কক্সবাংলা ডটকম(২০ জুন) :: প্রস্তাবিত বাজেটকে ঘিরে চলতি সংসদের বাজেট অধিবেশনের শুরু থেকে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের সমালোচনা চলছে। তবে গত দুই দিন ধরে এটি চূড়ান্ত রূপ ধারণ করেছে। সরকারি ও বিরোধী দল উভয়ই তার বিরুদ্ধে মন্তব্য করেছেন। এমনকি বিরোধী দল জাতীয় পার্টির পক্ষ থেকে তার পদত্যাগসহ ফৌজদারি মামলা দায়েরের দাবি উত্থাপন করা হয়েছে।
ব্যাংক আমানতের ওপর আবগারি শুল্ক ও ১৫ শতাংশ ভ্যাট প্রস্তাব এবং সঞ্চয়পত্রের সুদের হার কমানোর জন্য প্রস্তাবিত বাজেটে ঘোষণা দিয়ে বিপাকে পড়েছেন অর্থমন্ত্রী। আবগারি শুল্ক প্রত্যাহার করা হবে না জানিয়ে তার অনড় অবস্থান সবার মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার জন্ম দিয়েছে। এমনিতেই বিভিন্ন ইস্যুতে বিতর্কিত বক্তব্য রেখে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে আছেন তিনি।
বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ, কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী, আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিম, যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক মাহাবুবউল আলম হানিফসহ সরকারি দলের কয়েকজন মন্ত্রী ও সংসদ সদস্য বাজেট অধিবেশনে অর্থমন্ত্রীর কড়া সমালোচনা করেছেন।
মঙ্গলবার (২০ জুন) বিরোধী দল জাতীয় পার্টির পক্ষ থেকে আবুল মাল আবদুল মুহিতের পদত্যাগ ও ফৌজদারি মামলা দায়েরের দাবি জানানো হয়েছে।
সংসদ অধিবেশনে অর্থমন্ত্রীর বিরুদ্ধে সমালোচনার ঝড় ওঠার পর প্রশ্ন উঠেছে, তাহলে কি মন্ত্রিসভা থেকে চলে যেতে হচ্ছে তাকে? নাকি ৮৪ বছর বয়সী এই রাজনীতিবিদকে মন্ত্রীত্ব থেকে বিদায় দেওয়ার ‘গ্রাউন্ড ওয়ার্ক’ হচ্ছে? এ নিয়ে এখন কানাঘুষা সর্বত্র। তার ভবিষ্যৎ কী হবে, তা নিয়েও চলছে জল্পনা।
সোমবার (১৯ জুন) সংসদ অধিবেশনে বাজেট আলোচনায় সরকারি দল আওয়ামী লীগের সিনিয়র সংসদ সদস্যদের তোপের মুখে পড়েন অর্থমন্ত্রী। এ কারণে একপর্যায়ে তাকে অধিবেশন কক্ষ ছেড়েই চলে যেতে হয়েছে।
বাজেট আলোচনায় অংশ নিয়ে বক্তব্য রাখতে গিয়ে কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরীসহ সিনিয়র সংসদ সদস্যরা অর্থমন্ত্রীর কড়া সমালোচনা করেছেন। এ প্রসঙ্গে কৃষিমন্ত্রী বলেন, ‘অর্থমন্ত্রীর প্রস্তাবিত বাজেট নিয়ে কিছু সমস্যার কথা সংসদে তুলে ধরেছি। এর বাইরে এ বিষয়ে আর কিছু বলতে চাই না। অর্থমন্ত্রী তো দেশেই আছেন, আপনারা এ নিয়ে তার সঙ্গেই কথা বলেন।’
আবগারি শুল্ক প্রত্যাহারের দাবি জানান সিনিয়র পার্লামেন্টারিয়ান শেখ ফজলুল করিম সেলিম। অর্থমন্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে সোমবার তিনি সংসদে বলেন, ‘আপনার কিছু কথাবার্তা সরকারকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলেছে। আপনি কম কথা বলেন। বয়স হয়ে গেছে, কখন কি বলে ফেলেন!’
সমালোচনা করা প্রসঙ্গে শেখ ফজলুল করিম সেলিম বলেন, ‘জনগণের কষ্ট মেনে নিতে পারে না আওয়ামী লীগ। তাই জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে সংসদে কথা বলেছি। অর্থমন্ত্রী অনেকটা একপেশে মনোভাব দেখাচ্ছেন, যা কাম্য নয়।’
বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদও প্রস্তাবিট বাজেটে সংশোধনের ইঙ্গিত দিয়েছেন। মঙ্গলবার (২০ জুন) সচিবালয়ে তিনি বলেন, ‘প্রস্তাবিত বাজেট দেশের মানুষের প্রত্যাশা মতো সংশোধিত আকারে পাস হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে জাতীয় সংসদে এমন বাজেট পাস করা হবে, যা সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হবে।’
এদিকে সরকারি দলের সিনিয়র নেতাদের পর মঙ্গলবার সংসদে অর্থমন্ত্রীর সমালোচনায় মুখর হয়েছে বিরোধী দল জাতীয় পার্টি। তাদের সংসদ সদস্য জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু অর্থমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করেছেন। এছাড়া তাকে উদ্দেশ্য করে ফিরোজ রশীদ বলেছেন, ‘আগামীতে আপনার দেওয়া বাজেট আর চাই না।’
জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু বলেন, ‘সংসদে উত্থাপিত অর্থমন্ত্রীর পদত্যাগের দাবি জাতীয় পার্টিরই দাবি।’ সরকারের কোনও ইঙ্গিত থেকে এ দাবি উঠেছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘না, এটা জনগণের দাবি। আমরা রাজনীতিকরা জনগণের পক্ষে এ দাবি তুলেছি।’
অর্থমন্ত্রীর বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা হওয়া উচিত এমন মন্তব্য প্রসঙ্গে জাতীয় পার্টির এই প্রেসিডিয়াম সদস্য বলেন, ‘মানুষের করের টাকা নিয়ে ব্যাংকের মূলধন পুনরুদ্ধার করার যে প্রস্তাবনা তিনি রেখেছেন তা কারও কাম্য হতে পারে না। এটা ফৌজদারি অপরাধ। এজন্যই তার বিরুদ্ধে মামলা হওয়া উচিত।’
অর্থমন্ত্রীর সমালোচনা করে সোমবার সংসদে বক্তব্য রাখেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক মাহাবুবউল আলম হানিফ। অর্থমন্ত্রীকে নিয়ে সংসদে উত্তাপ ছড়ানো বক্তব্যের কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এখানে অন্য কোনও হেতু খোঁজার কারণ নেই। আমরা জনগণের জন্য রাজনীতি করি, তাদের সুবিধা-অসুবিধা আমাদের দেখা লাগে।’
এর আগে বিভিন্ন সময়ে নানান ইস্যুতে দল ও সরকারের নীতির বাইরে গিয়ে অনেক ‘বিতর্কিত’ বক্তব্যও দিতে দেখা গেছে অর্থমন্ত্রীকে। তার এসব বক্তব্য আ.লীগের অভ্যন্তরে ক্ষোভের সৃষ্টি করেছে। মন্ত্রীদের মধ্যেও দেখা দিয়েছে বিরূপ প্রতিক্রিয়া। কিন্তু প্রকাশ্যে কোনও নেতা-মন্ত্রী তার বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস দেখাননি। প্রকাশ্যে কেউ মুখ খোলেননি। যদিও প্রস্তাবিত বাজেটের বিভিন্ন দিকের মতো আগের ঘটনাগুলো আবুল মাল আবদুল মুহিতকে এতটা বেকায়দায় ফেলতে পারেনি।
আওয়ামী লীগের নীতি-নির্ধারণীর সঙ্গে সম্পৃক্ত অন্তত ছয় জন নেতা জানিয়েছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেই এখন অর্থমন্ত্রীর ওপর নাখোশ। বিশেষ করে সরকার ও দলকে বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখোমুখি করে তোলায় তার ওপর শেখ হাসিনার নাখোশের মাত্রা দিন দিন বেড়ে চলেছে।
ওই নেতারা জানান, প্রস্তাবিত বাজেট নিয়ে কোনও সমস্যা থাকলে সংসদে আলোচনা করে সমাধান করা হবে প্রধানমন্ত্রীর এমন ঘোষণা ছিল। তবুও বাজেট ঘোষণা নিয়ে অর্থমন্ত্রীর অনড় বক্তব্য শেখ হাসিনা ও সরকারি দলের অন্য নেতা-মন্ত্রীদের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে।
ওই নেতাদের বক্তব্য অনুযায়ী, প্রধানমন্ত্রীর নাখোশ মনোভাব বুঝতে পেরেই হয়তো সংসদে অর্থমন্ত্রীকে নিয়ে সমালোচনার ঝড় তুলেছেন দলের সংসদ সদস্যরা। তারা বলছেন, ‘আবুল মাল আবদুল মুহিতের সমালোচনা করে দলটির সভাপতিমণ্ডলীর অন্যতম সদস্য ও সিনিয়র পার্লামেন্টারিয়ান শেখ ফজলুল করিম সেলিমের বক্তব্যের আলাদা অর্থ থাকতে পারে।’
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর দুই সদস্য বলেন, ‘এর আগে ড. ইউনূসের ক্ষুদ্র ঋণ নিয়ে বক্তব্য দিয়ে কড়া সমালোচনার মুখে পড়েন অর্থমন্ত্রী। তার অনেক বক্তব্য এড়িয়ে গেলেও ড. ইউনূসের ক্ষুদ্রঋণের ইতিবাচক ভূমিকা রয়েছে এমন বক্তব্যে ক্ষুব্ধ হয়েছেন শেখ হাসিনা। তার প্রধানমন্ত্রী নিজেই তার সমালোচনা করে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। জনসভায়ও অর্থমন্ত্রীর কড়া সমালোচনা করেছেন তিনি।
এছাড়া নানা ইস্যুতে দল ও সরকারের নীতির বাইরে যায় প্রায়ই এমন বক্তব্য রেখে আ.লীগে সমালোচিত হয়েছেন আবুল মাল আবদুল মুহিত। এ নিয়ে বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়েছে সরকারকে। শেখ হাসিনা নিজেও অর্থমন্ত্রীর ওপর ক্ষুব্ধ হয়ে আছেন। তবে অর্থমন্ত্রী প্রবীণ ও মেধাবী হওয়ায় সরাসরি কিছু বলতে তিনি খানিকটা দ্বিধান্বিত হন বলে জানান ঘনিষ্ঠরা।
অর্থমন্ত্রীর বিরুদ্ধে দলের সিনিয়র অনেক নেতা থেকে শুরু করে কর্মী পর্যায় পর্যন্ত বিস্তর অভিযোগ এসেছে। প্রাজ্ঞ হওয়ায় এতদিন এসব আমলে নেননি আ.লীগের সভাপতি। তবে এখন ধীরে ধীরে নাখোশ হয়ে উঠছেন প্রধানমন্ত্রীও। তার কী হবে? এই প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে অনেকের মধ্যে।
এদিকে এসব বিষয় নিয়ে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের সঙ্গে তার মোবাইল ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তা সম্ভব হয়নি।
Posted ১:৩৪ পূর্বাহ্ণ | বুধবার, ২১ জুন ২০১৭
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta