কক্সবংলা ডটকম(২২ মে) :: ভারতে চিকিৎসা করাতে এসে ‘খুন’ বাংলাদেশের ঝিনাইদহ-৪ আসনের আওয়ামি লিগের ৩ বারের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিম!
গত ৮ দিন ধরে নিখোঁজ থাকার পর বাংলাদেশের শাসকদল আওয়ামি লিগের ৩ বারের সাংসদের মৃত্যু হয়েছে বলে দাবি করা হচ্ছে।
গোটা ঘটনার তদন্ত শুরু করেছে পুলিশ। এই ঘটনায় রীতিমতো শোরগোল শুরু হয়েছে দুই দেশের কূটনৈতিক মহলে।
জানা যাচ্ছে, নিখোঁজ সাংসদের তদন্তে নেমে পুলিশের কাছে উঠে আসছে খুনের তত্ত্ব।
হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির নেতা সৈয়দ আমান উল্লাহসহ তিনজকে হেফাজতে নিয়েছে গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)।
বাকিদের পরিচয় এখনো জানা যায়নি।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) একটি সূত্র বুধবার রাতে এ তথ্য নিশ্চিত করেছে।
সূত্রটি জানায়, এমপি আনারকে খুন করতে দুজনকে নিয়োগ করেছিলেন সৈয়দ আমান উল্লাহ। তাদেরকে পাসপোর্ট করে ভারতে পাঠান তিনি। জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আমানহ বেশ কয়েকজনকে ডিবি কার্যালয়ে আনা হয়েছে।
টানা ৯ দিন নিখোঁজ থাকার পর আজ ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের সঞ্জিভা গার্ডেনের একটি ফ্ল্যাট থেকে ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিম আনারের খণ্ডবিখণ্ড লাশ উদ্ধার করা হয়।
গত ১৩ তারিখ নিউটাউনের আবাসনে তাকে হত্যা করা হয়। তারপর তিনদিন ধরে তার মরদেহ টুকরো টুকরো করে ডিসপোজ করা হয়। ফ্রিজেও রেখে দেওয়া হয়েছিল দেহের অংশ। এসব তথ্য জানিয়েছে ভারতীয় পুলিশ।
আরও জানা গেছে, যে ফ্ল্যাট থেকে আনোয়ারুল আজিম আনারের খণ্ডবিখণ্ড লাশ উদ্ধার করা হয়েছে, তার মালিকও একজন বাংলাদেশি।
সূত্রটি আরও জানায়, এমপি আনারের দেহাংশ ফেলার দায়িত্বে ছিল অন্য কেউ। তাদের হদিস পাওয়া গেলেই জানা যাবে কোথায় কোথায় দেহাংশ ফেলা হয়েছে। ওই আবাসনের ফ্ল্যাট থেকে বেশকিছু প্লাস্টিক ব্যাগ পাওয়া গেছে। পুলিশের প্রাথমিক অনুমান ওই ব্যাগ গুলোতে করেই দেহাংশ ফেলা হয়েছে।
এর আগে বুধবার বিকালে এক সংবাদ সম্মেলনে পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের মহাপরিদর্শক (সিআইডি) অখিলেশ চতুর্বেদী বলেন, কিছু প্রমাণের ভিত্তিতে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে এমপি আনোয়ারুল আজীম আনারকে হত্যা করা হয়েছে।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের এমপি আনোয়ারুল আজিমের মরদেহ এখনো পায়নি পুলিশ। তবে কিছু প্রমাণের ভিত্তিতে মনে করা হচ্ছে, এই সংসদ সদস্যকে হত্যা করা হয়েছে।’ এ ঘটনার তদন্ত পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) হাতে নিয়েছে বলে জানান অখিলেশ চতুর্বেদী।
সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমরা কিছু সুনির্দিষ্ট তথ্য পেয়েছি, যার ভিত্তিতে মনে করা হচ্ছে যে ওনাকে হত্যা করা হয়েছে।
তিনি ভারতে গিয়ে ভুয়া কাগজপত্র বানিয়ে ওই ফ্ল্যাট কিনেছেন। কলকাতার পুলিশ তাকেও খুঁজছে বলে জানানো হয়েছে।
কলকাতা বিধাননগর পুলিশের ডেপুটি পুলিশ কমিশনার মানব শ্রিংলা বলেছেন, ক্যাব চালক স্বীকারোক্তি দিয়েছে ১৩ মে যে ব্যক্তিকে সে গাড়িতে তুলেছিল তাকে হত্যার পর টুকরো টুকরো করে লাশ ছড়িয়ে দিয়েছে।
পুলিশের কর্মকর্তারা বলেছেন, যে ফ্ল্যাটে তাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে বলে সিসিটিভি ফুটেজে দেখা গেছে; সেটি পুলিশ ঘিরে রেখেছে। সেখানে কাউকে এখনো ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না।
পুলিশের সূত্র বলেছে, ওই ফ্ল্যাটে তিনজনকে ঢুকতে সিসিটিভি ফুটেজে দেখা গেছে। তাদের মধ্যে একজন নারী। তবে ওই তিনজনকে সেখান থেকে বের হতে আর দেখা যায়নি।
বাংলাদেশের সাংসদ আনোয়ার-উল-আজিমের গাড়ি আগেই উদ্ধার করেছিল নিউটাউন থানার পুলিশ। বেশ কয়েকদিন ধরেই ঘটনার তদন্ত চালানো হচ্ছিল । ঘটনায় জড়িত সন্দেহে মোট ৩ সন্দেহভাজনকে আগেই আটক করা হয়েছিল। তাঁদের বয়ানের সূত্র ধরেই বাংলাদেশের সাংসদের রহস্যজনক অন্তর্ধান-তদন্তে বুধবার নিউটাউনের একটি আবাসনে তল্লাশি চালায় বিধাননগর কমিশনারেটের পুলিশ।
এদিকে ভারতে খুন হওয়া সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিম আনারের হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় সন্দেহভাজন হিসেবে নাম এসেছে বাংলাদেশি আকতারুজ্জামানের। তিনি যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করেন।
এমপি আনার যে বাসায় খুন হয়েছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে ওই বাসাটি আকতারুজ্জামানই ভাড়া নিয়েছিলেন।
আনার ভারতে অবস্থানকালে আকতারুজ্জামানও সেখানে ছিলেন। যে ফ্ল্যাটে আনার খুন হন বলে ধারণা করা হচ্ছে সেই ফ্ল্যাটে আকতারুজ্জামানও ছিলেন।
যুক্তরাষ্ট্রের পাসপোর্টধারী আকতারুজ্জামান ঝিনাইদহের বাসিন্দা বলে জানা গেছে। আনার খুনের পর তিনি নেপাল, দুবাই হয়ে যুক্তরাষ্ট্রে চলে গেছেন বলে একাধিক সূত্র জানিয়েছে।
গত ২০শে মে ভিসতারা এয়ারে দিল্লি থেকে আকতারুজ্জামান নেপালের কাঠমান্ডু চলে যান। পরের দিন ফ্লাই দুবাইয়ে করে তিনি দুবাই চলে যান। তার পরবর্তী গন্তব্য যুক্তরাষ্ট্র বলে জানা গেছে।
ওদিকে পশ্চিমবঙ্গ সিআইডি’র প্রধান জানিয়েছেন, পূর্ব কলকাতার নিউ টাউন অঞ্চলে যে ফ্ল্যাটে আনোয়ারুল আজিম উঠেছিলেন, সেটি পশ্চিমবঙ্গ সরকারের আবগারি দপ্তরের কর্মকর্তা সন্দ্বীপ কুমার রায়ের।
সন্দ্বীপের কাছ থেকে ফ্ল্যাটটি ভাড়া নিয়েছিলেন আকতারুজ্জামান। আকতারুজ্জামানই ওই ফ্ল্যাটে আনোয়ারুল আজিম আনারের থাকার ব্যবস্থা করেছিলেন কিনাÑ তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
দেহ টুকরো করে লোপাট ?
সূত্রের খবর, আবাসনের CC ক্যামেরার ফুটেজে ধরা পড়েছে, যে ৩ জন ব্যক্তি সাংসদের সঙ্গে ছিলেন, পরে তাঁরা বেরিয়ে গেলেও সাংসদকে বার হতে দেখা যায়নি। পুলিশ ওই ফ্ল্যাটের মেঝে , বেসিনে চাপ-চাপ রক্তের দাগ পায়। তার থেকেই তাঁদের সন্দেহ হয় খুনের পর ওই সাংসদের দেহ টুকরো করে কোথাও লোকানো হয়েছে। এখনও পর্যন্ত বোঝা যাচ্ছে না, তাঁর দেহ কোথায় ! তবে পুলিশের ধারণা, ওই আবাসনের মধ্যেই কোথাও লোকানো আছে দেহ বা দেহাংশ।
পুলিশ সূত্রে খবর, ১২ মে ভারতে আসেন বাংলাদেশের সাংসদ আনোয়ার-উল-আজিম। দুই ব্যক্তিকে নিয়ে বরানগরে এক পরিচিতর বাড়িতে যান। পরিচিতর দাবি, প্রথমে চিকিৎসককে দেখাতে যাচ্ছেন বললেও, পরে সাংসদ জানান দিল্লিতে তাঁর জরুরি বৈঠক রয়েছে। তারপর থেকেই বাংলাদেশের সাংসদের খোঁজ মিলছে না বলে অভিযোগ।
শেষ মেসেজ নিয়ে নানা রহস্য
বাংলাদেশের ঝিনাইদহ-৪ আসনের আওয়ামী লীগের সাংসদ আনারুল আজিম আনারের শেষ মেসেজ নিয়েও আছে নানা রহস্য। গত ১২ তারিখে তিনি চিকিৎসার জন্য এসেছিলেন কলকাতায়। তার পরের দিন থেকেই খোঁজ পাওয়া যাচ্ছিল না তাঁর। এদিকে তাঁর মোবাইল বন্ধ থাকলেও দীর্ঘদিনের পরিচিত, বরাহনগরের বাসিন্দা গোপাল বিশ্বাসকে হোয়াটস অ্যাপে মেসেজ পাঠিয়েছিলেন।
তাঁকে ফোন করার দরকার নেই বলেও সেই মেসেজে লিখেছিলেন আনার। আর এই মেসেজ ঘিরেও বেড়েছে রহস্য। ফোনে কথা না বলে কেন তিনি সেই মেসেজ পাঠিয়েছিলেন তা নিয়েও নানা প্রশ্ন উঠছে।
কী লিখেছিলেন আনার?
গত ১২ তারিখ সন্ধ্যায় আনার আসেন গোপাল বিশ্বাসের বাড়িতে। পরের দিন তিনি চিকিৎসক দেখানোর জন্য বার হন। কিন্তু সেদিন থেকেই আর খোঁজ পাওয়া যাচ্ছিল না তাঁর। তাঁকে না পেয়ে উদ্বিগ্ন হন পরিবারের লোকজন। এদিকে, গত ১৮ তারিখে বরাহনগর থানায় একটি নিখোঁজ ডায়রি করেন গোপাল বিশ্বাস। তাতে তিনি পুরো বিষয়টি উল্লেখ করে লেখেন যে ১৩ তারিখ দুপুর ১টা ৪০মিনিট নাগাদ ডাক্তার দেখানোর কথা বলে বাইরে যান আনার।
দুপুরে যাওয়ার সময়ে আনার তাঁকে বলে যান যে তিনি সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরবেন। কিন্তু সেদিন সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে না এসে তাঁকে হোয়াটস্অ্যাপে মেসেজ পাঠান আনার। তাতে আওয়ামী লীগের ওই সাংসদ লেখেন যে ‘বিশেষ কাজে দিল্লি চলে যাচ্ছি এবং পৌঁছে ফোন করব। তোমাদের ফোন করার দরকার নেই।’
এর পরে, ১৫ তারিখে আনার আরেকটি মেসেজ পাঠান। আনার যে দিল্লি পৌঁচেছেন তা জানানো হয় ওই মেসেজে। তাতে লেখা হয় ‘আমার সঙ্গে ভিআইপিরা আছেন, ফোন করার দরকার নেই।’ আনোয়ারুল আজিমের নম্বর থেকে আসা ওই মেসেজ গোপাল বিশ্বাস পাঠিয়ে দেন আনারের বাড়ির লোকজন এবং ব্যক্তিগত সহকারীকে আবদুর রউফকেও।
মোবাইল ট্র্যাক
এদিকে ‘নিখোঁজ’ হওয়ার পর থেকে প্রায় সময়েই বন্ধ ছিল আনারের মোবাইল ফোন। তিনি ভারতে এসে দুটি ফোন ব্যবহার করছিলেন । দুটিই বন্ধ থাকলেও মাঝে মধ্যে চালু করা হয়। পুলিশ তাঁর মোবাইল লোকেশন ট্র্যাক করে। বিভিন্ন জায়গায় সেই মোবাইল ট্র্যাক করা হয়। বরাহনগরের বন্ধুর বাড়ি থেকে বের হওয়ার পর তার মোবাইলের লোকেশন একবার পাওয়া গিয়েছিল নিউমার্কেট এলাকায়।
এরপর ১৭ই মে তাঁর ফোন কিছুক্ষণের জন্য সচল ছিল বিহারের কোনও জায়গায়। অসম এবং উত্তর প্রদেশে সেটা দেখানোর সঙ্গে ওই মোবাইল ট্র্যাক করা হয় বাংলাদেশ এবং ভারতের সীমান্তবর্তী এলাকাতেও। তবে, ওই মেসেজ আজিম নিজেই লিখেছিলেন কী না তা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে।
ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিম বাংলাদেশের কিছু অপরাধীর হাতে নৃশংসভাবে খুন হয়েছেন বলে জানিয়েছেন ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (গোয়েন্দা) মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ। আজ বুধবার বেলা সোয়া দুইটার দিকে রাজধানীর মিন্টো রোডে ডিবি কার্যালয়ে সাংবাদিকদের তিনি এ কথা বলেন।
মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ বলেন, কালিগঞ্জের তিনবারের সংসদ সদস্য আনোয়ারুলের আজিমের ঘটনাটি অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে তদন্ত করা হচ্ছে। এটি একটি নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ড। এটি পারিবারিক, আর্থিক, না কি এলাকার কোনো দুর্বৃত্তকে দমন করার জন্য হয়েছে, তা আমরা তদন্ত করে দেখছি। বিষয়টি নিয়ে আমরা নিবিড়ভাবে ভারতীয় পুলিশের সঙ্গে কাজ করছি। প্রতিক্ষণেই তাঁদের সঙ্গে আমাদের কথা হচ্ছে। অনেক তথ্য পাচ্ছি। তদন্তের স্বার্থে সেসব বিষয় আমরা বলতে চাচ্ছি না।
গোয়েন্দা পুলিশের এই কর্মকর্তা বলেন, সংসদ ভবন এলাকা থেকে সংসদ সদস্য আনোয়ারুল ভারতের উদ্দেশে রওনা হয়েছেন। এ জন্য এ ঘটনায় শেরে বাংলা নগর থানায় আজকের মধ্যে মামলা হবে। তাঁর মেয়ে মামলা করতে সহযোগিতা ও পরামর্শের জন্য আমাদের কাছে এসেছেন। আমরা তাঁর মেয়েকে মামলা করতে সহযোগিতা করব।
মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ বলেন, ‘একজন সংসদ সদস্যকে যেভাবে বাংলাদেশের কিছু অপরাধী নৃশংসভাবে যেভাবে হত্যা করেছে, আমরা তাঁদের কয়েকজনকে আইনের আওতায় নিয়ে এসেছি। তদন্তের স্বার্থে আমরা আটক ব্যক্তিদের নাম বলছি না। বাকিদেরও আইনের আওতায় আনা হবে।’
সংসদ সদস্যের লাশ উদ্ধার হয়েছে কি না—এমন প্রশ্নের কোনো উত্তর দেননি ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (গোয়েন্দা) মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ। পরে ডিবি পুলিশের ওয়ারি বিভাগের উপকমিশনার মো. আ. আহাদ প্রথম আলোকে জানান, লাশ উদ্ধার হয়নি।
এর আগে সংসদ সদস্যের মেয়ে মুমতারিন ফেরদৌস ডিবি কার্যালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন। তিনি তাঁর বাবার খুনিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেন।
Posted ২:৫৭ অপরাহ্ণ | বুধবার, ২২ মে ২০২৪
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta