কক্সবাংলা ডটকম(১ জুন) :: যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইস্পাত ও অ্যালুমিনিয়ামের ওপর শুল্ক আরোপ করায় এখন পাল্টা শুল্ক আরোপ করা শুরু করেছে চাপে পড়া দেশগুলো। যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র দেশগুলোই দেশটির বিরুদ্ধে পাল্টা শুল্ক আরোপের পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হচ্ছে।
এদের মধ্যে রয়েছে রয়েছে কানাডা, মেক্সিকো ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন।
যুক্তরাজ্যভিত্তিক সংবাদমাধ্যম গার্ডিয়ান লিখেছে, যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যমন্ত্রী উইলবার রসের দেওয়া ঘোষণায় পুরো বিশ্বের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা কেঁপে উঠেছে। রস জানিয়েছেন, ইস্পাত ও অ্যালুমিনিয়ামের ওপর আরোপিত শুল্ক থেকে অব্যাহতির যে সুযোগ ইউ, কানাডা ও মেক্সিকো পেয়ে আসছিল তা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের যুক্তি, ওই দেশগুলোর সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি দূর করার বিষয়ে অনুষ্ঠিত আলোচনায় কার্যকর কোনও অগ্রগতি হয়নি। তাছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের ইস্পাত ও অ্যালুমিনিয়াম শিল্পকে সুরক্ষা দেওয়ার বিষয়টিও সামনে আনা হয়েছে। এর পাশাপাশি শুল্ক আরোপে ‘জাতীয় নিরাপত্তার দোহাই’ দেওয়াতেই তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়েছে।
ইউ নেতারা এ সিদ্ধান্তে প্রবল ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন; পাল্টা ব্যবস্থার হুমকিও দিয়েছেন। কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্র এখন ওই দেশগুলোর সঙ্গে বাণিজ্য যুদ্ধ শুরুর দ্বারপ্রান্তে উপস্থিত হয়েছে। বিশ্লেষকরা মন্তব্য করেছেন, ইউরোপকে ‘শত্রু’ জ্ঞান করলে তা মার্কিন ভোক্তাদের জন্য ভালো ফল বয়ে আনবে না।
বৃহস্পতিবার রাতে ইউলবার রস জানিয়েছেন, ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোর জন্য ইস্পাত রফতানিতে ২৫ শতাংশ ও অ্যালুমিনিয়াম রফতানিতে ১০ শতাংশ শুল্ক প্রযোজ্য হবে। এর জবাব পেতে দেরি হয়নি। ইউরোপিয়ান কমিশনের প্রেসিডেন্ট জিন ক্লড জাংকার সঙ্গে সঙ্গেই জানিয়ে দিয়েছেন, পাল্টা ব্যবস্থা নেওয়া হবে। মাস দুয়েক আগে যখন ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রথম শুল্ক আরোপের বিষয়টি উপস্থাপন করেন তখন ইউ, কানাডা ও মেক্সিকোকে শুল্ক থেকে সাময়িক অব্যহতি দেওয়া হয়েছিল।
যুক্তরাষ্ট্রের শুল্কের মুখে পড়া দেশগুলোর পাল্টা ব্যবস্থা নেওয়ার হুমকির কারণে ডাও জোন্স সূচকের পতন হয়েছে ২৫০ পয়েন্ট। বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর শেয়ার বিক্রি করে দিচ্ছেন বিনিয়োগকারীরা। ইউরোপের শেয়ার বাজারেও একই প্রবণতা দেখা গেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের সিদ্ধান্তকে জাংকার ‘অযৌক্তিক’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন এবং বলেছেন যুক্তরাষ্ট্রের পণ্যের ওপর পাল্টা শুল্ক আরোপ করা ও ওয়ার্ল্ড ট্রেড অর্গানাইজেশনে আবেদন করা ছাড়া তাদের আর কোনও পথ নেই। তার ভাষ্য, ‘আন্তর্জাতিক আইন মেনেই আমরা ইউনিয়নের স্বার্থ সমুন্নত রাখার চেষ্টা করব।’ এর আগে ইইউয়ের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছিল, লেভিস জিনস, হার্লে ডেভিডসন মোটরসাইকেল ও বৌরবন মদ যুক্তরাষ্ট্র থেকে রফতানির ওপর পাল্টা শুল্ক আরোপ করা হবে।
যুক্তরাজ্য আশা করেছিল, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একটি সমঝোতা করা সম্ভব হবে। কিন্তু রসের ঘোষণায় তারাও হতাশ। দেশটির আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বিষয়ক মন্ত্রী লিয়ান ফক্স বলেছেন, যুক্তরাজ্য ওয়ার্ল্ড ট্রেড অর্গানাইজেশনে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অভিযোগ দাখিল করা ও পাল্টা শুল্ক আরোপের মতো ব্যাবস্থা বাস্তবায়নের সম্ভাবনা নাকচ করে দিচ্ছে না। স্কাই নিউজ টিভি চ্যানেলে কথা বলায় সময় তিনি যুক্তরাষ্ট্রের আরোপ করা শুল্ককে ‘শুরু থেকেই উদ্ভট’ আখ্যা দিয়ে বলেছেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের উচিত সিদ্ধান্তটি নিয়ে আবার ভেবে দেখা। এটা সত্যি খুব করুণ বিষয় হবে যদি আমাদের ‘ঢিলের বদলে পাটকেল ছোড়ার মতো’ সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ মিত্রের বিরুদ্ধে পাল্টা শুল্ক আরোপের সিদ্ধান্ত নিতে হয়।’
যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মের পক্ষ থেকে একজন মুখপাত্র মন্তব্য করেছেন, দেশটির সরকার ‘গভীরভাবে হতাশ’ এবং থেরেসা মে আগামী সপ্তাহে কানাডায় অনুষ্ঠিতব্য জি-৭ সম্মেলনে ট্রাম্পের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে কথা বলবেন। যুক্তরাজ্যে প্রত্যাশা করে, ‘ইস্পাত ও অ্যালুমিনিয়াম রফতানির ওপর আরোপিত শুল্ক থেকে যুক্তরাজ্য ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের মতো যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ মিত্রদের স্থায়ীভাবে অব্যাহতি দেওয়া হবে।’
ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট যুক্তরাষ্ট্রের আরোপ করা ওই শুল্ককে ‘অবৈধ’ এবং ‘ভুল’ আখ্যা দিয়েছেন। অন্যদিকে কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো একই রকম পাল্টা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। কানাডা এখন থেকে যুক্তরাষ্ট্রের ১ হাজার ৬৬০ কোটি ডলার সমমূল্যের রফতানির ওপর সর্বোচ্চ ২৫ শতাংশ হারে শুল্ক আরোপ করেছে। গত বছর যুক্তরাষ্ট্রে কানাডার মোট ইস্পাত রফতানির পরিমাণ ছিল ১ হাজার ৬৬০ কোটি ডলার। সেটার সঙ্গে মিল রেখে পাল্টা শুল্ক আরোপে রফতানি অর্থমূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে। শুল্ক আরোপের বিষয়ে হোয়াইট হাউসের পক্ষ থেকে জাতীয় নিরাপত্তার দোহাই দেওয়ার প্রতিবাদে জাস্টিন ট্রুডো বলেছেন, কানাডীয়রা মার্কিনিদের সঙ্গে অস্ত্র হাতে পাশাপাশি যুদ্ধ করেছে। তাদের বিরুদ্ধে জাতীয় নিরাপত্তার সংক্রান্ত সন্দেহ করা অগ্রহণযোগ্য। কানাডার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ক্রিস্টিয়া ফ্রিল্যান্ড একধাপ এগিয়ে গিয়ে বলেছেন, যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে বাণিজ্য বিষয়ে এটিই কানাডার সবচেয়ে কড়া সিদ্ধান্ত। তার ভাষ্য, ‘এটা যুক্তরাষ্ট্রের খুব খারাপ সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কানাডার নেওয়া খুব শক্তিশালী সিদ্ধান্ত।’
প্রতিবেশী মেক্সিকো যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক আরোপের সিদ্ধান্তের বিষয়ে গভীরভাবে হতাশ এবং সিদ্ধান্তটি তাদের কাছে অগ্রহণযোগ্য। মেক্সিকোর অর্থমন্ত্রী বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের সিদ্ধান্তের পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে তারাও সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করেছেন। তারা বাতি, মাংস, সসেজ, আপেল, আঙুর, ক্র্যানবেরি, পনিরসহ অন্যান্য মার্কিন পণ্যের ওপর সেই পরিমাণ শুল্ক আরোপের কথা ভাবছেন যাতে যুক্তরাষ্ট্রের আরোপ করা শুল্কের কারণে হওয়া ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়া যায়।
অক্সফোর্ড ইকোনোমিক্সের একজন গবেষক বলেছেন, এখন পর্যন্ত পাল্টাপাল্টি শুল্ক আরোপের যে ধারা দেখা যাচ্ছে তাতে ইউরোপের বাণিজ্যে সামান্য প্রভাব পড়বে। কারণ ইস্পাত ও অ্যালুমিনিয়ামের ওপর আরোপ করা শুল্কের পরিমাণ ইউরোপের জিডিপির ০.১ শতাংশ। কিন্তু তার আশঙ্কা, যদি এভাবে পালটাপালটি শুল্ক আরোপ চলতে থাকে তাহলে এর রেশ গিয়ে পড়বে গাড়ি মতো পণ্যে। আর তা হলে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেবে। গত সপ্তাহে ট্রাম্প প্রশাসন জানিয়ে দিয়েছে, জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে তারা গাড়ি আমদানির বিষয়ে তদন্ত শুরু করেছে। গার্ডিয়ানের মতে, এই ঘটনা শেষ পর্যন্ত ইউরোপ, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়া থেকে আমদানিকৃত গাড়ির ওপর শুল্ক বসানোর সিদ্ধান্তে ভূমিকা রাখতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রের সিদ্ধান্তের বিষয়ে ‘ইউকে স্টিলের’ প্রধান গারেথ স্টেস বলেছেন, ‘ট্রাম্প আগেই বন্দুকে গুলি ভরেছিলেন। এবার সেই গুলি চালানো হয়েছে যা ক্ষতিকর বাণিজ্য যুদ্ধের পথ তৈরি করে দিয়েছে।’ ইস্পাত ও অ্যালুমিনিয়ামের ওপর আরোপ করা শুল্কের বিষয়ে তার মত, ‘এখন আমরা যেমন যুক্তরাজ্যকে ক্ষতিগ্রস্ত হতে দেখব তেমন যুক্তরাষ্ট্রকেও।’
খোদ যুক্তরাষ্ট্রের ধাতু শিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরাই যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক আরোপের বিষয়ে ভিন্নমত প্রকাশ করেছেন। ‘দ্য কোয়ালিশন ফর আমেরিকান মেটাল ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড ইউজার্সের’ পক্ষে পল নাথানসন বলেছেন, ‘বুঝতে ভুল করবেন না, যুক্তরাষ্ট্রে কাঁচামাল প্রবেশ বাধাগ্রস্ত করা ও আমাদের ঘনিষ্ঠ সহযোগীদের কাছ থেকে করা আমদানির ওপর শুল্ক আরোপ করা সরাসরি আমেরিকান উৎপাদনকারীদেরই ক্ষতিগ্রস্ত করবে।’ যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক আরোপের সিদ্ধান্ত ব্যাখ্যা করতে গিয়ে সিবিআইয়ের বেন ডিগবি তার বিশ্লেষণ তুলে ধরেছেন, সমস্যাটি আসলে শুরু হয়েছে ধাতুর অতিউৎপাদন থেকে যে সমস্যার সমাধানে যুক্তরাষ্ট্র ও ইইউকে যৌথভাবে কাজ করতে হবে।
ইউরোপিয়ান পিপলস পার্টির ম্যানফ্রেড ওয়েবার মন্তব্য করেছেন, ইইউকে ‘শত্রু’ হিসেবে চিহ্নিত করাটা যুক্তরাষ্ট্রের ভোক্তাদের জন্য ক্ষতি ডেকে আনবে। তার ভাষ্য, ‘ইউরোপ বাণিজ্য সংঘাত চায় না। আমরা ন্যায়সঙ্গত বাণিজ্য ব্যবস্থার প্সখে যাতে সভার লাভ হয়। আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করার জন্য আমরা সব রকমভাবে চেষ্টা করেছি। এখন প্রেসিডেন্ট ট্র্যাম্প যদি ইউরোপকে শত্রু হিসেবেই দেখতে চান তাহলে ইউরোপকেও তার শিল্প, কর্মসংস্থান ও শ্রমিকদের স্বার্থ রক্ষায় কাজ করতে হবে।’ ম্যানফ্রেড ওয়েবার জার্মানির চ্যান্সেলর অ্যাঞ্জেলা মার্কেলের রাজনৈতিক সহযোগী। তার দল ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টে থাকা সবচেয়ে বড় গ্রুপ।
ভারতও যুক্তরাষ্ট্রের আরোপিত শুল্কের জবাবে পাল্টা ব্যবস্থা নিয়েছে। ইস্পাত ও অ্যালুমিনিয়ামের ওপর মার্কিন শুল্ক আরোপের কারণে ভারতের ক্ষতি যথাক্রমে ৩ কোটি ১০ লাখ ডলার ও ১৩ কোটি ৪০ লাখ ডলার। ওয়ার্ল্ড ট্রেড অর্গানাইজেশনের কাছে ভারতের হস্তান্তর করা মার্কিন পণ্যের তালিকায় রয়েছে সয়াবিন তেল, পাম তেল, কাজু বাদামসহ অন্যান্য পণ্য। ট্রাম্পের আরোপ করা শুল্ক বাতিল না হলে ওইসব মার্কিন পণ্যে নতুন হারের শুল্ক কার্যকর হবে জুনের ২১ তারিখ থেকে।
Posted ১:২৪ পূর্বাহ্ণ | শনিবার, ০২ জুন ২০১৮
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta