কক্সবাংলা ডটকম(৩০ জানুয়ারি) :: মন্ত্রিসভায় অনুমোদিত খসড়া ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৩২ ধারা ব্যাপারে আইনজীবী, তথ্য অধিকার কর্মী, সাবেক সচিব, সাংবাদিক নেতাসহ সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষ আশঙ্কা করছেন, এই ধারার অপপ্রয়োগ হতে পারে।
তাদের অভিমত, এই ধারা অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে। সরকারি অফিসে দুর্নীতিকে অবাধ করে তুলবে। তারা এ আইন সংসদে পাসের আগে এর অপপ্রয়োগ বন্ধে যথাযথ সংশোধন আনার তাগিদ দিয়েছেন।
আইনের ৩২ ধারা সম্পর্কে আইনজীবী ব্যারিস্টার তানজিব উল আলম বলেন, খসড়া আইন পড়ে বোঝা যায়, এ ধরনের আইন প্রণয়নের জন্য যে গবেষণা ও তুলনামূলক আইন পড়ার এবং আইনটিকে গ্রহণযোগ্য ও অপপ্রয়োগ রোধে যে প্রচেষ্টার প্রয়োজন হয়, সেসব করা হয়নি।
ফলে এ আইনের ৩২ ধারাসহ একাধিক ধারার অপপ্রয়োগের আশঙ্কা রয়েছে। সরকারি অফিসের কোনো ফাইলের ছবি তোলার জন্য ১৪ বছরের জেল- এটা খুব বড় সাজা।
তিনি বলেন, ধারার শুরুতেই ‘বেআইনিভাবে’ প্রবেশের কথা বলা হয়েছে। এখানে কথা উঠবেই যে, আইনিভাবে অনুমতি নিয়ে কোনো অফিসে ঢোকার বিষয়টি কীভাবে প্রমাণ করা হবে।
সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার বলেন, তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারার মতো এটিরও অপপ্রয়োগের যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। তিনি বলেন, সরকারি অফিসে কোনো নির্দিষ্ট আইনে কোনো তথ্যকে সুনির্দিষ্টভাবে ‘গোপনীয়’ বলা হলে কোনো নির্দিষ্ট ফাইল বা তথ্য ‘গোপনীয়’ বিবেচিত হতে পারে।
তথ্য অধিকার আইনের ৭ ধারায়ও কিছু কিছু ক্ষেত্রে তথ্যের গোপনীয়তার কথা বলা হয়েছে। এগুলো ছাড়া আর কোনো ফাইল বা তথ্যই সরকারি অফিসে গোপনীয় নয়।
এ প্রসঙ্গে এমআরডিআই-এর নির্বাহী পরিচালক হাসিবুর রহমান মুকুর বলেন, তথ্য অধিকার আইন আর ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন দুটি পৃথক বিষয়। কিন্তু যে কোনো আইন করার ক্ষেত্রেই বিবেচনায় রাখতে হবে, আইনটি যেন জনগণের তথ্য পাওয়ার অধিকারের সঙ্গে সাংঘর্ষিক না হয়।
এ ব্যাপারে আইন ও সালিশ কেন্দ্রের এক বিবৃতিতে উদ্বেগ জানিয়ে বলা হয়, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ২০১৮-এর খসড়ায় ২৫, ২৮, ২৯ এবং ৩১ ধারায় ৫৭ ধারার অনুরূপ বক্তব্য যুক্ত হয়েছে।
এ ছাড়া আশঙ্কা রয়েছে, এটির ৩২ ধারা সাংবাদিক, লেখকসহ অন্যান্য বুদ্ধিবৃত্তিক ও তথ্য সংগ্রহের কাজে সম্পৃক্ত পেশাজীবীদের কর্মক্ষেত্র সংকুচিত করবে। আইন ও সালিশ কেন্দ্র আইনটি কার্যকর করার আগে এর বিভিন্ন ত্রুটি সংশোধনের দাবি জানিয়েছে।
এ আইন সম্পর্কে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, এ আইনের নাম ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন রাখা হলেও প্রকৃতপক্ষে এটি ডিজিটাল নিরাপত্তাহীনতা আইন হয়ে উঠেছে। এ আইন সংবিধানে প্রদত্ত নাগরিকের মত ও সংবাদমাধ্যমের তথ্য প্রকাশের অধিকার খর্ব করবে।
এ আইনের ফলে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা প্রবল বাধার মুখে পড়বে বলে আশঙ্কা করছেন সাংবাদিক নেতা এবং সিনিয়র সাংবাদিকরা।
বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি মনজুরুল আহসান বুলবুল বলেন, জঙ্গি কর্মকাণ্ডের জন্য কোনো অফিসের ফাইল গোপনে তোলা আর সাংবাদিকতার জন্য ছবি তোলা একই ধরনের অপরাধ হিসেবে গণ্য হতে পারে না। অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার জন্য তথ্য সংগ্রহকে কোনোভাবেই অপরাধ বলা যায় না।
তাই কেউ গুপ্ত ক্যামেরা বা ডিজিটাল ডিভাইস কোনো সন্ত্রাসী কাজের উদ্দেশ্যে ব্যবহার করলে তার বিচার হতে হবে; কিন্তু সাংবাদিকরা পেশাগত কাজের জন্য এগুলো ব্যবহার করলে তা ভিন্নভাবে দেখতে হবে। এখানে ডিভাইস মুখ্য না হয়ে কী উদ্দেশ্যে ব্যবহার হচ্ছে, তা বিবেচনায় নিতে হবে। একই সঙ্গে এর অপপ্রয়োগ রোধের সুনির্দিষ্ট ব্যবস্থা থাকতে হবে।
তিনি বলেন, এ আইনটি সংসদে পাসের আগে সাংবাদিক নেতা এবং তথ্য অধিকার বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে মতবিনিময় করে চূড়ান্ত করা দরকার।
সিনিয়র সাংবাদিক এবং একাত্তর টিভির পরিচালক (বার্তা) সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা বলেন, সরকারি অফিসের অনিয়ম-দুর্নীতি আড়ালে রাখার কৌশল হিসেবেই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ৩২ ধারা সংযুক্ত করা হয়েছে।
রাজনৈতিক নেতারা যা বলেন :ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন প্রসঙ্গে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ বলেন, চিন্তা-ভাবনা করেই আইনটি করা হচ্ছে। আইনমন্ত্রী, তথ্যমন্ত্রীসহ সংশ্নিষ্ট সবাই এতে তাদের মতামত দিয়েছেন। বিএনপির শাসনকালেই আইসিটি আইনটি করা হয়েছিল। এতে কিছু অস্পষ্টতা ছিল। সেগুলোকে স্বচ্ছ এবং সুস্পষ্ট করা হয়েছে নতুন আইনে।
বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, নির্বাচিত সংসদ সদস্যরা মর্যাদাশীল। অথচ তাদের বিরুদ্ধে যেভাবে লেখা হয়, তাতে তাদের মান-ইজ্জত থাকে না। কখনও সংসদ সদস্যদের প্রতিপক্ষ, কখনও দলেরই বিরোধী গোষ্ঠীর কেউ সাংবাদিকদের নানা তথ্য দিয়ে থাকে। তবে প্রতিবেদন নির্ভুল হলে সাংবাদিকদের কোনো শাস্তি হবে না বলে মনে করেন তিনি। সাংবাদিকদের উদ্দেশে মন্ত্রী বলেন, ‘আপনারা লিখে যান, সঠিকভাবে লিখুন।’
সিপিবি সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের খসড়ায় যে ধারা দেখা গেছে, তা সংবিধান পরিপন্থী, গণবিরোধী। এ আইনের ৩২ ধারার মাধ্যমে সরকারি অফিসে সব ধরনের দুরাচার, দুর্নীতি এবং দুর্বৃত্তায়নকে উৎসাহিত করা হয়েছে।
৫৭ ধারায় যেসব কাজ করলে অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হতো সেসব কাজ করলে ডিজিটাল আইনেও অপরাধ হবে বলে উল্লেখ আছে। শুধু ১৭ থেকে ৩২ নম্বর ধারায় অপরাধের সংজ্ঞা বিন্যস্ত করা হয়েছে।
৩২ ধারায় বলা হয়েছে, ‘সরকারি, আধাসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে কেউ যদি বেআইনিভাবে প্রবেশ করে কোনো ধরনের তথ্য-উপাত্ত, যেকোনো ধরনের ইলেকট্রনিকস যন্ত্রপাতি দিয়ে গোপনে রেকর্ড করে, তাহলে সেটা গুপ্তচরবৃত্তির অপরাধ হবে।’
আইনটিতে এ অপরাধের শাস্তি হিসেবে ১৪ বছরের কারাদণ্ড ও ২৫ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। ৫৭ ধারায়ও শাস্তির মেয়াদ ছিল ১৪ বছরের কারাদণ্ড। তবে নতুন আইনে দ্বিতীয়বার অপরাধের শাস্তির পরিমাণ করা হয়েছে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। সঙ্গে এক কোটি টাকা জরিমানা।
সংবাদকর্মীরা তথ্য সংগ্রহ করতে এসব প্রতিষ্ঠানে যাতায়াত করে থাকেন। কর্মকর্তাদের দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতির সংবাদ সংগ্রহ করাই সংবাদকর্মীদের কাজ। ছবি সংগ্রহ করা কাজ। এসব কাজকে নিরুৎসাহ করতে এই আইনের প্রয়োগ হতে পারে বলে মনে করেন বিশিষ্টজনরা। গণমাধ্যমে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার বিষয়টি প্রচলিত রয়েছে। নতুন আইনের ৩২ ধারায় অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার পথ রুদ্ধ করা হয়েছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।
বাদ হতে যাওয়া তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন, ২০০৬ (সংশোধিত-২০১৩)-এর ৫৭ ধারায় বলা হয়, ‘কোনো ব্যক্তি যদি ইচ্ছাকৃতভাবে ওয়েবসাইট বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক ফরম বা ইলেকট্রনিক বিন্যাসে এমন কিছু প্রকাশ বা সম্প্রচার করেন যাহা মিথ্যা ও অশ্লীল বা সংশ্লিষ্ট অবস্থা বিবেচনায় কেহ পড়লে, দেখলে বা শুনলে নীতিভ্রষ্ট বা অসৎ হতে উদ্বুদ্ধ হতে পারেন কিংবা যার মাধ্যমে মানহানি ঘটে, আইন-শৃঙ্খলার অবনতি ঘটে বা ঘটার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়।
রাষ্ট্র ও ব্যক্তির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয় বা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে বা করতে পারে বা এই ধরনের তথ্যাদির মাধ্যমে কোনো ব্যক্তি বা সংগঠনের বিরুদ্ধে উসকানি দেওয়া হয়, তাহলে তা হবে অপরাধ।’ ৫৭ ধারার সংজ্ঞায় অনলাইন নিউজপোর্টাল বা গণমাধ্যমের কথা সরাসরি উল্লেখ নেই। নেই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের খসড়ায়ও।
Posted ২:০৯ পূর্বাহ্ণ | বুধবার, ৩১ জানুয়ারি ২০১৮
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta