কক্সবাংলা ডটকম(১২ আগস্ট) :: বিদায়ের সুর বেজে উঠতেই চারদিকেই ভাঙনের আয়োজন। গরু আটকানোর খুঁটিগুলো তুলতে শুরু করেছে কেউ কেউ। ক্রেতাদের আনাগোনাও কমে যাওয়ায় অলস সময় কাটছে অনেক গরুর ব্যাপারী ও বিক্রেতাদের। গরুর পেছনে খরচের হিসেব মেলাতেই ব্যস্ত তারা।
রাজধানী ঢাকা সহ দেশের বিভিন্নপ্রান্তের অস্থায়ী কোরবানির পশুর হাটগুলোতে কাঙ্ক্ষিত দাম না পাওয়ায় চরম হতাশ হয়েছেন বেপারিরা। তাই তারা বিক্রি না করেই গরু ফেরত নিয়ে যাচ্ছেন। শেষের দিন দাম কমে যাওয়ায় বেপারিদের মাথায় হাত।
রবিবার (১১ আগস্ট) রাতে ঢাকার সবচেয়ে বড় গবাদি পশুর হাট গাবতলী বালুঘাট, তেজগাঁও পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট খেলার মাঠ, উত্তরা ১৫ নম্বর সেক্টরে অস্থায়ী কোরবানির পশুর হাট ও আরও কয়েকটি হাটে সরেজমিনে ঘুরে এমন চিত্র দেখা যায়।
গরুর বেপারিরা জানান, বাজারদর পড়ে গেছে। প্রতি গরুতে ১০-২৫ হাজার টাকা লোকসানে বিক্রি করতে হয়েছে। কেনা দামের চেয়েও অনেক কম দাম বলছেন ক্রেতারা। এ কারণে বিক্রি না করেই গরু ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন তারা।
‘মানুষের বিবেক নাই। তারা গরুর বাইন বোঝে না, খালি হস্তায় চায়। তাই ট্যাকার মাল সাগরে ভাসাইয়া দিয়া যামু? দরকার নাই আমি গরু বেস্তাম (বিক্রি) না। বাড়িত লইয়া কাইট্টা (কেটে) খামু। তবুও লস (লোকসান) হইতো না।’ ক্ষোভ প্রকাশ করে কথাগুলো বললেন গরুর বেপারি আজিজুল হক। কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জ থেকে ঢাকার তেজগাঁও পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট খেলার মাঠ অস্থায়ী কোরবানির পশুর হাটে ১২টি গরু নিয়ে এসেছিলেন তিনি। আটটি বিক্রি হলেও চারটি গরু ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন এই বেপারি।
তিনি বলেন, ‘কিশোরগঞ্জ থেকে ১০ হাজার ট্যাকা ট্রাক ভাড়া দিয়ে গাজীপুরের কালবগঞ্জ হাটে গেছিলাম। ওন (সেখান) বাজার দর কম, আর জায়গা পাইছি না, তাই আবার সাত হাজার ট্যাকা ট্রাক ভাড়া দিয়া শনিবার সকালে তেজগাঁও আইছি। এনো (এখানে) বাজার ভালো ছিল, কিন্তু বিকালের পর ডাউন। ৮টা গরু বেচলাম, লাভ অইছে না (হয়নি)। কিতা করাম ১ লাখ ২০ হাজার নাই। ঢাকার মানুষ গরু চিনে না, খালি গোস্তের হিসাব করে। এহন কুন গরু বেস্তাম না। এহন আর লেকসানের কাম নাই বাড়ি যায়াম (যাবো)।’
আরও কয়েকজন বিক্রেতা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন। বিক্রেতারা বলছেন, ‘বাজারে ইন্ডিয়ার গরু নাই, সব দেশি। আমার ৭৭ হাজার ট্যাকার কিনা গরুর দাম কয় ৩৫ হাজার ট্যাকা। শইলডা (শরীর) জ্বলে খালি। কী কয়াম? চুম মাইরা থাকি।’
হাটের প্রথম দুদিন বাজার দর ভালো থাকলেও শেষের দিন (রবিবার) গরুর দাম অনেক কমে গেছে। এর কারণ হিসেবে বেপারিরা বলছেন, দেশি গরুর উৎপাদন অনেক হয়েছে। তাই সব বাজারে চাহিদার তুলনায় বেশি গরু উঠেছে।
জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জ থেকে ১৮টি গরু নিয়ে তেজগাঁও হাটে এসেছিলেন করিম মিয়া ও নাদের হোসেন। তারা ৯টি গরু বিক্রি করেছেন। এতে তাতের গরুপ্রতি ২০ হাজার টাকা লোকসান হয়েছে বলে জানিয়েছেন তারা। শেষদিন কিছু লাভের আশায় থাকলেও গরুর বাজার পড়ে যাওয়ায় বাকি ৯টি গরু ফেরত নিয়ে যাচ্ছেন।
করিম মিয়া বলেন, ‘এক গরুতে ২০ হাজার নাই। এরপর গাড়ি ভাড়া আর খাওন তো বাদই দিলাম। লস (লোকসান) আর দিমু না। যে আশা নিয়া ঢাকা আইসি অহন চোখের পানি মুইছা বাড়ি যাই। নসিব ভালো না।’
এদিকে, রাজধানীর উত্তরায় অস্থায়ী কোরবানির পশুর হাটে রাত ১টা পর্যন্ত গরু থাকতে দেখা গেলেও ২টার পর থেকে সেগুলো ফেরত নিতে ট্রাকে তুলছেন গরু বেপারিরা। রাতে এই বাজারে ক্রেতাসমাগম থাকলেও সেই তুলনায় বিক্রি কম। তবে যাদের একটি করে গরু আছে তারা সকাল পর্যন্ত বাজার দেখে ফিরবেন বলে জানিয়েছেন। এদিকে বড় বাজার বিবেচনা করে বেশ কিছু বেপারি রবিবার দুপুরে এই হাটে এসেছিলেন। তবে বাজারদর কম দেখে গরু নিয়ে ফিরে যাচ্ছেন তারা।
বেপারি লিটন বলেন, ‘রাস্তায় যানজটের কারণে হাটে আসতে দেরি হয়েছে। কিন্তু এই হাটের অবস্থা ভালো না। গরুর দাম নেই। তাই বিক্রি বন্ধ। ১টা গরু ২৭ হাজার টাকা লোকসানে বিক্রি করেছি। কাস্টমার যে দাম কয়, মন চায়– নিজের মাথায় নিজে বাড়ি দিই।’
অন্যদিকে ক্রেতারা বলছেন, বাজারে বেপারিরা গরুর দাম কমাতে চাইছেন না। হাটগুলোতে প্রচুর গরু উঠেছে, কিন্তু ছোট গরুর দামও দ্বিগুণ হাঁকানো হচ্ছে।
বড় গবাদি পশুর হাট গাবতলী বালুঘাটে রাত ৯টা পর্যন্ত গরুর হাট ঘুরে দেখা যায়, হাটের অর্ধেক জায়গা ছিল ফাঁকা। ছোট ও মাঝারি সাইজের গরুর চাহিদা থাকায় সেগুলো দ্রুত বিক্রিও হচ্ছিল। কিন্তু বড় গরুগুলোকে নিয়ে ক্রেতাদের আগ্রহ ছিল কম।
বিকেলের দিকে ব্যাপারীরা বলেন, ‘হাটে ছোট ও মাঝারি গরুর চাহিদা বেশি। তবে বড় সাইজের গরু বিক্রি হচ্ছে না। এ সব গরুর দাম বললে তা শুনেই সরে পড়ছেন ক্রেতারা।’
রবিবার রাত সাড়ে ১০টার দিকে রাজধানীর তেজগাঁও পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট খেলার মাঠে অস্থায়ী কোরবানির পশুর হাটে দেখা যায়, কিছু সংখ্যক গরু থাকলেও পুরো হাট ফাঁকা। যেসব গরু আছে সেগুলো ট্রাকে তুলে ফেরত নিয়ে যাচ্ছেন বেপারিরা। ক্রেতাদের অনেকেই গরুর দাম বলছেন বিক্রেতাদের চাওয়া দামের অর্ধেক। লোকসান এড়াতে অনেকেই গরু ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন।
আসরের পর থেকে হাটে ক্রেতাদের ভিড় বেড়ে গেলেও সেটা ছিল সাময়িক। ক্রেতার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে তাই ব্যাপারীরা প্যান্ডেলের বাইরে থেকে গরু বের করে বেড়িবাঁধ সড়কের উপর গরু নিয়ে দাঁড়িয়ে যায়। তখন বেশ কিছু গরুকে বিক্রি হতে দেখা যায়।
সন্ধ্যার দিকে দুই থেকে আড়াই মণ ওজনের গরু ৭০/৮৫ হাজার টাকায়, তিন সাড়ে তিন মণ ওজনের গরু এক লাখ ১০ থেকে এক লাখ ৩০ হাজারের মধ্যে বিক্রি হতে দেখা গেছে। অথচ মাঝারি ওজনের এসব গরুর দাম গতদিনের চেয়ে প্রকারভেদে ১৫-৩০ হাজার টাকা কম ছিল আজকে।
গরুর বাজারের মন্দাভাবে হতাশ গরু ব্যবসায়ীরা। তারা বলছেন, ‘গরু পুষে আর লাভ হয় না’।
কুষ্টিয়া থেকে সাতটি গরু নিয়ে গাবতলী হাটে এসেছেন ইদ্রিস রহমান। তার সাতটি গরু বিক্রি হলেও মুখে হাসি ছিল না। তিনি বলেন, ‘সবগুলো গরু বিক্রি করে শুধু ক্যাশ টিকছে। এইভাবে দাম পড়লে ব্যবসা হয় না’।
মিটফোর্ডের ওষুধ ব্যবসায়ী নওয়াব হোসেন বলেন, শনিবার তিনি যে আকারের গরু একলাখ ৬ হাজার টাকা দিয়ে কিনেছেন। রোববার তা ৭০ থেকে ৮০ হাজার টাকায় বিক্রি হয়েছে।
সেগুনবাগিচার বাসিন্দা রিয়াজ হোসেন রাব্বি বলেন, “এবার বড় গরুর চেয়ে ছোট গরুর ও মাঝারি গরুর কদর বেশি।”
রোববার খিলগাঁও মেরাদিয়া হাট থেকে একটি গরু তিনি ৯০ হাজার টাকা দিয়ে কিনেছেন, যার মাংস হবে আনুমানিক সাড়ে চার মণ হবে বলে তার ভাষ্য।
তিনি বলেন, “এ গরুটির দাম আরও ৩০ হাজার টাকা বেশি হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু বাজার ডাউন।”
বাজারে বড় গরু সংখ্যা বেশি দেখা যাচ্ছে বলে তিনি জানান।
ওয়ারী বিভাগের পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (প্রশাসন) ইফতেখারুল ইসলাম বলেন, “এবছর গরুর হাটগুলোতে ‘আনওয়ান্টেড’ কিছু হয়নি।”
Posted ১২:০৫ অপরাহ্ণ | সোমবার, ১২ আগস্ট ২০১৯
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta