কক্সবাংলা ডটকম(২১ নভেম্বর) :: একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে পশ্চিমা এবং ভারতীয় নীতির সমীকরণ ক্রমেই স্পষ্ট হচ্ছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্ব চায় বিশ্বাসযোগ্য, অংশগ্রহণমূলক ও স্বচ্ছ একটি নির্বাচন। পশ্চিমা প্রভাবশালী দেশগুলো প্রধান দুই রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির সঙ্গে সম্পৃক্ত উভয় জোটের সঙ্গেই সমান্তরালভাবে কৌশলগত যোগাযোগ রক্ষা করছে।
তবে বিএনপির জোটে থাকা জামায়াতের প্রশ্নে কোনো রকম ছাড় না দেওয়ার অবস্থানে অনড় রয়েছে ভারত। জামায়াতের চিহ্নিত নেতাদের মনোনয়ন পাওয়া ও নির্বাচনে অংশগ্রহণের দিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখছে তারা। সংশ্নিষ্ট একাধিক দায়িত্বশীল কূটনৈতিক সূত্রের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
এ বিষয়ে বিশ্নেষকরা বলেন, এটা নতুন কিছু নয়। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বিষয় ঘিরে এ ধরনের তৎপরতা অতীতেও চলেছে। শেষ পর্যন্ত যে কোনো সংকটের সমাধান রাজনীতিবিদরাই করেছেন। এবারের নির্বাচন ঘিরে যে চ্যালেঞ্জ, সেগুলো রাজনীতিবিদদেরই মোকাবেলা করতে হবে। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে আগামী ৩০ ডিসেম্বর।
সূত্র জানায়, গত এক মাসে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ পশ্চিমা দুনিয়ার প্রভাবশালী দেশগুলোর পক্ষ থেকে বিভিন্ন রাজনৈতিক জোট এবং দলের নেতাদের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক আলোচনার পাশাপাশি অনানুষ্ঠানিক কথাবার্তাও হয়েছে। এ ধরনের অনানুষ্ঠানিক আলাপ এখনও অব্যাহত রয়েছে। সংশ্নিষ্ট কূটনৈতিক মিশনগুলোর নিয়মিত দায়িত্বের অংশ হিসেবেই এ আলাপ-আলোচনা চলছে। একই সঙ্গে নির্বাচন পর্যবেক্ষণের বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের সঙ্গেও তাদের আলোচনা চলছে।
পশ্চিমা কূটনৈতিক মিশনের তৎপরতা :
সংশ্নিষ্ট সূত্র জানায়, বাংলাদেশে আগামী নির্বাচন কতটা বিশ্বাসযোগ্য হবে তা নিয়ে এখনও সংশয় কাটেনি পশ্চিমা বিশ্বের। বিশেষ করে সরকার ও সরকারবিরোধী জোটের পক্ষ থেকে পরস্পরবিরোধী তথ্য পাওয়ার কারণে এ সংশয় দানা বেঁধে আছে।
সূত্র আরও জানায়, সরকারবিরোধী জোটের পক্ষ থেকে বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে এখন পর্যন্ত একাধিক ব্যবস্থাপনাগত ত্রুটি ও সীমাবদ্ধতার কথা কূটনীতিকদের জানানো হয়েছে। অভিযোগগুলোর অন্যতম হচ্ছে, নির্বাচন কমিশনের (ইসি) সন্দেহজনক আচরণ, বিরোধী রাজনৈতিক জোটের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে অব্যাহতভাবে মামলা দায়ের এবং গ্রেফতার, নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্বে থাকা সরকারি কর্মকর্তাদের দলীয় মনোভাব এবং গণমাধ্যমের ওপর সরকারের কৌশলগত নিয়ন্ত্রণ। এ ছাড়া নির্বাচনের আগে দাবি অনুযায়ী সংসদ ভেঙে দেওয়ার বিষয়টিও উল্লেখ করা হয়েছে বিরোধী জোটের পক্ষ থেকে।
অন্যদিকে সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, অবাধ পরিবেশে অংশগ্রহণমূলক ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য নির্বাচন কমিশনকে সর্বাত্মক সহযোগিতা দিচ্ছে সরকার। কমিশনের ওপর কোনো ধরনের প্রভাব নেই। চিহ্নিত মামলার অপরাধী ছাড়া কাউকে গ্রেফতার করাও হচ্ছে না। নির্বাচন পরিচালনায় নিয়োজিত সরকারি প্রশাসনও প্রভাবমুক্ত রয়েছে এবং গণমাধ্যমের স্বাধীনভাবে দায়িত্ব পালনেও হস্তক্ষেপ করা হচ্ছে না। এমনকি সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে বিরোধী জোটের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রেখে নানা পরামর্শও নেওয়া হচ্ছে। সার্বিকভাবে নির্বাচন ঘিরে উৎসবমুখর পরিবেশ রয়েছে।
সূত্র জানায়, উভয় পক্ষের তথ্যই কূটনীতিকরা বিশ্নেষণ করছেন। বিশেষ করে বর্তমানে পশ্চিমা প্রভাবশালী কূটনৈতিক মিশনগুলো নিজেদের মধ্যে সমন্বয় করে নির্বাচনসংক্রান্ত পরিস্থিতির ওপর নজর রাখছে। গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেলে তা সমন্বিতভাবেই বিশ্নেষণ করা হচ্ছে।
সূত্র আরও জানায়, নির্বাচন পর্যবেক্ষণের বিষয়েও নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করা হচ্ছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে এবার নিয়মিত পর্যবেক্ষক দলের পরিবর্তে ছোট আকারের বিশেষজ্ঞ দল আসছে। এরই মধ্যে ইউরোপীয় পার্লামেন্টের একটি দল রোহিঙ্গা সংকট ইস্যুতে ঢাকা সফরে এসে নির্বাচনের বিষয় নিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সুশীল সমাজের সঙ্গে মতবিনিময়ের মাধ্যমে পরিস্থিতি সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করেছে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ বিভিন্ন দেশ থেকে নির্বাচনী পর্যবেক্ষক দল এবারের নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করবে।
এক প্রশ্নের জবাবে এই সূত্র জানায়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বিগত বছরগুলোতে বাংলাদেশের উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক অগ্রগতি খুবই প্রশংসনীয়। একই সঙ্গে ড. কামাল হোসেনকে তারা দায়িত্বশীল নেতা হিসেবে বিবেচনা করেন। তার নেতৃত্বে ঐক্যফ্রন্টের আত্মপ্রকাশ আগামী জাতীয় নির্বাচনকে বিশ্বাসযোগ্য করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে মনে করে এই সূত্র।
ভারতের অবস্থান :
ভারতের দায়িত্বশীল কূটনৈতিক সূত্র জানায়, বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে কেবল জামায়াতের প্রশ্নে ভারতের নিজস্ব ও স্বতন্ত্র অবস্থান রয়েছে। এ বিষয়ে ভারত কোনো ছাড় দেবে না। এর কারণ হিসেবে সূত্র জানায়, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে ভারত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে শুধু সমর্থনই দেয়নি, ভারতীয় সেনারা মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে থেকে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করেছে এবং জীবন দিয়েছেন। ওই সময় জামায়াত সরাসরি পাকিস্তানের পক্ষে অবস্থান নেয়। পরবর্তীতেও এই দলটির রাজনৈতিক অবস্থান ছিল সুনির্দিষ্টভাবে পাকিস্তানের পক্ষে এবং ভারতের বিরুদ্ধে।
এ ছাড়া চিহ্নিত সাম্প্রদায়িক শক্তি জামায়াতের দলীয় নীতিও ধর্মনিরপেক্ষ, অসাম্প্রদায়িক ভারতীয় নীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এসব কারণেই ভারত কোনোভাবেই জামায়াতকে প্রশ্রয় দিতে নারাজ। এক প্রশ্নের জবাবে ভারতের এ সূত্র জানায়, কোনো রাজনৈতিক জোট জামায়াতের কোনো চিহ্নিত নেতাকে মনোনয়ন দিচ্ছে কি-না সে ব্যাপারে ভারত নজর রাখছে। এদের বিষয়ে বাংলাদেশের মানুষই উপযুক্ত সিদ্ধান্ত নেবে বলে এ সূত্রের অভিমত।
সূত্র আরও জানায়, গত এক মাসে ঢাকায় নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার হর্ষবর্ধন শ্রিংলা আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেন, বিকল্পধারার প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরীসহ জাসদ, তরীকত ফেডারেশন, সিপিবি, ওয়ার্কার্স পার্টিসহ কমপক্ষে ১৬টি রাজনৈতিক দলের সভাপতি, সাধারণ সম্পাদকের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক, অনানুষ্ঠানিক উভয় প্রক্রিয়ায় আলাপ-আলোচনা করেছেন। নিয়মিত কূটনৈতিক দায়িত্বের অংশ হিসেবেই তিনি এ তৎপরতা চালিয়েছেন। এ আলোচনা চলমান থাকবে বলেও সূত্র জানায়।
নির্বাচন পর্যবেক্ষণের বিষয়ে সূত্র জানায়, ২০১৪ সালের নির্বাচনের সময় ইসির অনুরোধে ভারত পর্যবেক্ষক দল পাঠিয়েছিল। এবারও তারা চাইলে ভারত পর্যবেক্ষক দল পাঠাবে।
সাম্প্রতিক সময়ে মালদ্বীপ ও শ্রীলংকার জাতীয় নির্বাচন ঘিরে ভারত-চীন স্নায়ুযুদ্ধ লক্ষ্য করা যায়। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এ ধরনের কোনো অবস্থা আছে কি-না জানতে চাইলে সূত্র জানায়, ভারত প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের নীতি অনুসরণ করে এবং কোনো দেশেরই অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করে না। অনেকেই নিজস্ব ধারণা থেকে মালদ্বীপ ও শ্রীলংকার নির্বাচনে ভারত-চীন প্রভাবের কথা বলে থাকেন; বাস্তবে এটা সত্য নয়। বরং চীনের সঙ্গে ভারতের চমৎকার সম্পর্ক রয়েছে।
আফগানিস্তানে ভারত ও চীন যৌথভাবে উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে ভারতের কাছে বাংলাদেশ সবার আগে এবং বাংলাদেশের জনগণের সঙ্গে ভারতের জনগণের সম্পর্কের বন্ধন সুদৃঢ় করাকেই ভারত প্রাধান্য দেয়। নির্বাচন এবং সরকার গঠন বাংলাদেশের জনগণের নিজস্ব চিন্তার বিষয়, এ নিয়ে ভারতের ভূমিকা রাখার কিছু নেই।
বিশ্নেষকদের অভিমত :নির্বাচনে কূটনৈতিক সমীকরণ সম্পর্কে জানতে চাইলে সাবেক রাষ্ট্রদূত ও কূটনীতি বিশ্নেষক হুমায়ুন কবীর মঙ্গলবার বলেন, যদি বিশ্বাসযোগ্য, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হয়, তাহলে নির্বাচনের ফলাফল নির্ধারণে মূল নির্ণায়ক হবে জনগণ। এক্ষেত্রে বন্ধু রাষ্ট্রগুলোর চাওয়া না-চাওয়ার কোনো প্রভাব পড়বে না। কিন্তু যদি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন না হয়, সেক্ষেত্রে যারা নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্বে আছেন, তাদের বন্ধু দেশগুলোর চাওয়া না-চাওয়ার প্রভাব, ইচ্ছাকে বিবেচনা করতে হতে পারে। তিনি আরও বলেন, নির্বাচন ঘিরে নানা কূটনৈতিক তৎপরতা আগেও দেখা গেছে, এখনও যাচ্ছে। সবচেয়ে বড় কথা, একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হোক, জনমতের প্রতিফলন ঘটুক। এটাই প্রত্যাশা সবার।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক দেলোয়ার হোসেন বলেন, নির্বাচন বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়। বাংলাদেশে বিভিন্ন সময়ে অনেক সংকট এসেছে। অনেক কূটনৈতিক তৎপরতা দেখা গেছে, সেগুলো কোনো ফল বয়ে আনেনি। বরং শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের রাজনীতিবিদরাই সেই সংকট কাটিয়ে ওঠার দক্ষতা দেখিয়েছেন। অতএব, এবারও নির্বাচন নিয়ে কূটনৈতিক তৎপরতা নতুন কিছু নয়। বাস্তবতা হচ্ছে, এ নিয়ে কূটনীতিকদের ভূমিকার কিছু নেই। প্রভাবশালী বন্ধু রাষ্ট্রগুলো আমাদের উন্নয়ন অংশীদার, সেখানেই তাদের ভূমিকা কাম্য, রাজনীতিতে নয়
Posted ১১:০৮ পূর্বাহ্ণ | বুধবার, ২১ নভেম্বর ২০১৮
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta