হুমায়ূন রশিদ,টেকনাফ(৫ সেপ্টেস্বর) :: রাখাইন শাসিত প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমারে সীমান্ত চৌকিতে আবারো সন্ত্রাসী হামলার জেরধরে আরকান রাজ্যে বসবাসরত রোহিঙ্গা মুসলিমদের উপর ন্যাক্কারজনক যৌথ হামলা ও খুন,বসত-বাড়িতে অগ্নিসংযোগ এবং অমানবিক নির্যাতনের কারণে বাংলাদেশ সরকারের মানবিক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে গত দেড় সপ্তাহ ধরে টেকনাফের বিভিন্ন সীমান্ত পয়েন্ট দিয়ে উম্মুক্তভাবে লক্ষাধিক রোহিঙ্গার অনুপ্রবেশ ঘটছে। এখনো অসংখ্য রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ ও শিশুর অনুপ্রবেশ অব্যাহত রয়েছে। অনেকে মারাতœক রক্তাক্ত ও গুলিবিদ্ধ হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছে।
অনুপ্রবেশকারী এসব রোহিঙ্গা নিয়ে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা বিভ্রান্তির মধ্যে থাকলেও একশ্রেণীর দালাল সীমান্ত পার করে দেওয়ার অজুহাতে লক্ষ লক্ষ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংস্থা মানবিক কারণে হালকা খাবার বিতরণ করলেও বাসস্থান,খাদ্য ও চিকিৎসা সংকট চরম আকার ধারণ করেছে। পুরো উপজেলায় স্বল্প ভূমিতে রোহিঙ্গাদের বিরাট চাপ স্থানীয় জনসাধারণের মধ্যে দুঃচিন্তার কারণ হয়ে দাড়িয়েছে।
সরেজমিনে ৫ সেপ্টেম্বর উপজেলার হোয়াইক্যং ইউনিয়নের ঝিমংখালী, নয়াপাড়া, বৃহত্তর কাঞ্জরপাড়া, কুতুবদিয়া পাড়া, ঊনছিপ্রাং, লম্বাবিল, তেচ্ছিব্রীজ, আমতলী, কোনার পাড়া, খারাইংগ্যা ঘোনা, উলুবনিয়া পয়েন্ট দিয়ে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ অব্যাহত রয়েছে। স্থানীয় কিছু দালাল পারাপারের নৌকা খরচের নামে মোটাংকের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
লম্বাবিল পয়েন্টে দুপুর ১২টায় অনুপ্রবেশকারী মিয়ানমারের কুমির খালীর ওসমানের স্ত্রী নুরুচ্ছফা মিয়ানমারের ১০হাজার কিয়াতের বিনিময়ে ১০গজ নদী পথ পার হয়েছে বলে জানান। এমন হাজারো ভূক্তভোগী ঘাট দালালদের টাকা দিয়ে বাংলাদেশে ঢুকছেন বলে জানায়। সীমান্তের জিরো পয়েন্ট এলাকায় এই রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত অসংখ্য রোহিঙ্গার অবস্থান লক্ষ্য করা গেছে।
অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গারা হ্নীলা নয়াপাড়া নতুন বস্তি, নয়াপাড়া রেজিষ্টার্ড ক্যাম্প,লেদা অনিবন্ধিত রোহিঙ্গা বস্তি, কাঞ্জরপাড়া পাহাড়ি টিলা, উনছিপ্রাং অস্থায়ী ক্যাম্প,কুতুপালং ক্যাম্প, পরিচিত জন, পাহাড়ি জনপদে আশ্রয় নিচ্ছেন। এতে বন ও পাহাড় ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ার আশংকা দেখা দিয়েছে। অনুপ্রবেশকারী অনাহারী রোহিঙ্গাদের বিভিন্ন সংস্থা,স্বচ্ছল ব্যক্তি মানবিক খাদ্য সহায়তা দিতে দেখা গেছে।
এদিকে রোহিঙ্গা নেতারা অবিলম্বে নবাগত রোহিঙ্গাদের বাস্তুসংস্থান, খাদ্য সংকট দূরীকরণ ও চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করতে আর্ন্তজাতিক সংস্থা সমুহের সহায়তা কামনা করেছেন।
এছাড়া রাতে হোয়াইক্যং নয়াবাজার, হ্নীলা মৌলভী বাজার, হোয়াব্রাং, পূর্ব ফুলের ডেইল, জালিয়া পাড়া, চৌধুরী পাড়া, লেদা, মোচনী, নয়াপাড়া, জাদিমোরা, টেকনাফ সদরের নাইট্যং পাড়া, কায়ুকখালী পাড়া, জালিয়া পাড়া, নাজির পাড়া, মৌলভী পাড়া, নয়াপাড়া, শাহপরীর দ্বীপ জালিয়া পাড়া, পশ্চিম পাড়া,ডাঙ্গর পাড়া, উপকূলীয় সাবরাং, টেকনাফ সদর ও বাহার ছড়া পয়েন্টে দিয়ে নানা কৌশলে রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ অব্যাহত রয়েছে।
বাহারছড়ায় রোহিঙ্গা বহনকারী দালালেরা টাকার জন্য কয়েক জনকে আটকে রেখে দেড় লক্ষ টাকা মুক্তিপণ দাবী করছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। অনেকে পথঘাট না চেনায় শত শত রোহিঙ্গা মুক্তিপণ দাবীর শিকার হচ্ছে। গ্রামাঞ্চলে ছড়িয়ে থাকা রোহিঙ্গারা স্থানীয় জনসাধারণের জন্য হুমকি স্বরূপ বলে অনেকে মন্তব্য করতে দেখা গেছে। তাদের সংগঠিত করে নির্দিষ্ট স্থানে রাখার দাবী উঠলেও রইক্ষ্যং এলাকার একটি প্রভাবশালী সুবিধাভোগী মহল টাকার বিনিময়ে রোহিঙ্গাদের জায়গা বিক্রি করছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
এই ব্যাপারে টেকনাফ উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান জাফর আহমদ বলেন,পুরো টেকনাফের প্রত্যন্ত এলাকায় লক্ষাধিক রোহিঙ্গার অনুপ্রবেশ ঘটছে। রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশে সহায়তাকারীদের কঠোর হস্তে দমনের লক্ষ্যে বিকালেই নৌকা-বোট মালিকদের সাথে উপজেলা প্রশাসন,পুলিশ-বিজিবির বিশেষ সভা অনুষ্ঠিত হয়।
প্রত্যেক ইউনিয়নে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশরোধে সচেতনতামূলক সভা করার সিদ্বান্ত নেওয়া হয়। এছাড়া ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা রোহিঙ্গারা স্থানীয় জনসাধারণের জন্য হুমকি স্বরূপ। তাই আপাতত তাদের হোয়াইক্যং ইউনিয়নের রইক্ষ্যং পুটিবনিয়া পাহাড়ী এলাকায় রাখার সিদ্বান্ত নেওয়া হয়েছে।
সাবরাং ইউপি চেয়ারম্যান নুর হোসেন জানান,এই পর্যন্ত সাবরাং-শাহপরীর দ্বীপে প্রায় ৭০হাজার মতো রোহিঙ্গা অবস্থান নিয়েছে। স্থানীয় মেম্বার মোয়াজ্জেম হোসেন দানু,জয়নাল ও সেন্টমার্টিনের আক্তার কামালের ইন্দনে টাকার লোভে রোহিঙ্গাদের উৎসাহিত করে অসংখ্য বোট দিয়ে সাবরাং ক্ষুরের মুখ হতে টেকনাফ সদরের বিভিন্ন পয়েন্ট ও বাহারছড়া শাপলাপুর পর্যন্ত ৩০টি স্পট দিয়ে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করাচ্ছে।
অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গারা চুরি-ছিনতাইয়ের শিকার হওয়ায় তিনি ১০/১২টি ঘটনা হতে রোহিঙ্গাদের রক্ষা করেছেন। দালাল ও ইন্দন দাতাদের ব্যাপারে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে অবহিত করা হয়েছে। এদিকে ক্ষুদ্ধ জনসাধারণ শাহপরীর দ্বীপ জেটিঘাটে আদম বহনের দায়ে একটি বোটে অগ্নিসংযোগ করে বলে স্থানীয়রা জানায়।
এই ব্যাপারে হোয়াইক্যং মডেল ইউপি চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ নুর আহমদ আনোয়ারী বলেন,হোয়াইক্যং ইউনিয়নে আনুমানিক ৩০হাজার রোহিঙ্গা অবস্থান নিয়েছে। তাদের নির্দিষ্ট একটি জায়গায় নাগরিক সুবিধা দিয়ে রাখলে ভাল হবে। অন্যথায় বিভিন্ন স্থানে আইন-শৃংখলা পরিস্থিতির চরম অবনতি ঘটতে পারে।
এদিকে টেকনাফ মডেল থানা পুলিশের অফিসার্স ইনচার্জ মোঃ মাইন উদ্দিন খান বলেন,রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশে সহায়তাকারী দালালদের বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত রয়েছে। ইতিমধ্যে অনেককে আটক করে আইনের আওতায় আনা হয়েছে।
উল্লেখ্য,গত ২৫ আগষ্ট রাতের প্রথম প্রহরে মিয়ানমারের উত্তর-পশ্চিম রাজ্যের ২৪টি এলাকার সীমান্ত চৌকি ও সেনা ঘাটিতে স্বশস্ত্র হামলার ঘটনার পর পরই পুরো এলাকায় মিয়ানমার সীমান্ত রক্ষী, সেনা বাহিনী ও কতিপয় রাখাইন মিলে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে সন্ত্রাসী আখ্যায়িত করে হত্যাযজ্ঞ, বসত-বাড়িতে অগ্নিসংযোগ এবং অমানবিক নির্যাতনের মাত্রা বেড়ে যাওয়ায় রোহিঙ্গারা প্রাণে বাঁচতে বিভিন্ন সীমান্ত পয়েন্ট দিয়ে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ অব্যাহত রয়েছে।
Posted ১১:৫৫ অপরাহ্ণ | মঙ্গলবার, ০৫ সেপ্টেম্বর ২০১৭
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta