনীর বিয়ে হয়েছে, নাতনীর ঘরে দুটো মেয়ে, তাঁর প্রিয় বড় নাতি বিয়ে করেছে, সেই নাতির ঘরেও একটি ফুটফুটে কন্যা এসেছে । ছোট ছেলের মেয়েটিকে ৪ বছরের ছোট রেখে এসেছিলেন, সে এবারে স্কুল ফাইনাল দেবে, তারপরে ছোট একটি নাতি হয়েছে । দেখতে একেবারে রাজপুত্রের মতো। ওদের কাউকে দেখেন নি মা, বাবা – এখানে আসার পরেই জন্ম ওদের । আর তাঁদের যাওয়া হয়নি । আমিও দেখিনি -অসুস্থ বাবা মা কে রেখে আমারও যাওয়া সম্ভব হয় নি । কিন্তু বাবার শরীরের অবস্থা এমন যে, আর যাওয়াও সম্ভব হবে না । দেখাও হয়তো আর এই জীবনে হবে না ।
বেদনাতুর বাবা মা’র মুখের দিকে তাকিয়ে নিজেকে বড্ড অপরাধী মনে হয় । দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের উত্তাল সময়ে বাবার জীবনযুদ্ধ শুরু হয়েছিলো । নানা ঘাত প্রতিঘাতের চড়াই উৎরাই পেরিয়ে এসেছেন বাবা । ভেবেছিলাম, শেষ বয়সে বাবাকে এখানে এনে কিছুটা নিবিড় শান্তি দিতে পারবো । কিন্তু পরবাস যে শান্তি দেয় না, তা তখন বুঝতে পারিনি । কতদিন দেখিনা ছোট ভাইবোনের মুখ । প্রিয় আত্মীয়স্বজন, বন্ধুদের মুখ । দেখিনি পরিবারের, পাড়ার কত নুতন সদস্যদের, যে পাড়ার প্রায় সকলের বাড়ীতেই একসময় আমি সন্তানের আদর পেয়েছি।
ছোট ভাইটি যখন জন্ম হয়েছিল- তখন আমার বয়স আট, আর আমার ছোট বোনের পাঁচ । আমাদের পাড়ার একজন ছিলেন রমেশ জ্যাঠা – স্বর্ণকার ছিলেন , অসাধারণ ছিল তাঁর হাতের কাজ । যেই তিনি দেখতেন যে, আমরা দুই ভাইবোন হাত ধরাধরি করে স্কুলে যাচ্ছি – রমেশ জ্যাঠা উচ্চস্বরে স্বগতোক্তি করতেন , এই রে -ওরা দুই ভাইবোন তো স্কুলে চলে যাচ্ছে দেখি, এই তো সুযোগ, ওদের ছোট ভাইটাকে নিয়ে আসার’। বলেই তিনি আমাদের বাড়ীর দিকে হাঁটা দিতেন । আমরা দুজন তো তা’ দেখে মরি পড়ি করে ছুটে কাঁদতে কাঁদতে বাড়ী ফিরে এসে সদ্যোজাত ফুটফুটে ভাইটাকে জড়িয়ে ধরে রাখতাম ।
যতই বাবা মা বোঝাতেন যে, রমেশ জ্যাঠা আমাদের ক্ষেপাচ্ছেন, আমরা শুনতাম না । আমার সব চাইতে আনন্দের দিন ছিল যেদিন দেখি যে, আমার ছোট ভাইটি হামাগুঁড়ি দিতে শিখেছে । কি এক অজানা আনন্দে ও উত্তেজনায় টইটুম্বুর হয়েছিলাম সেই কয়েকটি দিন । সেই ভাইবোনকেও দেখতে পাই না অনেকবছর । ডিজিটাল যুগের কল্যাণে ফেইসটাইমে বা ইমো’তে মাঝে মধ্যে দেখতে পাই শুধু । একটা হাহাকারের ঝড় সারাক্ষণ নিভৃতে বুকের মধ্যে চলছে বুঝতে পারি । পরবাসীদের বুকে এই হাহাকার যে নিত্যদিনের সাথী, তাতো আমরা জানিই ।
আজ ভোর থেকে তুষারপাত শুরু হয়েছে, বিরামহীন তুষারপাত । রাস্তায় খুব বেশী জনমানব নেই । এখানকার মানুষের জীবনযাত্রায় তুষারপাত খুব একটা ছন্দপতন ঘটায় না । আমাদের পাড়ার এক অশিতীপর বুড়ি দেখি রাস্তার একতাল বরফের মধ্যেই ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছেন বাজারের দিকে । চলতে যে তাঁর কষ্ট হচ্ছে, কোন সন্দেহ নেই । বললাম, তোমার কি বাজার থেকে কিছু লাগবে বলো, আমি বা আমার মেয়ে তোমাকে এনে দেবো । এমন বরফে তোমার তো কষ্ট হচ্ছে হাঁটতে । বয়সের তীব্র ছাপ পড়া গালে আগণ্ডবিস্তৃত হাসি মেলে বললেন , চিন্তা করো না, আমি ঠিক ম্যানেজ করে নেবো । এমন বরফ তো এবছর প্রথম পড়লো, একটু নাহয় উপভোগ করেই নিই ।
কি আর বলতে পারি, এমনই জীবন অভিলাষী মানুষকে ! মাথা নেড়ে সায় জানানো ছাড়া আর গত্যন্তর কি ! বাবাকে বললাম, বাবা – দেখবে নাকি একটু জানালা দিয়ে তুষারপাত ! একটু অবাক চোখে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে -কম্বলটা মুখের উপর আরেকটু টেনে নিয়ে বললেন, না বাবা, বরফ পড়া আর কি দেখার আছে !
জানলার কাছে এসে আমি একাই বসে রইলাম, বিরামহীন তুষারপাতে চারিদিক শ্বেতশুভ্র হয়ে আছে । গাড়ী, বাড়ী, রাস্তাঘাট, পত্রবিহীন নগ্ন বৃক্ষ শাখা – সবই তুষারে তুষারে ছেয়ে আছে । আর কানে বাজছে এই পরবাসে ভালো থাকার চেষ্টার একমাত্র অবলম্বন- আলখাল্লা বুড়োর প্রিয় গান :
আজি ঝড়ের রাতে তোমার অভিসার – পরাণসখা, বন্ধু হে আমার !
Posted ১১:২৬ অপরাহ্ণ | মঙ্গলবার, ০৭ জানুয়ারি ২০২০
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta