কক্সবাংলা ডটকম(২৪ আগষ্ট) :: শনিবার ২৫ আগষ্ট বাংলাদেশের কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফ সীমান্ত এলাকায় রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশের প্রথম বার্ষিকী হলেও তাদের নিজ দেশ মিয়ানমারে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় প্রকৃতপক্ষে কোন অগ্রগতি নেই।মিয়ানমারের সাথে শুধুমাত্র আলোচনা অব্যাহত রয়েছে। অন্যদিকে রাখাইন রাজ্যে উপযোগী পরিবেশ না থাকায় রোহিঙ্গারা এখনো বাংলাদেশে আসছে।
এদিকে দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় দেশগুলোর জোট আসিয়ানের ১৩২ জন সংসদ সদস্য আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে (আইসিসি) মিয়ানামরের বিচার দাবি করেছেন। এক বছর আগে মিয়ানমারের রাখাইনে সহিংসতার পর এটাই দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া থেকে সবচেয়ে ঐক্যবদ্ধ প্রতিবাদ।
পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে বাংলাদেশের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, ‘এখন পর্যন্ত, একমাত্র অগ্রগতি হচ্ছে প্রত্যাবাসন বিষয়ে মিয়ানমারের সাথে আলোচনা বন্ধ হয়নি। দুর্ভাগ্যবশত রাখাইন রাজ্যে অনুকূল পরিবেশের অভাবে রোহিঙ্গারা এখনো বাংলাদেশে আসছে।’
সম্প্রতি সিঙ্গাপুরে মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সেলর অং সান সু চি এক বিবৃতিতে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন বিলম্বিত হওয়ার জন্য বাংলাদেশকে দায়ী করেন। রোহিঙ্গাদের দ্রুত মিয়ানমারের ফেরানোর সময়সীমা বাংলাদেশের ওপর নির্ভর করছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
‘এটি সত্যি নয় যে বাংলাদেশ প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া বিলম্বিত করছে’ উল্লেখ করে ওই কর্মকর্তা বলেন, প্রতি সপ্তাহে এখনো রোহিঙ্গাদের ছোট ছোট দল বাংলাদেশে আসছে।
আগামীকাল ২৫ আগস্ট রাখাইন রাজ্যে মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের ওপর দমন অভিযানের প্রথম বার্ষিকী। অথচ উল্টো প্রতিক্রিয়ায় মিয়ানমার বলছে, পুলিশ স্টেশনে আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরসা) আক্রমণ করেছে।
সেনাবাহিনী ও তাদের সহযোগীরা হাজার হাজার রোহিঙ্গাদের হত্যা করেছে, গ্রামের অসংখ্য ঘরবাড়ি পুড়িয়েছে, ব্যাপক যৌন সহিংসতা চালিয়েছে। ফলে সাত লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছে।
এক সরকারি কর্মকর্তা বলেন, বাংলাদেশ সীমান্ত এখনো খোলা রয়েছে যা নজিরবিহীন এবং মানবিক ভিত্তিতে বাংলাদেশ উদারতা দেখাচ্ছে।
গত মঙ্গলবার সিঙ্গাপুরে এক বক্তব্যে মিয়ানমার নেত্রী সু চি বলেন, রোহিঙ্গা মুসলিমদের রাখাইন রাজ্যে ফেরানোর বিষয়ে সময়সীমা বেঁধে দেয়া কঠিন। কারণ এ বিষয়ে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় নেয়া দেশ বাংলাদেশের সহযোগিতা প্রয়োজন মিয়ানমারের।
তিনি বলেন, ফেরত আসা রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করেছে মিয়ানমার। কিন্তু রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর বিষয়টি বাংলাদেশের ওপর নির্ভর করছে।
রাখাইন রাজ্যে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নির্মম দমন অভিযানের কারণে সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গা মুসলিমদের দেশ ছেড়ে বাংলাদেশে পালানোর ঘটনায় মিয়ানমার সরকারের পদক্ষেপে সমর্থন জানিয়ে সু চি বলেন, সন্ত্রাসবাদের কারণে সংকট সৃষ্টি হয়েছে, সামাজিক বৈষম্যের কারণে নয়।
গত ১১ আগস্ট পররাষ্ট্রমন্ত্রী এএইচ মাহমুদ আলীর নেতৃত্বে বাংলাদেশের প্রতিনিধিদল রাখাইন রাজ্য পরিদর্শনে করে ওই রাজ্যে চালানো ‘ব্যাপক বিধ্বংসী অবস্থা’ পর্যবেক্ষণ করেছেন। বিশেষ করে রোহিঙ্গাদের পুড়ে যাওয়া ঘরবাড়িগুলো সরেজমিনে ঘুরে দেখেছেন। অথচ মিয়ানমার সরকার ওইসব ঘরবাড়িতে ‘দুর্ঘটনাজনিত আগুন’ লেগেছে বলে বর্ণনা করছে।
রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসনের অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে চাইলে পররাষ্ট্র সচিব এম শহিদুল হক বলেন, তারা খুব আশাবাদী যে রোহিঙ্গারা রাখাইনে তাদের নিজ বাড়িতে একটি প্রক্রিয়া মধ্য দিয়ে ফিরে যাবে।
তবে তিনি জানান, মিয়ানমার ফিরে যাওয়ার আগে রোহিঙ্গারা তাদের সুরক্ষা, নিরাপত্তা ও নাগরিক অধিকারের নিশ্চিয়তা চাচ্ছেন। সেজন্য প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়াটি কিছুটা বিলম্বিত হচ্ছে।
‘এতে কোন সন্দেহ নেই যে তারা মিয়ানমার ফিরে যাবেন’, বলেন পররাষ্ট্র সচিব।
তিনি আরো বলেন, ‘পুরো প্রক্রিয়াটি একটি চ্যালেঞ্জ। সব চ্যালেঞ্জেরই একটি সমাধান রয়েছে। আমরা যেকোন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে পারবো যদি দুই দেশের বা দলের মধ্যে একটি দৃঢ় ইচ্ছা আছে। যেটা সবচেয়ে জরুরি।’
দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় দেশগুলোর জোট আসিয়ানের ১৩২ জন সংসদ সদস্য আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে (আইসিসি) মিয়ানামরের বিচার দাবি করেছেন। এক বছর আগে মিয়ানমারের রাখাইনে সহিংসতার পর এটাই দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া থেকে সবচেয়ে ঐক্যবদ্ধ প্রতিবাদ। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ান এখবর জানিয়েছে।
আসিয়ান পার্লামেন্টারিয়ার ফর হিউম্যান রাইটস (এপিএইচআর) প্রকাশিত এক যৌথ বিবৃতিতে এই বিচার চাওয়া হয়েছে। তারা রাখাইন রাজ্যে খুনে অভিযান পরিচালনার জন্য মিয়ানমার সেনাবাহিনীকে বিচারের আওতায় আনার আহ্বান জানিয়েছেন।
১৩২ জন এমপির পক্ষ থেকে এপিএইচআর সদস্য ও মালয়েশিয়ার ক্ষমতাসীন দলের রাজনীতিক চার্লস সান্তিয়াগো বলেন, মিয়ানমার তদন্ত করতে অনিচ্ছুক ও অক্ষম স্পষ্ট হওয়ার কারণে আমরা এখন এমন একটি পর্যায়ে যেখানে জবাবদিহীতা নিশ্চিত করার জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের পদক্ষেপ প্রয়োজন।
চার্লস সান্তিয়াগো আরও বলেন, আমি নির্বাচিত ১৩১ জন এমপির সঙ্গে একমত এবং অবিলম্বে আইসিসিতে মিয়ানমারের বিচারের জন্য জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি। মিয়ানমারের যারা নৃশংস অপরাধে জড়িত তাদের বিচার হওয়া উচিত। তাদেরকে মুক্ত থাকতে দেওয়া যায় না ভবিষ্যতে আবারও এমন অপরাধ করার জন্য।
আসিয়ান এমপিদের এই ঐক্যবদ্ধ দাবি রোহিঙ্গা সংকটের এক বছর পূর্ণ হওয়ার আগে আসলো। গত বছরের ২৫ আগস্ট রাখাইনে নিরাপত্তা বাহিনীর তল্লাশি চৌকিতে হামলার পর রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে পূর্বপরিকল্পিত ও কাঠামোবদ্ধ সহিংসতা জোরালো করে মিয়ানমার সেনাবাহিনী। খুন, ধর্ষণ ও অগ্নিসংযোগের মুখে বাংলাদেশে পালিয়ে আসে প্রায় ৭ লাখ রোহিঙ্গা। হত্যা করা হয়েছে ২৫ হাজার মানুষকে, পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে রোহিঙ্গা গ্রাম এবং নারীরা যৌন হামলা ও ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। জাতিসংঘ এই ঘটনাকে জাতিগত নিধনযজ্ঞ আখ্যায়িত করেছে। যদিও মিয়ানমার এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে। কক্সবাজারের শরণার্থী শিবিরে মানবেতর জীবনযাপনে বাধ্য হওয়া এসব রোহিঙ্গাদের ফেরাতে বাংলাদেশ ও জাতিসংঘের সঙ্গে মিয়ানমার চুক্তি স্বাক্ষর করলেও এখনও শুরু হয়নি প্রত্যাবাসন।
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দশটির দেশের সরকারের সংস্থা আসিয়ান। গত এক বছর রোহিঙ্গা সংকটে সংস্থাটি চোখ বন্ধ করেছিল বলে অভিযোগ রয়েছে। থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়াতে রোহিঙ্গা বোঝাই নৌকা ভীড় করলেও এই ইস্যুতে দৃঢ় অবস্থান নেওয়া থেকে দূরে ছিল আসিয়ান।
এপিএইচআর এর বোর্ড মেম্বার ও ইন্দোনেশিয়ার সংসদ সদস্য এভা কুমা সুন্দরি জানান, আসিয়ান দেশগুলো অন্যদেশের অভ্যন্তরীণ হস্তক্ষেপের নীতি ভাঙা এবং কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার সময় এখন। রোহিঙ্গাদের জন্য ন্যায়বিচারের ইস্যুটি আঞ্চলিক রাজনীতির গণ্ডি অতিক্রম করেছে। এটা পুরো মানবতাকে উদ্বিগ্ন করেছে। একেবারে দায়মুক্তিসহ আমাদের কোনও দেশকে এমন নৃশংসতা চালানোর অনুমতি দিতে পারি না।
বিবৃতিতে ১৩২ জন এমপির নাম থাকলেও তারা মূলত ৫টি দেশের। দেশগুলো হলো ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, ফিলিপাইনের টিমোর লেস্তে এবং সিঙ্গাপুর। এতে প্রমাণিত হয় মিয়ানমারের বিরুদ্ধে কথা বলতে এখনও এ অঞ্চলে বিভিন্ন দেশ অনিচ্ছুক।
জুনে বাংলাদেশের বিভিন্ন সংগঠনের একটি জোট আইসিসি প্রসিকিউটরদের কাছে রোহিঙ্গা নিপীড়নের তথ্য পাঠায়। আইসিসির তদন্তের জন্য শুনানির নেতৃত্ব দিচ্ছেন প্রসিকিউটর ফাতৌ বেনসৌদা।
ঢাকা, ২৩ আগস্ট (ইউএনবি)- জাতিসংঘের উদ্বাস্তুবিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআরের শুভেচ্ছা দূত ও হলিউড অভিনেত্রী কেট ব্লানচেট ২৮ আগস্ট নিরাপত্তা পরিষদে ব্রিফ করবেন।
বাংলাদেশ সফরকালে সাক্ষাৎ হওয়া রোহিঙ্গাদের দুর্ভাগ্যের বিষয়ে মনোযোগ আকর্ষণ করাই তার উদ্দেশ্য।
বৃহস্পতিবার জাতিসংঘ এবং ইউএনএইচসিআরের যুক্তরাজ্য কার্যালয় এক টুইটে এ তথ্য জানিয়েছে।
জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে ২৮ আগস্ট যুক্তরাজ্যের সভাপতিত্বে মিয়ানমার পরিস্থিতি নিয়ে এক ‘উন্মুক্ত ব্রিফিং’ অনুষ্ঠিত হবে বলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন সিনিয়র কর্মকর্তা ইউএনবিকে জানিয়েছেন।
তিনি বলেন, জাতিসংঘ মহাসচিব এবং সংস্থার উদ্বাস্তুবিষয়ক হাইকমিশনার নিরাপত্তা পরিষদকে ব্রিফ করার কথা রয়েছে।
এছাড়া, বিষয়টি নিয়ে আগামী সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘের ৭৩তম সাধারণ অধিবেশনের সাধারণ বিতর্ক ও উচ্চ-পর্যায়ের আয়োজনকালে উচ্চ-পর্যায়ের বৈঠক ও অন্যান্য অনুষ্ঠান হবে বলে কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
বাংলাদেশ সফরকালে অস্কারজয়ী অভিনেত্রী কেট ব্লানচেট বলেন, রোহিঙ্গা সংকটের সমাধান মিয়ানমারে রয়েছে। সেখানে রোহিঙ্গাদের নিরাপদ প্রত্যাবাসনের পরিবেশ তৈরি করতে দেশটির প্রতি আহ্বান জানান তিনি।
সফর শেষে ইউএনবিকে দেয়া এক সাক্ষাতকারে তিনি বলেন, ‘চূড়ান্তভাবে আমার মনে হয়, তাদের (রোহিঙ্গা) রাষ্ট্রহীনতার বিষয়টিতে নজর দেয়াই হচ্ছে মূল ব্যাপার।’ উদ্বাস্তুরা যখন ফিরে যেতে চাইবেন তখন তাদের ফেরানোর জন্য উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করতে আরো অনেক কিছু করা দরকার বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
২০১৬ সালের মে মাসে ইউএনএইচসিআরের শুভেচ্ছা দূত হওয়া কেট ব্লানচেটের মতে, বাংলাদেশে পালিয়ে আসা উদ্বাস্তুদের নিরাপদে, স্বেচ্ছায় ও সম্মানের সাথে ফিরিয়ে নেয়ার জন্য রাখাইন রাজ্যের বর্তমান পরিস্থিতি পরিষ্কারভাবেই অনুকূলে নেই।
এদিকে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, রোহিঙ্গা সংকট শুরুর এক বছর হয়ে গেলেও উদ্বাস্তুদের নিরাপদে ফেরানোর জন্য রাখাইন রাজ্যের পরিস্থিতি উন্নয়নে দৃশ্যমান অগ্রগতি অর্জনের ক্ষেত্রে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ সামান্যই চেষ্টা চালিয়েছে, যদিও জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বিষয়টির সাথে সক্রিয়ভাবে জড়িত আছে।
Posted ৩:৩০ অপরাহ্ণ | শুক্রবার, ২৪ আগস্ট ২০১৮
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta