কক্সবাংলা ডটকম(৬ ডিসেম্বর) :: আমদানি ও রপ্তানিতে মিথ্যা ঘোষণায় রাজস্ব ফাঁকির অভিযোগ দীর্ঘদিনের। সম্প্রতি আমদানি পর্যায়ে শুল্ক আদায়ের গতি কমে যাওয়ায় এ অভিযোগ আরো জোরালো হয়েছে। বন্দরে বেশকিছু অনিয়মের খবরও পাওয়া যায়। এমন পরিস্থিতিতে একটি অভিযোগের অনুসন্ধান করতে গিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনও (দুদক) বিপুল পরিমাণ শুল্ক ফাঁকির সত্যতা পেয়েছে। সম্প্রতি মন্ত্রিপরিষদ সচিবের কাছে পাঠানো এক চিঠিতে দুদক শুল্ক ফাঁকির বিষয়টি তুলে ধরেছে।
এতে বলা হয়, অনুসন্ধানে জানা যায় যে, মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে পণ্য খালাস করে বিপুল পরিমাণ শুল্ক ফাঁকির ঘটনা ঘটে থাকে। গত মাসের শুরুর দিকে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সচিবের কাছে ঐ চিঠি পাঠিয়েছে দুদক। চিঠিতে এ বিষয়ে বিস্তারিত বলা হয়েছে।
এ অবস্থায় রাজস্ব ফাঁকি ঠেকাতে চট্টগ্রামসহ দেশের সব বন্দরে আমদানি ও রপ্তানি চালান শতভাগ স্ক্যানিংয়ের আওতায় আনার পরামর্শ দিয়েছে সংস্থাটি। বন্দরের সব পণ্য স্ক্যানিংয়ের আওতায় আনতে অর্থমন্ত্রীরও নির্দেশনা রয়েছে।
২০১৮ সালে চট্টগ্রাম বন্দরে বহুল আলোচিত ২২টি পণ্যচালান অভিনব কায়দায় খালাস হওয়ার পর শুল্ক বিভাগের কার্যক্রমের ওপর নজর দেয় বিভিন্ন পক্ষ। ঐসব পণ্যচালানে সন্দেহজনক পণ্য থাকার কথা জানিয়ে শুল্ক গোয়েন্দা বিভাগ তা খালাস না করতে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজের তত্কালীন কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ জানায়।
এরপরও অবসরে যাওয়া কর্মকর্তার ইউজার আইডি ও পাসওয়ার্ড ব্যবহার করে পণ্য খালাস করে নিয়ে যায়। ঐসব পণ্যচালানে কী ধরনের পণ্য ছিল, তা এখনো জানা যায়নি। পরবর্তীতে জানা যায়, অবসরে যাওয়া দুই কর্মকর্তার ইউজার আইডি ব্যবহার হয়েছে প্রায় চার হাজারবার।
এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় গঠিত একটি তদন্ত রিপোর্টে ঐ ঘটনায় চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজ ও বন্দরের ৩২ জন কর্মকর্তা ও কর্মচারিকে দোষী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এছাড়া ঐ প্রতিবেদনে রাজস্ব ফাঁকির পাশাপাশি মিথ্যা ঘোষণায় পণ্য খালাসের ফলে রাষ্ট্রের জন্য ক্ষতিকর অস্ত্র ও বিস্ফোরক প্রবেশের আশঙ্কার কথাও জানানো হয়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, দুদকের ঐ চিঠি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান, নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয় ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সচিবের কাছেও পাঠানো হয়েছে। চিঠিতে সংশ্লিষ্ট অফিসগুলোকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে অনুরোধ জানানো হয়েছে। দুদক সচিব মুহাম্মদ দেলোয়ার বখ্ত স্বাক্ষরিত ঐ চিঠিতে বন্দরে সরকারের রাজস্ব সুরক্ষায় তিনটি বিষয় বাস্তবায়নের অনুরোধ জানানো হয়।
এতে বলা হয়, শতভাগ পণ্যবাহী কন্টেইনার স্ক্যান করার জন্য স্ক্যানার মেশিন স্থাপনের পূর্ব পর্যন্ত পণ্য শতভাগ কায়িক পরীক্ষা করা সমীচীন হবে। এছাড়া পণ্যের এরূপ পরীক্ষার স্থানটি ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরার (সিসি ক্যামেরা) আওতাধীন থাকা প্রয়োজন। এসব কার্যক্রম পরিচালনা বা তথ্য ধারণ, নিয়ন্ত্রণ ও নজরদারির জন্য দায়িত্বশীল কর্মকর্তা নিয়োগ করা এবং শতভাগ কায়িক পরীক্ষার জন্য অতিরিক্ত জনবল প্রয়োজন হলে এ জন্য বাড়তি ব্যয়ের অর্থ আমদানিকারকদের কাছ থেকে আদায় করা যেতে পারে।
সূত্র জানায়, আমদানি-রপ্তানিতে মিথ্যা ঘোষণায় রাজস্ব ফাঁকির বিষয়ে অভিযোগ আসে দুদকের কাছে। এ অভিযোগের বিষয়ে অনুসন্ধানের পর মিথ্যা ঘোষণায় পণ্য খালাসের সত্যতা মেলে। দুদকের চিঠিতে বলা হয়, যদিও বিচ্ছিন্নভাবে দুই একটি ঘটনা ধরা পড়ে, কিন্তু অধিকাংশ ঘটনা উদ্ঘাটন করা সম্ভব হয় না। এ ধরনের ঘটনা শুল্ক কর্তৃপক্ষের ভূমিকাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে এবং সরকারও সঠিক রাজস্ব আহরণে বঞ্চিত হয়।
মিথ্যা ঘোষণায় পণ্য খালাস ঠেকাতে এর আগে দেশের সব বন্দরে পণ্য খালাস প্রক্রিয়ায় শতভাগ স্ক্যানিংয়ের সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছিলেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। গত বাজেট বক্তৃতায়ও এ বিষয়ে ব্যবস্থা রাখার কথা বলেছেন তিনি। তবে এখনো বন্দরে সব পণ্যবাহী কন্টেইনার শতভাগ স্ক্যানিং শুরু হয়নি। এনবিআর সূত্র জানিয়েছে, বর্তমানে বিভিন্ন বন্দরে পণ্য স্ক্যানিংয়ের জন্য ১১টি স্ক্যানার রয়েছে। এর মধ্যে চট্টগ্রাম বন্দরে সাতটি। বাদবাকি চারটির মধ্যে দুইটি বেনাপোল স্থলবন্দরে এবং কমলাপুর আইসিডি ও মোংলা বন্দরে একটি করে স্ক্যানার রয়েছে। এসব স্ক্যানারে আমদানি ও রপ্তানিমুখী পণ্যের খুব অল্প পরিমাণই স্ক্যানিং করা সম্ভব হয়। এ অবস্থায় কেবল উচ্চশুল্কের ও সন্দেহজনক পণ্য চালানই শতভাগ পরীক্ষা করা সম্ভব হচ্ছে।
তবে এনবিআরের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, আরো ১৪টি স্ক্যানার কেনার বিষয়ে এরই মধ্যে দরপত্র আহ্বান করেছে। এতে ব্যয় হবে প্রায় ৫০০ কোটি টাকা। এসব স্ক্যানার পুরোদমে চালু করা গেলে স্ক্যানিংয়ের ক্ষেত্রে বড়ো অগ্রগতি হবে। সেক্ষেত্রে মিথ্যা ঘোষণায় পণ্য খালাসও কমে আসবে বলে মনে করছেন তিনি। তবে তিনি মনে করেন, সব পণ্য স্ক্যানিংয়ের আওতায় আনতে হলে প্রচুর সময় ব্যয় হবে।
শুল্ক আদায় পরিস্থিতি :
সরকারের রাজস্ব আদায়ের মূল খাত তিনটি। এগুলো হলো আয়কর, মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) ও শুল্ক। গত দুই বছর আগেও শুল্ক আদায়ে ১৫ শতাংশের ওপরে প্রবৃদ্ধি ছিল। কিন্তু গত ২০১৮-১৯ অর্থবছর থেকে এটি ব্যাপকভাবে কমতে থাকে।
সর্বশেষ এনবিআরের হিসাব অনুযায়ী, চলতি ২০১৮-১৯ অর্থবছরের জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত প্রথম চার মাসে শুল্ক আদায়ে সবচেয়ে পিছিয়ে এনবিআর। আলোচ্য সময়ে শুল্ক আদায় বাড়েনি বললেই চলে। এ সময় ২৮ হাজার ৪৪৮ কোটি টাকা লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে শুল্ক আদায় হয়েছে ২০ হাজার ৬৪৯ কোটি টাকা। লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ঘাটতি প্রায় ৭ হাজার ৮০০ কোটি টাকা।
২০১৮-১৯ অর্থবছরেও শুল্ক আদায় বেড়েছিল মাত্রা ৩ দশমিক ৪৩ শতাংশ। তখনও প্রবৃদ্ধিতে সবচেয়ে পিছিয়ে ছিল শুল্ক খাত। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে উচ্চশুল্কের পণ্য আমদানির হার কমতির দিকে।
সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, এর সঙ্গে মিথ্যা ঘোষণায় পণ্য খালাসের যোগসূত্র থাকতে পারে।
Posted ২:০০ পূর্বাহ্ণ | শনিবার, ০৭ ডিসেম্বর ২০১৯
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta