কক্সবাংলা ডটকম(১ মে) :: পাকিস্তানিরা মুখ্যত দুটি উত্তেজক জিনিসে আসক্ত– ক্রিকেট এবং রাজনীতি। দেশটিতে দুটোকে ঘিরেই রয়েছে দারুণ অনিশ্চয়তা। তারকায় ভরপুর টিম–পাকিস্তানে এমন কোন ব্যাটসম্যান নেই যার ওপর চোখ বন্ধ করে নির্ভর করা যায়।
বোলারদের নিয়ে অনিশ্চয়তা আরও বিপজ্জনক ধাঁচের। আন্তর্জাতিক ম্যাচে কখন তারা দেশের জন্য খেলছে– আর কখন বাজিকরদের জন্য লড়ছে সেটা বোঝা মুশকিল। তারপরও পাকিস্তান তার ক্রিকেট স্কোয়াডকে ভালোবাসে নিকটজনের মতো।
একইভাবে রাজনীতিও তাদের প্রিয়। স্বাধীনতা পরবর্তী সত্তর বছরে দেশটিতে চার বার অভ্যুত্থান হয়েছে, একজন প্রধানমন্ত্রী খুন হয়েছেন, একজনকে ফাঁসি দেয়া হয়েছে– নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রীদের কেউ-ই পূর্ণমেয়াদ শেষ করে স্বাভাবিকভাবে বিদায় নিতে পারেননি। আগামীতেও পারবে এমন কথা বিশ্বাসী মানুষ দেশটিতে খুঁজে পাওয়া মুশকিল। তারপরও জাতীয় নির্বাচনের সম্ভাবনায় পাকিস্তান উত্তাল হয়ে ওঠে। চলতি সপ্তাহ থেকে যে উত্তেজনা আবার শুরু হল তিন লাখ ৪০ হাজার বর্গমাইল জুড়ে।
সবকিছু ঠিক-ঠাক থাকলে তবেই আগামী মধ্য জুলাইয়ে দেশটির ন্যাশনাল এসেমবিল’র নির্বাচন হবে। প্রায় আড়াই মাস বাকি নির্বাচনের। তবে ইতোমধ্যে প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো বড় বড় জনসভার মধ্যদিয়ে অঘোষিতভাবে নির্বাচনী প্রচারণা শুরু করে দিয়েছে।
যদিও সর্বশেষ ন্যাশনাল এসেমবলিতে নওয়াজের মুসলিম লিগের ১৮৯টি আসনের বিপরীতে ইমরান খানের অনুসারীরা মাত্র ৩৫টি আসন জিতেছিল– কিন্তু এবারও দেশটির নির্বাচনে প্রধান আকর্ষণ ইমরান খান। গত রবিবার তাঁর দল তেহেরিকে ইনসাফ (‘ন্যায় প্রতিষ্ঠার আন্দোলন’; পিটিআই) আগামী নির্বাচনের প্রচারযুদ্ধ শুরু করেছে লাহোরের বাদশাহী মসজিদ লাগোয়া মিনার-ই-পাকিস্তান ময়দান থেকে। সেখানে প্রায় এক লাখ শ্লোগানমুখর জনতার সামনে প্রাক্তন এই ক্রিকেটার প্রায় দুই ঘন্টা ধরে ভাষণ দেন।
ভাষণের এক ফাঁকে আগামীদিনের পাকিস্তানের জন্য পিটিআই’র ‘১১ দফা’ কর্মসূচিও ঘোষণা করেন তিনি– যার মধ্যে আছে গরীবদের জন্য ৫০ লাখ বাড়ি নির্মাণের প্রতিশ্রুতি। নির্বাচনে ইমরান খাতের ব্র্যান্ড শ্লোগান হচ্ছে ‘নয়া পাকিস্তান’। বিপজ্জনকভাবে অস্পষ্ট হলেও এই শ্লোগান নিয়েই পিটিআই’র কর্মীবাহিনী পুরো পাকিস্তান চষে বেড়ানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে আগামী আড়াই মাস ধরে।
ক্রিকেট ক্যারিয়ারে তুখোড় পেসার হিসেবে ইমরানই দলের হয়ে প্রথম বল করতেন– বিপক্ষ দলের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য ব্যাটসম্যানদের বিপক্ষে। যেকোন ক্রিকেট দলে মূল পেসারকে বিপক্ষ ওপেনার জুটি ভেঙ্গেই কব্জির জোর প্রমাণ করতে হয়। অনেকটা সেই ক্রিকেট ঐতিহ্যকে ধারণ করেই যেন লাহোর থেকে নির্বাচনী প্রচারণা শুরু করলেন ইমরান।
পাকিস্তানে লাহোর হল ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগের মূল শক্তিকেন্দ্র এবং নওয়াজ শরীফের নিজ প্রদেশ। প্রধানমন্ত্রী হওয়ার আগে নওয়াজ নিজে একদা এখানে মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন। তার ভাই শাহবাজ শরীফ মুখ্যমন্ত্রী আছেন গত ১০ বছর। পাকিস্তানের রাজনীতিতে এটা ইতোমধ্যে প্রমাণিত, পাঞ্জাব জয় যেকোন রাজনীতিবিদের টেকসই ক্যারিয়ারের জন্য অতিজরুরি।
গত নির্বাচনে পাঞ্জাবে পিটিআই মুসলিম লিগের বিরুদ্ধে দাঁড়াতেই পারেনি। তবে ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম সেরা পেসার হিসেবে ইমরান ‘রুল অব দ্য গেইম’ মেনেই আবারও প্রচার লড়াইয়ে নেমেছেন লাহোর থেকেই। শরীফ-হার্টল্যান্ডে পিটিআই-এর এই শোডাউনকে দেশটির একজন নেতৃস্থানীয় সাংবাদিক গারিদ্দা ফারুকী টুইটারের উল্লেখ করেছেন, স্মরণকালের বৃহত্তম ‘জলসা’ হিসেবে।
বলা বাহুল্য, ইমরানের প্রধান প্রতিপক্ষ নওয়াজ তাৎক্ষণিকভাবে পিটিআই’র লাহোর সমাবেশ নিয়ে মন্তব্য করেছেন। তার ভাষায়, ইমরান ‘অন্য কারো’ এজেন্ডা নিয়ে কাজ করছেন। লাহোরের জনসভায় অন্য প্রদেশের মানুষ নিয়ে এসে সমাবেশ ভারি করার দায়েও তিনি পিটিআইকে দোষারপ করেন।
শরীফের জন্য সমস্যা হলো এমুহূর্তে কেবল ইমরানের বিরুদ্ধে নয়– লড়তে হচ্ছে তাকে পাকিস্তানের ‘ডিপ-স্টেইট’ এবং বিচার বিভাগের সঙ্গেও। ইতোমধ্যে তার রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের যবনিকা টেনে দিয়েছে উচ্চআদালত। সম্ভাবনা আছে কারাবরণেরও। একমাত্র তার দলের আরেকটি নির্বাচনী বিজয়ই তাকে রাজনৈতিকভাবে রক্ষা করতে পারে। ফলে ২০১৮-এর জাতীয় নির্বাচন শরীফের জন্য রাজনৈতিক জয়-পরাজয়ের চেয়েও অনেক বেশি কিছু।
তবে ইতোমধ্যে তিনি দলের নেতৃত্ব ছেড়ে দিয়েছেন ভাই শাহবাজ শরীফের কাছে। একই সাথে সামনে এনেছেন কন্যা মরিয়ম এবং এবং শাহবাজের পুত্র হামজাকে। ধারণা করা হচ্ছে, নওয়াজের দল আগামী নির্বাচনে শাহবাজকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তুলে ধরতে চাইবে, হামজাকে পাঞ্জাবে নির্বাচনী প্রচারণায় ব্যবহার করবে আর মরিয়মকে পাঠানো হবে দেশের অন্যত্র। শরীফ ইতোমধ্যে দেশটির রাজনীতির তৃতীয় প্রধানদল পিপলস পার্টির সঙ্গেও ইমরানকে মোকাবেলায় একরূপ বোঝাপড়ায় এসেছেন বলে অনুমান করা হচ্ছে। যদিও আপাতত ইমরানের পাশাপাশি জারদারি’রও তীব্র সমালোচনা করছেন নওয়াজ– কিন্তু পিটিআইকে ঠেকাতে মুসলিম লীগ যে প্রয়োজনে পিপলস্ পার্টি (পিপিপি)-কে সমর্থন দেবে সেটা স্পষ্ট।
জারদারিও যে মনে করেন, ইমরান-নওয়াজের দ্বন্দ্ব তার দলকে সরকার গঠনের সুযোগ করে দিতে পারে– সেটা তার নির্বাচনী প্রচারে তিনি গোপন করছেন না। যেহেতু দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে স্থানীয় পেশাশক্তি এবং ব্যবসায়ী সমাজ বরাবরই ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে থাকতে চায়– সেকারণে পিপিপি নির্বাচনী ফলাফলে খারাপ করলেও যে সরকার গঠনের সম্ভাবনায় ভরপুর সেই ইঙ্গিত জারদারি বারবারই দিচ্ছেন প্রচারমাধ্যমকে। পিপলস্ পার্টির এইরূপ নেতিবাচক সম্ভাবনা বাড়িয়ে দিচ্ছেন মুসলিম লীগের অনেক নেতাও। তারা বলছেন, কোন দল ভালো সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পেলে মুসলিম লীগকে আরেকবার ক্ষমতায় আসা ঠেকাতে ইমরানই পিপিপিকে সমর্থন দিতে পারেন।
স্পষ্ট যে, নির্বাচনী প্রচারণার সূচনামুহূর্তে ব্যক্তি ও দলীয় স্বার্থই এখনো রাজনৈতিক গসিপ হিসেবে অধিক আলোচিত হচ্ছে। দারিদ্র্যপীড়িত একটা দেশ হলেও অতীতে পাকিস্তানের নির্বাচনে উন্নয়ন প্রসঙ্গ সামান্যই মনোযোগ পেয়েছে। তবে এবার ইমরান-নওয়াজ-পিপিপির ত্রিমুখী যুদ্ধে উন্নয়ন প্রসঙ্গটিও উঠে আসছে ভিন্ন এক সূত্রে। ইমরানের দল যেহেতু গত পাঁচ বছর খাইবার পাখতুনওয়ারা শাসন করেছে সেকারণে তারা পুরো দেশের জন্য এই প্রদেশের সুশাসনকে মডেল হিসেবে উপস্থাপন করছে। শরীফ পরিবার এক্ষেত্রে তুলে ধরছে পাঞ্জাবকে। পিপিপি’র জন্য এই লড়াইয়ে সুবিধা করা মুশকিল। কারণ তাদের শাসনে সিন্ধু এবং করাচিতে শাসন-সংস্কৃতির উন্নতি হয়েছে সামান্যই। যদিও এখনও এটি পাকিস্তানের বাণিজ্যিক রাজধানী। ইমরানের মতোই পিপিপি রবিবার তাদের ‘নির্বাচনী সমাবেশ’ করেছে করাচির লিয়াকতাবাদে।
এদিকে প্রভাবশালী আন্তর্জাতিক ম্যাগাজিন ‘ইকোনমিস্ট’ সম্প্রতি তাদের এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে বলেছে, বিনিয়োগ পরিবেশ অনুকূল রাখতে পারার কারণে নওয়াজ শরীফের দলেরই আগামী নির্বাচনে পুনরায় বিজয়ের সম্ভাবনা অধিক। ইকোনমিস্ট পাকিস্তানের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতাকে মুসলিম লীগের বড় সফলতা হিসেবে চিহ্নিত করছে। এছাড়াও ইতোমধ্যে যতগুলো নির্বাচনী জরিপ হয়েছে তার প্রতিটিতে পিপিপি ও পিটিআই থেকে মুসলিম লীগকে এগিয়ে থাকতে দেখা গেছে।
মূলত নওয়াজ পুনঃপুন নিজেকে সেনা-আমলাতন্ত্রের করুণ ‘শিকার’ হিসেবে তুলে ধরার কারণে দুর্নীতিগ্রস্ত ইমেজ সত্ত্বেও তার প্রতি সমর্থন কমছে না বলেই মনে হচ্ছে। এটা দক্ষিণ এশিয়ার সমাজ জীবনের এক রহস্যময় গোলকধাঁধাও বটে যে– সুশাসনের চরম আর্তি থাকলে দুর্নীতির বরপুত্রদের খুব কম সময়ই ভক্তরা ‘না’ বলতে পারে।
তবে নওয়াজ যতই জনআবেগ তৈরি করে দাড়িয়ে থাকতে চেষ্টা করুন না কেন– নির্বাচনী পরিস্থিতি সামনের দিনগুলোতে প্রভাবিত হবে দেশটির ক্ষমতার মূল ভরকেন্দ্র সেনা-স্টাবলিশমেন্ট কী ভাবছে তার দ্বারাও; আপাত নওয়াজের সঙ্গে সেই শক্তি-ভরকেন্দ্রের সম্পর্ক অতিতিক্ত অবস্থায় রয়েছে। ইতিহাসের বড় এক কৌতুক এই যে, ভুট্টোদের জনপ্রিয়তা মোকাবেলা করতে একদা জেনারেল জিয়া-উল-হকই নওয়াজকে জাতীয় রাজনীতির কেন্দ্রে টেনে নিয়ে এসেছিল।
Posted ৮:১৮ অপরাহ্ণ | মঙ্গলবার, ০১ মে ২০১৮
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta