কক্সবাংলা ডটকম(২ নভেম্বর) :: ‘ফিলিস্তিনে ইহুদিদের জন্য একটি স্বতন্ত্র আবাসভূমি প্রতিষ্ঠার বিষয়টি বিশেষভাবে বিবেচনা করছে ব্রিটিশ সরকার, এবং এ লক্ষ্য অর্জনে সরকার তার সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখবে। তবে ফিলিস্তিনে বিদ্যমান অ-ইহুদি সম্প্রদায়ের নাগরিক ও ধর্মীয় অধিকার বা অন্য কোনো দেশে ইহুদিরা যে অধিকার ও রাজনৈতিক মর্যাদা ভোগ করছে, তা লঙ্ঘন হয় এমন কোনো কিছুই করা হবে না।’
আজ থেকে ঠিক ১০০ বছর আগে ১৯১৭ সালের ২ নভেম্বর মাত্র ৬৭ শব্দের এক ঘোষণাই পৃথিবীর রাজনৈতিক ইতিহাসের অন্যতম দ্বন্দ্বমুখর অধ্যায়ের সূচনা করে। এদিন তত্কালীন ব্রিটিশ সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আর্থার বেলফোর এক চিঠির মাধ্যমে ব্রিটিশ ইহুদি সম্প্রদায়ের নেতা লর্ড ওয়াল্টার রথচাইল্ডকে ইহুদিদের জন্য একটি ‘স্বতন্ত্র আবাসভূমি’ প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দেন। ওই বছরেরই ৯ নভেম্বর প্রকাশিত হয় ঘোষণাটি, যা ‘বেলফোর ডিক্লারেশন’ বা বেলফোর ঘোষণা নামে পরিচিত।
মধ্যপ্রাচ্যের ফিলিস্তিন অঞ্চল থেকে সুমেরীয়, আসেরীয়সহ বিভিন্ন সভ্যতা, কৃষিকাজ আর প্রাচীন প্রধান ধর্মগুলো বিকশিত হয়েছে। দীর্ঘকাল ধরে এ মরু অঞ্চলটিকে সমৃদ্ধ করে এসেছে স্থানীয় জনগোষ্ঠী। কিন্তু বিংশ শতকের শুরুতেই পাল্টে দেয়া হয় এর রাজনৈতিক পটভূমি।
বাণিজ্যকে ভিত্তি করে এশিয়া থেকে মধ্যপ্রাচ্য হয়ে সুদূর আমেরিকা পর্যন্ত কখনই সূর্য অস্ত না যাওয়া এক বিশাল সাম্রাজ্য গড়ে তোলে ব্রিটিশরা। বণিক থেকে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করে অর্ধেক পৃথিবীর শাসক হিসেবে। প্রত্যক্ষ শাসনের অন্তবেলায় পরোক্ষভাবে ঔপনিবেশিক শাসন জিইয়ে রাখতে জাতিগত বিভেদ তৈরিকে কৌশল হিসেবে গ্রহণ করে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য। ভারতীয় উপমহাদেশে হিন্দু-মুসলমান বিভেদ এর অন্যতম উদাহরণ।
তারও আগে ১৯১৭ সালে বেলফোর ঘোষণার মধ্য দিয়ে ইহুদি-আরবদের মধ্যে যে শতবর্ষীয় বৈরিতার সূচনা হয়, তা বিশ্বের সবচেয়ে ‘জঘন্য’ অমীমাংসিত সংঘাতে পরিণত হয়েছে। এর জেরে আজো অস্থির, সহিংস মধ্যপ্রাচ্যের এ অঞ্চল।
ফিলিস্তিনসহ বৃহত্তর আরব অঞ্চলে ইহুদি জনগোষ্ঠীর বসবাস বহু আগে থেকেই। ১৯১৬ সালে চার শতাব্দী পূর্ণ করা অটোমান শাসনামলের অধিকাংশ সময়ই ইহুদিরা মোট জনগোষ্ঠীর ৩ শতাংশের কাছাকাছি ছিল। সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী ছিল আরব মুসলমান ও দ্বিতীয় ছিল খ্রিস্টান সম্প্রদায়।
উনিশ শতকের শুরুতে ফিলিস্তিন অঞ্চলে অটোমান শাসন, ফরাসিদের ক্রমবর্ধমান প্রভাব, বাড়তে থাকা ক্যাথলিক সম্প্রদায় এবং একই অঞ্চলে পূর্বাঞ্চলীয় অর্থোডক্স খ্রিস্টানদের সমর্থনে রাশিয়ার হস্তক্ষেপ— এ ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে প্রভাব ক্ষুণ্ন হওয়ার ভয়ে ভীত ব্রিটিশ সরকারের ফিলিস্তিন অঞ্চলের ইহুদিদের প্রতি সমর্থন বাড়তে থাকে। বিশেষত ১৮৪০-এর গোড়ার দিকে লর্ড পামেরস্টোনের নেতৃত্বে এ সমর্থন বাড়তে থাকে।
সে সময় ব্রিটিশ পররাষ্ট্র বিভাগ ইহুদিদের ফিলিস্তিনে অভিবাসনে উত্সাহিত করতে থাকে। অন্যদিকে উনিশ শতকের শেষ দিকে জায়নবাদীদের উত্থান ব্রিটিশ রাজনীতিতে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করতে থাকে। ফিলিস্তিনে ইহুদিদের প্রতিষ্ঠায় অটোমান শাসন ব্রিটিশদের জন্য একটি বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়।
১৯১৪ সালে অটোমান সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার পর থেকেই ফিলিস্তিনের ভবিষ্যত্ নিয়ে ভাবতে শুরু করে ব্রিটিশ ওয়ার কেবিনেট। বিশ্বের প্রথম মহাযুদ্ধ তখন মাত্র একটি মীমাংসায় পৌঁছেছে। দেশগুলো তখন ধ্বংসের মধ্য থেকে নিজেদের অভ্যন্তরীণ বিপর্যয় ও ঘর ঘোছানোর দিকে মনোযোগ দিতে শুরু করেছে। এরই মধ্যে ১৯১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে ব্রিটিশ ও জায়নবাদীদের মধ্যে উচ্চপর্যায়ের আলোচনা হয়।
১৯ জুন রথচাইল্ড ও জায়নবাদী সংগঠনের প্রেসিডেন্ট (পরবর্তীতে ইসরায়েলের প্রথম প্রেসিডেন্ট) চাইম উয়েইজম্যান একটি খসড়া ঘোষণা প্রস্তুত করেন। সেপ্টেম্বর-অক্টোবরজুড়ে খসড়াটি নিয়ে আলোচনা করে ব্রিটিশ ওয়ার কেবিনেট।
এ পর্যালোচনায় জায়নবাদী ও জায়নবাদবিরোধীদের মতামত গ্রহণ করা হলেও যে অঞ্চলে ইহুদিদের জন্য ‘স্বতন্ত্র আবাসভূমি’ প্রতিষ্ঠার কথা ভাবা হচ্ছে, সে অঞ্চলের স্থানীয় জনগোষ্ঠী ফিলিস্তিনিদেরই মতামত গ্রহণ করেনি ব্রিটিশরাজ।
বেলফোর ঘোষণার দুটি পরোক্ষ ফল সৃষ্টি হয়, যার একদিকে স্বতন্ত্র ইহুদি রাষ্ট্রের উত্থান এবং অন্যদিকে পুরো মধ্যপ্রাচ্যে আরব ও ইহুদিদের মধ্যে দীর্ঘস্থায়ী সংঘাত। ১৯১৭ সালে বেলফোর ঘোষণার পর ব্রিটিশ সেনাবাহিনী ফিলিস্তিনের নিয়ন্ত্রণ নেয়। কয়েক দিনের মধ্যেই গাজা ও জাফার পতন ঘটে। মূলত ৯ ডিসেম্বরের মধ্যে জেরুজালেম ব্রিটিশদের অধিকারে চলে যায়। ব্রিটিশের এ আগ্রাসন ক্ষুব্ধ করে স্থানীয়দের, যা আরো বাড়িয়ে দেয় ১৯২০ সালে ফিলিস্তিনের জন্য ব্রিটিশ ম্যান্ডেট।
এ ম্যান্ডেটের বলে ১৯২০-৪৮ পর্যন্ত ফিলিস্তিন শাসন করে ব্রিটেনের বেসামরিক প্রশাসন। এ সময় ব্রিটিশ নীতি আরব ও ইহুদি উভয় পক্ষকেই অসন্তুষ্ট করে তোলে। চলমান উত্তেজনা ১৯৩৬-৩৯ সালে ফিলিস্তিনে আরব বিদ্রোহের জন্ম দেয়। অন্যদিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ইহুদি নিধন ইসরায়েল রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাকে শক্ত ভিত্তি দেয়।
যদিও ১৯৩৯ সালে ব্রিটিশ সরকারের অনুমোদিত শ্বেতপত্রে ফিলিস্তিন ইহুদি রাষ্ট্র হবে না এবং ইহুদিদের অভিবাসনের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের ঘোষণা দেয়া হয়। কিন্তু ১৯৪৮ সালে ব্রিটিশদের আনুষ্ঠানিকভাবে ম্যান্ডেট ত্যাগ পর্যন্তই এ নীতির স্থায়িত্ব ছিল। এর পরই নখদন্ত বিকশিত করে পুষ্ট হতে থাকে রাষ্ট্রের মধ্যে আরেক অবৈধ রাষ্ট্র।
বেলফোর ঘোষণার মধ্য দিয়ে প্রথমবারের মতো প্রধান কোনো রাজনৈতিক শক্তি প্রকাশ্যে জায়নবাদকে সমর্থন জানায়। ব্রিটিশরাজের এ ঘোষণায় ফিলিস্তিনে ইহুদিদের রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দেয়া হলেও সংখ্যাগরিষ্ঠ স্থানীয় জনগোষ্ঠী ফিলিস্তিনি আরবদের নাগরিক ও ধর্মীয় অধিকার সীমিত করা হয়।
১৯৩৯ সালে এসে নিজেদের ‘এ ভুলটি’ অনুধাবন করে ব্রিটিশ সরকার। ফিলিস্তিনে ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সময় স্থানীয় জনগোষ্ঠীর মতামত গ্রহণ করা উচিত ছিল বলে ‘স্বীকার’ করে ব্রিটিশ সরকার। আর ২০১৭ সালে এসে ঘোষণায় ফিলিস্তিনি আরবদের রাজনৈতিক অধিকার সুরক্ষিত করার প্রয়োজনীতার বিষয়টি ‘স্বীকার’ করে নেয় তারা। ব্রিটিশ ইতিহাস বিশেষজ্ঞ জনাথন স্নেয়ার বেলফোর ঘোষণাকে অসঙ্গতিপূর্ণ, প্রতারণামূলক বলে আখ্যা দিয়েছেন।
বেলফোর ঘোষণা একদা সমৃদ্ধ এ উপত্যকাকে রণভূমিতে পরিণত করেছে। অঞ্চলটির সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর মতামত ও ইচ্ছাকে উপেক্ষা করে তাদের ওপর চাপিয়ে দেয়া হয় অবহেলিত ও রাষ্ট্র পরিচয় পেতে আগ্রাসী এক জাতিকে। আরব-ইহুদিদেরকে চিরকালের জন্য পরস্পরের প্রধান শত্রুতে পরিণত করা হয়। বেলফোর ঘোষণার শর্তবর্ষ পূর্তিতে ইতিহাসের এ দগদগে ক্ষত মুছে যাবে না ঠিকই, কিন্তু বিশ্বের শান্তিকামী মানুষদের আশা— একদিন ফিলিস্তিন-ইসরায়েলের এ দ্বন্দ্বের অবসান ঘটবেই।
Posted ২:৩৪ পূর্বাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ০২ নভেম্বর ২০১৭
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta