কক্সবাংলা ডটকম(৯ ডিসেম্বর) :: ভারত পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধের ঘোষণায় দেশে ফের অস্থির হচ্ছে পেঁয়াজের বাজার। চাহিদার তুলনায় উৎপাদন, আমদানি ও সরবরাহ পর্যাপ্ত থাকলেও ১ দিনের ব্যবধানে খুচরা বাজারে কেজিপ্রতি প্রায় ১শ টাকা বাড়ানো হয়েছে। এতে এক কেজি দেশি পেঁয়াজ কিনতে ক্রেতার সর্বোচ্চ ২৪০ টাকা খরচ করতে হচ্ছে।
হঠাৎ করেই পেঁয়াজে আগুন। রপ্তানি বন্ধ করার ভারত সরকারের ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই টালমাটাল বাংলাদেশের পেঁয়াজের বাজার। একদিনের ব্যবধানে দেশি পেঁয়াজের দাম কেজিতে বেড়েছে ১২০ টাকা। রাজধানীর খুচরা বাজারে এখন এ পেঁয়াজের কেজি ২৪০ টাকা। আর কেজিতে ৯০ টাকা বেড়ে ভারতীয় পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ২০০ টাকা। কেউ কেউ ২২০ টাকাও দাম হাঁকছেন। তবে বাড়তি দামেও অনেক জায়গায় মিলছে না পেঁয়াজ।
এদিকে দেশের ভোগ্যপন্যের প্রধান আড়ত চট্টগ্রামের পাইকারি ও খুচরা বাজারে পেঁয়াজ যেন রাতারাতি উধাও হয়ে গেছে। আর যাও বা আছে গোডাউনে বা দোকানে তার দামও দ্বিগুণ থেকে আড়াইগুণ হয়ে গেছে। মূলত ভারত সাময়িকভাবে পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করার ঘোষণা দেয়ার পরপরই সারাদেশের মতো চট্টগ্রামের পেঁয়াজ ব্যবসায়ীরাও তাদের অসাধু বাণিজ্য কৌশলে নেমে পড়েন। একদিন আগেও শুক্রবার যেসব গুদাম পেঁয়াজে ভর্তি ছিল, সেগুলো হঠাৎ উধাও হয়ে যায়। বলতে গেলে ‘পেঁয়াজের হাহাকার’ চলছে এখন। কোনো নিয়মনীতির বালাই নেই যেন এই ব্যবসার ক্ষেত্রে। দরকার যেন শুধু ‘মুনাফা এবং অতি মুনাফা’। কনজ্যুমার অ্যাসেসিয়েশনের নেতা এস এম নাজের হোসাইন ব্যবসায়ীদের এই আচরণকে ‘ডাকাতি’র সঙ্গে তুলনা করে অবিলম্বে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানিয়েছেন।
ক্রেতা সাধারণ বলছেন, ব্যবসায়ীরা নানা অজুহাতে আগের দামে কেনা পেঁয়াজই বিক্রি করছেন বেশি দামে। অন্যদিকে বাজারে ঘাটতির অজুহাত দেখাচ্ছেন বিক্রেতারা।
খুচরা বিক্রেতারা বলছেন, পাইকাররা দেশি পেঁয়াজ ছাড়ছেই না। এ কারণে ক্ষণে ক্ষণে বাড়ছে পেঁয়াজের দাম।
এদিকে রাজধানী ঢাকার কারওয়ান বাজার, শ্যামবাজারেও ভোরে যে দাম ছিল- সকাল ৯টায় তা মণপ্রতি ৮০০ থেকে ১ হাজার টাকা বেড়ে গেছে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, বিকল্প পথে পেঁয়াজ আমদানির ব্যবস্থা না নিলে গত বছরের চেয়েও খারাপ পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে।
তবে ব্যবসায়ীদের কারসাজির কারণে পেঁয়াজের দাম বাড়ছে বলে মনে করেন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি মো. গোলাম রহমান। তিনি বলেন, মুনাফালোভী ব্যবসায়ীদের এটা অপকৌশল। ব্যবসায়ীরা দিনকে দিন অতিলোভী হয়ে উঠেছে। যখনই কোনো অজুহাত পায়, তখনই দাম বাড়িয়ে ভোক্তার পকেট কাটে। এবারো তাই হচ্ছে।
তিনি বলেন, এখন যে সমস্যা হচ্ছে- এটা শুধুই ব্যবসায়ীদের ইচ্ছাকৃতভাবে সৃষ্টি করা। সাধারণ মানুষের স্বার্থ রক্ষার্থে সরকারের উচিত এসব নিয়ন্ত্রণহীন ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের লাগাম টেনে ধরা। অসাধু ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনে জেল জরিমানার ব্যবস্থা করতে হবে। এ বিষয়ে সরকারের কঠোর তদারকির দাবি জানান তিনি।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমরা প্রায় প্রতি বছরই পেঁয়াজ সংকটে থাকি। এজন্য দেশের উৎপাদনও বাড়াতে হবে। প্রথমত, এ দেশে যে বীজ করা হয়, সেখানে ফলনশীলতা কম। ভারতে আমাদের দেশের প্রায় তিনগুন বেশি ফলনশীলতা। আমাদের দেশেও অধিক উৎপাদনশীল বীজ কৃষকদের সরবরাহ করতে হবে। পাশাপাশি ঋণ ও সারের ব্যবস্থা করতে হবে। তাই প্রয়োজনে সরকারকে ভর্তুকি ও ঋণ সহায়তা দিতে হবে।
দ্বিতীয়ত, পেঁয়াজের মৌসুমে যেন দাম কমে না যায় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। তৃতীয়ত, দেশি পেঁয়াজ যেন পচে না যায়, অর্থাৎ সংরক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে।
এ বিষয়গুলো বিবেচনা করলে চাল, গরুতে যেমন আমরা স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছি, পেঁয়াজেও আমরা স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করতে পারব। তিনি বলেন, শুধু ভারতের ওপরই পড়ে থাকলে হবে না। যতদিন এটা না করা যাবে, ততদিনই পণ্যটির বাজার অস্থির থাকবে।
পেয়াজের সংকটের বিষয়ে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় ক্যাব কেন্দ্রীয় কমিটির ভাইস প্রেসিডেন্ট এস এম নাজের হোসাইন বলেন, কৃষি মন্ত্রণালয়ের একটি বার্ষিক কর্মপরিকল্পনা থাকা উচিত।
তিনি বলেন, দেশে চাহিদা অনুযায়ী কখন পেঁয়াজ আমদানি করতে হবে এবং কোনো সময়ে দেশের উৎপাদিত পেঁয়াজ দিয়ে চাহিদা পূরণ করা হবে- বাজার নিয়ন্ত্রণে এ বিষয়ে সরকারের সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা থাকতে হবে।
এদিকে, বাজার দ্রুত অস্থির হয়ে ওঠার পর তা নিয়ন্ত্রণে এবার অভিযানে নেমেছে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন এই সংস্থার মহাপরিচালক এ এইচ এম সফিকুজ্জামান বলেন, শনিবার সকাল থেকে ঢাকা মহানগর এলাকায় বিভিন্ন বাজারে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের চার কর্মকর্তার নেতৃত্বে চারটি দল অভিযান পরিচালনা করেছে। সংস্থাটির জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ের কর্মকর্তারা অভিযান চালিয়েছেন দেশের আরো কিছু জায়গায়। পেঁয়াজের দাম নিয়ন্ত্রণে না আসা পর্যন্ত এ অভিযান চলবে বলে সংস্থাটির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। ভোক্তা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বলেন, একদিনের
ব্যবধানে পেঁয়াজের দাম বেড়ে ২০০ টাকা পর্যন্ত উঠেছে, এমন খবর আমাদের কাছে এসেছে। এখন আমরা বাজারে গিয়ে তদারকি করছি কত দামে এই পেঁয়াজ কেনা ছিল। একদিনে বাজারে মূল্য এত বেড়ে যাওয়ার কথা নয়। আগে কম দামে পেঁয়াজ কিনে এখন চড়া দামে বিক্রি করা হচ্ছে কি না, তা খতিয়ে দেখা হবে। কোনো অনিয়ম পেলে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে।
তিনি আরো বলেন,শনিবার সারাদেশে ৫৭টি টিম বাজার অভিযানের মাধ্যমে ১৩৩টি প্রতিষ্ঠানকে সর্বমোট ৬ লাখ ৬৬ হাজার টাকা জরিমানা করেছে। ভোক্তা অধিকার রক্ষায় অধিদপ্তরের এ কার্যক্রম আগামীকালও অব্যাহত থাকবে।
তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, প্রতি বছরই নানা কারণে পেঁয়াজের ঝাঁজ বাড়ে। আবার সরকারের তদারকিতে কমেও যায়। কিন্তু এবার নিত্যপ্রয়োজনীয় এ পণ্যটির ঝাঁঝে গত বছরের মতো যুক্ত হয়েছে ভারতের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের নতুন নির্দেশনা। ফলে দফায় দফায় দাম বাড়ছে পেঁয়াজের। এ পণ্যটির দামের ঝাঁজে নাকাল ক্রেতারা।
সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, চাক্তাই-খাতুনগঞ্জে ১২ থেকে ১৫ জনের পেঁয়াজের সিন্ডিকেট রয়েছে। তারা মূলত পেঁয়াজের বাজার নিয়ন্ত্রণ করেন। তারা ভারত ও দেশের স্থলবন্দরের বিভিন্ন আমদারিকারকদের সঙ্গে প্রতিনিয়ত যোগাযোগ রাখেন।
মোবাইল ফোনেই চাক্তাই-খাতুনগঞ্জে পেঁয়াজের দাম বাড়ানো হয়। তাই নতুন পেঁয়াজ আমদানির আগেই দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন আমদানিকারকরা। তারা আড়তদারদের সঙ্গে নিয়ে কারসাজি করে একদিনেই কোটি কোটি টাকা মুনাফা তুলে নিয়েছেন।
মৌলভীবাজার ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি হাজী সৈয়দ মো. বশির উদ্দিন বলেন, ভারত সরকার ঘোষণা দিলেও আমাদের দেশে বর্তমানে যে পেঁয়াজ রয়েছে তা আগের আমদানি করা। তাই দাম নিয়ন্ত্রণে সরকারের উচিত যেসব ব্যবসায়ীরা এলসি খুলে পেঁয়াজ আমদানি করছেন, তাদেরকে তদারকি করা এবং অসাধু ব্যবসায়ীদের আইনের আওতায় আনা।
শনিবার রাজধানীর কমলাপুর কাচাবাজার, খিলগাঁও রেলগেট কাচাবাজার, রামপুরা কাঁচাবাজার, শান্তিনগরসহ কয়েকটি বাজারে ঘুরে দেখা গেয়ে, বাজারগুলোতে যে পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে- সবই ভারতীয়। দেশি পেঁয়াজের দেখা মিলছে না বললেই চলে।
পেঁয়াজ কিনতে আসা জোবায়েত হোসেন নামের একজন এ প্রতিবেদককে বলেন, ১০০ টাকার পেঁয়াজ এখন ১৮০ টাকায় কিনতে হচ্ছে। আমরা গরিব মানুষ কীভাবে এত বেশি দামে পেঁয়াজ কিনে খাব। অন্য মালামালের দামও বেশি, আমাদের পরিবার চালাতে খুব কষ্ট হচ্ছে।
দেশে সাধারণত নভেম্বরের শেষ দিকে মুড়িকাটা পেঁয়াজ ওঠা শুরু হয়। এ বছর বৃষ্টিতে আবাদ ক্ষতিগ্রস্ত ও বাজারে সরবরাহের সময় পিছিয়েছে বলে জানান ব্যবসায়ীরা। তবে ক্রেতাদের একটি বড় অংশের অভিমত, সরকারের মনিটরিংয়ের অভাবই পেঁয়াজের দাম বেড়ে যাওয়ার মূল কারণ।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, আমদানিকারক ও বড় বড় ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেটের কারণেই পেঁয়াজের বাজার স্থিতিশীল রাখা যাচ্ছে না। আবার গত বছরে যারা সিন্ডিকেটের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নেয়ায় এ বছরেও একই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। খুচরা বিক্রেতা ও ক্রেতাদের দাবি, এটা অবশ্যই মজুত ও পাইকারি ব্যবসায়ীদের কারসাজি।
খুচরা বিক্রেতারা বলছে তাদের কেনা বেশি। তাই বেশি দামে বিক্রি করতে হচ্ছে।
আড়তদাররা বলছেন, ভারতীয় পেঁয়াজের দাম বেড়েছে। এর প্রভাব পড়েছে দেশীয় পেঁয়াজের ওপরও। এদিকে পেঁয়াজের দাম স্বাভাবিক রাখতে একই সঙ্গে টিসিবির ট্রাক রাজধানীতে খোলা বাজারে পেঁয়াজ বিক্রি করছে। পাশাপাশি বাজার মনিটরিং ব্যবস্থা পরিচালনা করছে সরকার। জানা গেছে, দেশে পেঁয়াজের চাহিদা বছরে ২৪ লাখ মেট্রিক টন। উৎপাদন হচ্ছে ২৩ লাখ মেট্রিক টন। কিন্তু ৩০ শতাংশ পেঁয়াজ নষ্ট হয়ে যায়। ফলে বছরে ঘাটতি থাকে ৮ থেকে ৯ লাখ মেট্রিক টন। এই ঘাটতি মোকাবিলায় বছরে ৮ থেকে ৯ লাখ টন পেঁয়াজ আমদানি করা হয়।
কৃষি অর্থনীতিবিদ ও গবেষক জাহাঙ্গীর আলম খান বলেন, ভারতের ওপর থেকে নির্ভরশীলতা কমাতে হবে। আমরা অতিমাত্রায় ভারতের ওপর নির্ভলশীল বলেই ভারত যখন বাজার নিয়ন্ত্রণ করে; তখন অমাদের ব্যবসায়ীরাও সুযোগ পেয়ে যায়। অর্থাৎ ব্যবসায়ীদের কারসাজি আছে।
ফলে দেশে বড় বড় ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে বাজারে পেঁয়াজের দাম বাড়িয়ে দিচ্ছে। এখন সরকারের হাতে যদি পেঁয়াজ মজুত থাকত, তাহলে তারা বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারতো। সরকার শুধু মনিটরিং করার কথা বলে, কিন্তু তার হাতে তো ম্যাকানিজম নেই, যা দিয়ে মার্কেটকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। অর্থাৎ সরকারের পরিচালনায় অদক্ষতা রয়েছে।
তিনি বলেন, আমাদের পেঁয়াজের উৎপাদন বাড়াতে বাড়াতে হবে। শীতকালীন পেঁয়াজ ও গ্রীষ্মকালীণ পেঁয়াজের উৎপাদন বাড়াতে হবে। ভারতের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে অন্য দেশের দিকেও গুরুত্ব দিতে হবে আমদানির ক্ষেত্রে। সিন্ডিকেট ভাঙতে হবে, ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণ করতে হবে এবং যারা মুনাফা হাতিয়ে নিচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে।
Posted ৩:০৬ পূর্বাহ্ণ | শনিবার, ০৯ ডিসেম্বর ২০২৩
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta