কক্সবাংলা ডটকম(৫ জানুয়ারি) :: দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) শর্ষেয় ভূত রয়েছে। আর সেই ভূতের কারণে সারা বছর বিভিন্ন মামলার চুনোপুঁটি আসামিরা গ্রেপ্তার হলেও অধরা রাঘব-বোয়ালরা। দুদক নিয়ে বেশ মুখরোচক আলোচনা হতো এক সময়। দুদককে বলা হতো ‘নখ-দন্তহীন বাঘ’। মাঝে অনেকটা সময় অবসাদ কাটানোর পর বর্তমান চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ দায়িত্ব নেয়ার পর ঘুরে দাঁড়িয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। হাতে নেয়া হয়েছে পঞ্চবার্ষিকী কর্মপরিকল্পনা।
সে অনুযায়ী কাজও চলছে। কিন্তু বাদ সাদছে প্রতিষ্ঠানটির কিছু অসাধু কর্মকর্তার দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ার ঘটনা। অভিযোগ রয়েছে- এজন্য পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ হচ্ছে না। কেউ কেউ বলছেন, যে শর্ষেয় ভূত তাড়ানোর কথা, সেই শর্ষেতেই ভূতের আছড় পড়েছে। দুদক নিয়ে টিআইবির সর্বশেষ গবেষণা প্রতিবেদনেও এমন তথ্য উঠে এসেছে।
দুদক চেয়ারম্যান হিসেবে ইকবাল মাহমুদ গত বছরের ১৪ মার্চ দায়িত্ব নেয়ার পর শুরু হয় দুর্নীতিবাজদের ধরতে বিশেষ অভিযান। রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় অভিযান চালিয়ে প্রায় চার শতাধিক আসামিকে গ্রেপ্তারও করা হয়।
এদের মধ্যে সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তা, অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, ডাক্তার, প্রকৌশলী, ব্যবসায়ী ও শিক্ষক রয়েছেন। অভিযান তৎপরতা জোরদার হওয়ায় দুর্নীতিবাজদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে আতঙ্ক। তবে বিভিন্ন ক্ষেত্রে আসামিদের গ্রেপ্তার করা হলেও আড়ালে রয়ে যায় সমাজে ভিআইপি হিসেবে পরিচিত দুর্নীতিবাজরা।
এদের তালিকায় আছেন বেসিক ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল হাই বাচ্চু, সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক কাজী ফখরুল ইসলাম, উপব্যবস্থাপনা পরিচালক এ মোনায়েম খান ও কনক কুমার পুরকায়স্থ এবং সাবেক ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক শেখ মঞ্জুর মোর্শেদ, ড্যাটকো গ্রুপের চেয়ারম্যান মুসা বিন শমসের, জাতীয় পার্টির নেতা ও ঢাকা-৬ আসনের এমপি কাজী ফিরোজ রশিদ, মিডল্যান্ড ব্যাংকের এমডি আহসান উজ-জামান, শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকের ডিএমডি মনজুরুল ইসলাম, অভিনেতা পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো পরিচিত ব্যক্তিরা।
মূলত দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে দুদকের কঠোর হওয়ার বার্তাটি পাওয়া যায় গত বছরের ১১ জানুয়ারি সংস্থাটির চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদের বক্তব্যে। ওই দিন তিনি নতুন বছরের কর্ম-পরিকল্পনা তুলে ধরতে দুদকের প্রধান কার্যালয়ে এক বিশেষ সংবাদ সম্মেলনে হাজির হন এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি ঘোষণা করেন।
বলেন, ২০১৭ সাল হবে দুর্নীতিবাজদের জন্য আতঙ্কের বছর। তারই অংশ হিসেবে ১৯টি প্রতিষ্ঠানের দুর্নীতি প্রতিরোধে দুদফায় দুদকের ১৩ জন পরিচালকের সমন্বয়ে ১৯টি প্রাতিষ্ঠানিক বিশেষ টিম গঠন করা হয়। যে টিমগুলো ইতোমধ্যে কোমর বেঁধে মাঠে নেমেছে। চালিয়েছে ব্যাপক গ্রেপ্তার অভিযান।
এদিকে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) প্রধান কার্যালয় ও মাঠ পর্যায়ের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার ও ভয়-ভীতি প্রদর্শনসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কাজে সম্পৃক্ত থাকার প্রাথমিক প্রমাণ পেয়েছে কমিশন।
চলতি বছরের শুরুর দিকে কমিশনে বেশ কয়েকজনের বিরুদ্ধে অনেকগুলো অভিযোগ জমা পড়ে। সেসব অভিযোগের ব্যাপারে কমিশনের অভ্যন্তরীণ দুর্নীতি দমন কমিটি কাজ করতে গিয়ে কর্মচারীদের অপরাধে জড়িয়ে পড়ার প্রমাণ পায়।
এ বিষয়ে চলতি বছরের ১৭ মে কমিশনের অভ্যন্তরীণ দুর্নীতি দমনের বিষয়ে চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদের সভাপতিত্বে তার দপ্তরে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। ওই সভায় নিজস্ব কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধ ওঠা অভিযোগ স্বচ্ছভাবে তদন্ত করে তাদের ব্যাপারে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে কমিটিকে নির্দেশ দেন চেয়ারম্যান।
অবশ্য দুদক কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অনৈতিক পথে জড়িয়ে পড়ার অভিযোগ এবারই প্রথম নয়, এর আগেও বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানে অনুসন্ধান চালানোর সময় ওই সব প্রতিষ্ঠান থেকে দুদক কর্মকর্তারা অনৈতিকভাবে নানা সুযোগ-সুবিধা ভোগ করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছিল। এরই পরিপ্রেক্ষিতে দুদকের অভ্যন্তরীণ তদন্ত কমিটি অনুসন্ধান সাপেক্ষে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থাও গ্রহণ করেছে।
হটলাইন ১০৬ : বেশ ঢাকঢোল পিটিয়ে গত ২৭ জুলাই ‘১০৬’ নম্বর হটলাইন চালু করে দুদক। সূত্রমতে, এরপর থেকে ২৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রায় সাড়ে ৩ লাখের বেশি ফোনকল আসে কমিশনে। যার মধ্য থেকে অনুসন্ধানের জন্য আমলে নেয়া হয় মাত্র ৩শটির মতো অভিযোগ। আর মামলা হয় মাত্র ১২টি। বলা হচ্ছে, অভিযোগ জানিয়েও তেমন সাড়া না মেলায় জনগণের মধ্যে এই হটলাইনের ব্যাপারে অনীহা তৈরি হয়েছে।
দুদক নিয়ে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল, বাংলাদেশ (টিআইবি) পরিচালিত সর্বশেষ গবেষণায় দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) দুর্নীতিমুক্ত নয় এবং সংস্থাটির কর্মকর্তারাও দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত বলে উল্লেখ করা হয়।
গত ৫ নভেম্বর ‘দুর্নীতি প্রতিরোধে দুর্নীতি দমন কমিশন পরিচালিত গণশুনানি : কার্যকারিতা, চ্যালেঞ্জ ও করণীয়’ শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, দুদক সর্বক্ষেত্রে প্রভাবমুক্ত থেকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে না।
আমরা গবেষণা চালাতে গিয়ে দেখেছি, দুদক সম্পূর্ণ ক্লিন তা বলা যাবে না। তাদের কর্মকর্তারাও দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত। তারা (দুদক) আমাদের (টিআইবি) প্রতিশ্রæতি দিয়েছে, প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে দুদকের যেসব কর্মকর্তা দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত থাকবেন, তাদের বিরুদ্ধে শুধু বিভাগীয় ব্যবস্থা নয়, আইনগত ব্যবস্থাও নেবে।
প্রভাবশালীরা গ্রেপ্তার না হওয়া প্রসঙ্গে ইফতেখারুজ্জামান বলেন, দুদকের কাছে মানুষ আইনের সুষম প্রয়োগ প্রত্যাশা করে। আইনের চোখে সবাই সমান। প্রভাবশালীদের গ্রেপ্তার করা যাবে না, এ নীতিতে দুদকের চলা উচিত নয়।
একই প্রশ্নে আইনজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক বলেন, আইন যদি সবার জন্য সমান না হয় তাহলে আইনের শাসন থাকে না। দুদককে এ বিষয়টির দিকে নজর দেয়া উচিত। শুধু চুনোপুঁটি নয়, রাঘব-বোয়ালদের ধরে দুদক দৃষ্টান্ত স্থাপন করুক। আইনের মারপ্যাঁচ দিয়ে প্রভাবশালীদের রক্ষার চেষ্টা দুদকের ঘুরে দাঁড়ানোর প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করবে।
এ বিষয়ে দুদকের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা ভোরের কাগজকে বলেন, দুদক কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অনৈতিকতার অভিযোগ থাকলে তা কমিশনকে জানাতে হবে। আমাদের কাছে অভিযোগ আসার সঙ্গে সঙ্গেই আমরা দ্রুত অনুসন্ধান করি। অভিযোগ প্রমাণিত হলে অসাধু কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়। এর আগেও এ ধরনের অভিযোগে বেশকিছু কর্মকর্তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। ভবিষ্যতেও তা অব্যাহত থাকবে।
Posted ৬:৩৫ পূর্বাহ্ণ | শনিবার, ০৬ জানুয়ারি ২০১৮
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta