কক্সবাংলা ডটকম(১৪ অক্টোবর) :: ২০ দলীয় জোটকে পাশ কাটিয়ে নতুন জোট করেছে বিএনপি। গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে শনিবার ৭ দফা ও ১১ লক্ষ্য ঘোষণার মধ্য দিয়ে যাত্রা শুরু করে ‘জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট’, যার শরিক দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপিও। ঘোষণা অনুযায়ী শিগগিরই নতুন এই জোটের শীর্ষ নেতারা একযোগে বিভাগীয় পর্যায়ে সফর করবেন; তারপরই ঘোষণা করবেন নতুন কর্মসূচি।
নেতারা বলেছেন, প্রাথমিকভাবে সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবি আদায়ে এই জোট গঠন করা হলেও পর্যায়ক্রমে তা আন্দোলন ও নির্বাচনের বৃহত্তর জোটে পরিণত হবে। সে ক্ষেত্রে প্রশ্ন উঠেছে, নতুন এই জোটের সঙ্গে বিএনপির আন্দোলন ও নির্বাচনের ঐক্য হলে ২০ দলীয় জোটের কী হবে?
রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মতে, কৌশলগত কারণে বিএনপি আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা না করলেও ২০ দল এরই মধ্যে অকার্যকর হয়ে গেছে। এরই মধ্যে ২০ দলীয় জোটের কোনো কোনো শরিক হতাশা ব্যক্ত করেছেন। বিএনপির রোষে পড়তে পারেন- এই আশঙ্কায় এখনই প্রকাশ্যে মুখ না খুললেও ২০ দলীয় জোটের ভবিষ্যৎ অন্ধকার বলে মনে করছেন শরিক দলের নেতারা।
সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্র জানায়, ড. কামালের নেতৃত্বে বিএনপির নতুন জোট গঠনে ভেতরে ভেতরে পুড়ছেন পুরনো ২০ দলীয় জোটের নেতারা। কারণ, জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে মনোনয়ন নিশ্চিত হওয়ার আশায় বেশ কিছু দিন ধরেই তারা নিজ নিজ আসনে নিজেদের মতো করে ভোটের প্রচারণা চালিয়ে আসছেন। শুধু তাই নয়, নানা সমালোচনা পাশ কাটিয়ে জোটের কাছে ৭০টি আসন চেয়েছে জামায়াতে ইসলামী। অন্য দলগুলোর ক্ষেত্রে পাঁচজন করে সব মিলিয়ে দেড় শতাধিক নেতা জোটের মনোনয়ন প্রত্যাশী।
কিন্তু এমন অবস্থায় বিএনপি যুক্তফ্রন্টের নেতাদের দাবি-দাওয়া মেটাতে ব্যস্ত। নিজ নিজ নির্বাচনী এলাকায় ঐক্যজোটের নেতাদের বেশি প্রভাব রয়েছে- এমনটা ধরে নিয়ে মনোনয়ন দেয়ার ব্যাপারে বিএনপি ঐক্যজোটের নেতাদের প্রতিই বেশি মনোযোগী হবে বলে আশঙ্কা শরিকদের।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) মুহাম্মদ ইবরাহিম বলেন, ড. কামালের সঙ্গে ঐক্য হয়েছে বিএনপির। আমাদের তো এ বিষয়ে কিছু বলার নেই। তবে আমরা আশা করব ২০ দলের ঐক্য ধরে রাখার স্বার্থে তারা আমাদের সঙ্গে সব বিষয়ে খোলামেলা আলোচনা করবে। নিবন্ধিত ৮টি দলের সঙ্গে আলোচনা করে আসন বণ্টনের বিষয়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেবে। এ ছাড়াও অন্য শরিক দলে নির্বাচন করার মতো যে সব প্রার্থী রয়েছেন, তাদের বিষয়ে সিদ্ধান্ত স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিলে কোনো দ্ব›দ্ব থাকবে না।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ২০ দলের একাধিক নেতা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, নির্বাচন অতি নিকটে অথচ বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তির কোনো সম্ভাবনাও নেই। নেত্রীর মুক্তির আন্দোলনের চেয়ে বিএনপির নেতারা মেতে রয়েছেন ঐক্য প্রক্রিয়া নিয়ে। তলে তলে নাকি দাবি আদায়ে মাঠে নামার ছক কষছেন।
তারা বলেন, বিএনপির নেতারা কাদের নিয়ে এসব পরিকল্পনা করছেন তা জোটের নেতাদের অজানা। দাবি আদায়ে সফল হতে পারলে ভালো, তবে এ অবস্থায় জোটের শরিকরা বঞ্চিত হচ্ছেন।
বাংলাদেশ লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি-এলডিপি সভাপতি কর্নেল (অব.) ড. অলি আহমদ বলেন, আমরা ঐক্যজোটে আছি, বিএনপি সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দল। তারা ড. কামাল হোসেনের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। আমাদের পক্ষ থেকে শুভ কামনা রইল। তবে এত অল্প সময়ের মধ্যে নতুন জোটের সঙ্গে বিএনপির ভাগাভাগি কতদূর সম্পন্ন হবে সেটাই দেখার বিষয়। তিনি বলেন, নতুন ঐক্যজোট নিয়ে অনেক রকম কথা শুনছি। কেউ ১৫০ আসন চায়, যাদের কাছে দুজনও প্রার্থী নেই। এভাবে রাজনীতি হয় না, এটা হলো ভাগবাটোয়ারার রাজনীতি।
জোটের এই নেতা বলেন, আর যাই হোক, বিএনপি যদি ২০ দলীয় জোটের শরিকদের প্রতি যথাযথ সম্মান না দেখায়, তাহলে ২০ দলের ঐক্য ভেঙে যাবে। উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন, একটা মানুষ যদি বিয়ে করে বউকে ৫০ তোলা স্বর্ণও দেয়, দুই লাখ ভরি স্বর্ণও দেয় কিন্তু তার প্রাপ্ত সম্মান না দেয় তাহলে সেই স্ত্রী তার ঘর করবে না। একইভাবে একজন পুরুষকে যদি সম্মান করা না হয় সেও একসঙ্গে বসবাস করতে পারে না। প্রত্যেকের একটা নিয়ম-নীতির মধ্যে থাকতে হবে।
ন্যাপ বাংলাদেশের মহাসচিব এম গোলাম মোস্তফা ভূঁইয়া বলেন, বৃহত্তর ঐক্যজোট নিয়ে এখনই মন্তব্য নয়, পর্যবেক্ষণ করছি। আমরা সময়মতো পদক্ষেপ নেব। অপেক্ষা করছি, দেখি বিএনপি কতটা লাভবান হয়। তবে বাংলাদেশ লেবার পার্টির মহাসচিব মোস্তাফিজুর রহমান ইরান বেশ আশাবাদী। তিনি বলেন, নতুন ঐক্যজোটকে আমরা স্বাগত জানাই। ২০ দলীয় জোট ঐক্যবদ্ধভাবে সবাইকে নিয়েই এগিয়ে যেতে চায়।
তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের সঙ্গে ১৪ দল থাকা অবস্থায়ও এরশাদের সঙ্গে জোট হয়েছে। তারা যদি মিলে থাকতে পারে আমরা কেন পারব না? নতুন জোট নিয়ে মান-অভিমান আছে কিনা এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ক্ষোভের সুযোগ নেই। কারণ মহাসচিবকে আমরাই দায়িত্ব দিয়েছিলাম সবাইকে নিয়ে ঐক্যজোট করার। তবে শেষমেশ তাদের জন্য যদি আমাদের সম্মানহানি হয়, সেটা মেনে নেয়া হবে না।
বিএনপির জাতীয় ঐক্য গঠন প্রসঙ্গে ২০ দলীয় জোটের অন্যতম শরিক বাংলাদেশ ন্যাপর চেয়ারম্যান জেবেল রহমান গানি বলেন, ঐক্য হয়েছে বিএনপির সঙ্গে। ভালো-মন্দ তারাই ভালো বলতে পারবে। আমরা ২০ দলীয় জোটে আছি। কিন্তু ঐক্য প্রক্রিয়ার সঙ্গে নেই। তাই ঐক্য নিয়ে এই মুহূর্তে কোনো মন্তব্য নেই। অপেক্ষা করুন সময়ই বলে দেবে ঐক্যের ভবিষ্যৎ। তবে এ কারণে শরিক দলগুলো আসন সংকটে পড়বে না বলে আশা রাখছি।
বিএনপির নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, জামায়াতসহ ২০ দলকে অবহেলা করলে তারা অন্য কোনো দল বা জোটের সঙ্গে নতুন জোট গঠন করতে পারে- এমন আশঙ্কা থেকেই ২০ দলীয় জোট অটুট রেখেই ড. কামাল হোসেনের সঙ্গে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টে যুক্ত হয়েছে বিএনপি। আপাতত বৃহত্তর ঐক্যের একটি দল হিসেবে বিএনপি অন্যান্য দলের সঙ্গে যুগপৎভাবে ৫ দফা দাবিতে আন্দোলন করবে। পাশাপাশি একই দাবিতে ২০ দলীয় জোটের সঙ্গেও পালন করা হবে অভিন্ন কর্মসূচি।
বিএনপির নেতারা জানান, নতুন ঐক্যজোট ২০ দলের উপরে কোনো প্রভাব পড়বে না। এ বিষয়ে ২০ দলের নেতাদের চিন্তার কোনো কারণ নেই। সূত্র জানায়, জামায়াতের সঙ্গ ছাড়া নিয়ে যুক্তফ্রন্ট যে শর্ত দিয়েছিল, সেখানে দলটি অনড় থাকলে ঐক্য প্রক্রিয়া ভেস্তে যেতে পারত।
কিন্তু সব দিক বিবেচনা করে ২০ দলের বন্ধন অটুট রাখার স্বার্থেই জামায়াত ও পুরনো জোটকে সঙ্গে রাখার ব্যাপারে ড. কামালকে কৌশলে ম্যানেজ করা হয়েছে। এ নিয়ে কয়েকবার ড. কামালের সঙ্গে একান্তে বৈঠকও করেছেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। এমনকি গত ১৩ অক্টোবর গুলশানে ২০ দলীয় বৈঠকেও শরিক নেতাদের মাথায় হাত বুলিয়ে শান্ত থাকতে বলেছেন বিএনপির মহাসচিব।
এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মোশাররফ হোসেন বলেন, বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের সঙ্গে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সম্পর্ক থাকবে না; থাকবে বিএনপির সঙ্গে। তাই শরিক দলের অবস্থান বিএনপির কাছে যেমন আছে তেমনি থাকবে। জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ও বিএনপির দাবি অভিন্ন হওয়ায় তারা একসঙ্গে যে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, সেখানে ২০ দলকে না রেখে একই দাবিতে তাদের নিয়ে আলাদা করে কর্মসূচি দেয়া হবে।
Posted ২:৫০ পূর্বাহ্ণ | সোমবার, ১৫ অক্টোবর ২০১৮
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta