কক্সবাংলা ডটকম(২৮ জুন) :: দুই বছর চেষ্টার পর বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ অ্যাকাউন্ট থেকে ১০ কোটি ১০ লাখ ডলার চুরির ঘটনায় সন্দেহভাজন বিদেশী অপরাধী ও প্রতিষ্ঠানের তথ্য পেতে শুরু করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)।
এরই মধ্যে সংস্থাটির হাতে এসেছে চার দেশের সন্দেহভাজন ৬২ ব্যক্তি ও পাঁচ প্রতিষ্ঠানের পূর্ণাঙ্গ তথ্য। এ তথ্য প্রাপ্তির মাধ্যমে গতি পেয়েছে তদন্ত। চলতি বছরেই মামলাটির চার্জশিট আদালতে দাখিল করা সম্ভব হবে বলে ধারণা তদন্তসংশ্লিষ্টদের।
দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় সাইবার অপরাধের এ মামলায় তদন্ত করছে সিআইডির অর্গানাইজড ক্রাইম। সংস্থাটির ভাষ্যমতে, রিজার্ভ চুরি প্রক্রিয়ায় সন্দেহভাজন ফিলিপাইনের নাগরিকের মধ্যে ব্যাংক কর্মকর্তা, অর্থ গ্রহণকারী ও সুবিধাভোগী ব্যক্তিরা রয়েছেন। চুরির অর্থ ফিলিপাইনের ব্যাংক থেকে বেরিয়ে যায় চীনের ২৩ জুয়াড়ির হাতে।
এদের মধ্যে আছেন ক্যাসিনো মালিক ও এজেন্ট। ফিলিপাইনের মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ কাউন্সিল (এএমসিএল) এসব সন্দেহভাজনের নাম-ঠিকানা সরবরাহ করেছে। এছাড়া চুরি হওয়া অর্থ নিয়ে সে দেশের রিজাল কমার্শিয়াল ব্যাংকিং করপোরেশন (আরসিবিসি) কর্মকর্তাদের কথোপকথনের রেকর্ডও সিআইডির হাতে পৌঁছেছে।
তদন্তসংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা জানান, চার দেশের সন্দেহভাজন ৬২ নাগরিক ও পাঁচ প্রতিষ্ঠানের তথ্য চেয়ে লেটার অব রোগাটরি (এলওআর) ও মিউচুয়াল লিগ্যাল অ্যাসিস্ট্যান্স (এমএলএ) রিকোয়েস্ট পাঠায় সিআইডি।
যাদের তথ্য চাওয়া হয়, তাদের মধ্যে আছেন— আরসিবিসির তত্কালীন শাখা ব্যবস্থাপক মায়া সান্তোস দেগুইতো, ফিলিপাইনের রেমিট্যান্স স্থানান্তরকারী প্রতিষ্ঠান ফিলরেমের প্রেসিডেন্ট স্লুইড বাতিস্তা, ব্যবসায়ী উইলিয়াম সো গো, সে দেশের নাগরিক ফ্রান্সিসকো ক্রুজ, জেসি ক্রিস্টোফার লাগ্রোসাস, আলফ্রেড সান্তোস ভেরগারা, এনরিকো টিয়োডরো ভ্যাসকুয়েজ ও রোমালদো আগ্রাদোসহ মোট ৩৩ ফিলিপিনো।
এছাড়া চুরির অর্থ জুয়ার বোর্ডে সরিয়ে বৈধ করার চেষ্টা চালায় ফিলিপাইনের ক্যাসিনো ইস্টার্ন হাওয়াই লেইজার কোম্পানি, যার মালিক কিম অং ওরফে ক্যাম সিং অং’সহ চীনের ১৮ নাগরিকের তথ্য চেয়েছিলেন তদন্তসংশ্লিষ্টরা।
চুরি যাওয়া ১০ কোটি ১০ লাখ ডলার থেকে শ্রীলংকায় পাঠানো হয় ২ কোটি ডলার। এ অর্থ গ্রহণ করে শ্রীলংকার বেসরকারি সংস্থা শালিকা ফাউন্ডেশন। এজন্য ওই সংস্থার ছয় পরিচালক শালিকা গোমেজ পেরেরা, সানজেবা টিসা বান্দারা, শিরানি ধাম্মর্কি ফার্নান্দো, ডন প্রসাদ রোহিতা, নিশান্থা নালাকা, ওয়ালাকুরুয়ারাচ্চি ও তাদের এক সহযোগীর তথ্য চেয়ে সিআইডির পক্ষ থেকে ওই দেশে লেটার অব রোগাটরি পাঠানো হয়।
চিঠি পাওয়ার দেড় বছরেরও বেশি সময় পর শ্রীলংকার পক্ষ থেকে ওই আট নাগরিকের পূর্ণাঙ্গ তথ্য পাঠানো হয়েছে।
ফিলিপাইন, চীন ও শ্রীলংকার পাশাপাশি রিজার্ভ চুরিতে জাপানের এক নাগরিকের সংশ্লিষ্টতা উঠে আসে সিআইডির তদন্তে। তার নাম সাসাকিম তাকাশি। তার বিষয়েও তথ্য চেয়ে মিউচুয়াল লিগ্যাল অ্যাসিস্ট্যান্স রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছিল সিআইডি। জবাবে জাপানি কর্তৃপক্ষ সাসাকিম তাকাশির পূর্ণাঙ্গ তথ্য পাঠিয়েছে।
সন্দেহভাজন ৬২ ব্যক্তির পাশাপাশি রিজার্ভ চুরির সঙ্গে পাঁচটি প্রতিষ্ঠানের সংশ্লিষ্টতাও উঠে আসে সিআইডির তদন্তে।
এর মধ্যে রয়েছে— ফিলিপাইনের আরসিবিসি, ইস্টার্ন হাওয়াই লেইজার কোম্পানি, ফিলরেম, ব্লু-বেরি অ্যান্ড হোটেল ও শ্রীলংকার শালিকা ফাউন্ডেশন। এছাড়া ভারতীয় প্রতিষ্ঠান ওয়ার্ল্ড ইনফরমেটিকসকে রিজার্ভ চুরির ঘটনায় দায়ী করা হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ফরাসউদ্দিনের তদন্ত প্রতিবেদনে।
সিআইডির মুখপাত্র ও অর্গানাইজড ক্রাইমের বিশেষ পুলিশ সুপার মোল্যা নজরুল ইসলাম বলেন, রিজার্ভ চুরির ঘটনাটি একটি আন্তঃদেশীয় অপরাধ। মামলা তদন্তে দেশীয় অংশের কাজ আগেই শেষ হয়েছে। কিন্তু বিদেশী সন্দেহভাজনদের পূর্ণাঙ্গ তথ্য না পাওয়ায় আদালতে চার্জশিট দাখিল করা যাচ্ছিল না। কারণ চার্জশিট তো হবে একটাই, সেখানে বিদেশীর নামও থাকবে। সেজন্যই পূর্ণাঙ্গ তথ্য প্রাপ্তি জরুরি ছিল।
এরই মধ্যে ফিলিপাইন, চীন, শ্রীলংকা ও জাপানের সন্দেহভাজন অপরাধীদের তথ্য আমাদের হাতে এসেছে। আশা করছি, এ বছরেই রিজার্ভ চুরি মামলার চার্জশিট আদালতে দাখিল করা সম্ভব হবে। তবে চূড়ান্ত তদন্তে বিদেশী সন্দেহভাজনদের সংখ্যা কম-বেশি হতে পারে বলেও জানান তিনি।
বিদেশী অপরাধীদের তথ্য পেয়ে নড়েচড়ে বসেছেন তদন্তসংশ্লিষ্টরা। চলতি মাসের শুরুতেই সিআইডির দুই কর্মকর্তা ফিলিপাইন সফরে যান। সে দেশের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে সন্দেহভাজন অপরাধীদের নজরদারিতে রাখার অনুরোধ জানানো হয়েছে। একই প্রক্রিয়ায় চীন, জাপান ও শ্রীলংকার অপরাধীদেরও নজরদারিতে রাখতে ওইসব দেশে সফরের পরিকল্পনা রয়েছে তদন্তসংশ্লিষ্টদের। আগামী মাসের মাঝামাঝি সময়ে চীন, শ্রীলংকা ও জাপান সফরে যেতে পারেন কর্মকর্তারা।
২০১৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি হ্যাকাররা নিউইয়র্কের ফেডারেল রিজার্ভ থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের ১০১ মিলিয়ন ডলার হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে শ্রীলংকা ও ফিলিপাইনের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে স্থানান্তর করে। এর মধ্যে শ্রীলংকার একটি ব্যাংক সন্দেহজনক লেনদেন বুঝতে পেরে ২ কোটি ডলার আটকে দেয়। আর ৮১ মিলিয়ন ডলার (৮ কোটি ডলার) যায় ফিলিপাইনের আরসিবিসির চারটি অ্যাকাউন্টে।
এ ঘটনায় আরবিসির ছয় কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ফিলিপাইনের অ্যান্টি-মানি লন্ডারিং কাউন্সিল মামলা করে। ওই মামলায় সাক্ষ্য দিতে রিজার্ভ চুরি মামলার তদন্ত কর্মকর্তাকে ফিলিপাইনে তলব করা হয়েছে। এর আগে বেশ কয়েকবার সিআইডির পক্ষ থেকে ঘটনা তদন্তে ফিলিপাইন যান একাধিক কর্মকর্তা। তবে এবারই প্রথম বিদেশী সরকারের আহ্বানে রিজাল ব্যাংকের সম্পৃক্ততার ব্যাপারে সাক্ষ্য দিতে বাংলাদেশের কোনো তদন্তকারী ফিলিপাইন যাচ্ছেন।
Posted ৬:২৩ অপরাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ২৮ জুন ২০১৮
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta