কক্সবাংলা ডটকম :: ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধসহ নানা কারণে বিশ্ববাজারে অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেছে ভোজ্যতেলের দাম। গত তিন মাসে পণ্যটির দাম বেড়েছে সবচেয়ে বেশি। জানুয়ারিতে সয়াবিনের আমদানি মূল্য ছিল টনপ্রতি ১ হাজার ৪৭০ ডলার। রেকর্ড পরিমাণ দাম বেড়ে মার্চে এটির বুকিং দর টনপ্রতি ১ হাজার ৯৫৭ ডলারে উঠে গেছে। বিশ্ববাজারে ভোজ্যতেলের এ উচ্চমূল্যের কারণে দেশের ব্যবসায়ীদের আমদানি ঋণপত্র বা এলসি খোলার হার কমতে শুরু করেছে। এতে ঈদের পর দেশে ভোজ্যতেলের সরবরাহ ব্যবস্থাপনায় সংকট দেখা দিতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন বাজারসংশ্লিষ্টরা।
দেশে ভোজ্যতেলের বার্ষিক চাহিদা প্রায় ২০-২২ লাখ টন। এর মধ্যে ৬৫ শতাংশ পাম অয়েল ও ৩৫ শতাংশ সয়াবিন অয়েল। পাম অয়েল আমদানি হয় মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া থেকে এবং সয়াবিন আমদানি হয় আর্জেন্টিনা থেকে। অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় ভোজ্যতেলের দাম রেকর্ডের পর রেকর্ড ভাঙছে। সর্বশেষ মার্চে অপরিশোধিত সয়াবিনের টনপ্রতি বুকিং দর ছিল ১ হাজার ৯৫৭ ডলার এবং পাম অয়েলের বুকিং দর ছিল ১ হাজার ৭৭৭ ডলার। এ দামে আমদানির পর কর্মীদের বেতন-ভাতা, পরিবহন, গ্যাস-বিদ্যুৎ খরচ, প্যাকেজিংসহ ব্যাংকঋণের সুদের হিসাবে নির্ধারিত দামের চেয়ে লিটারপ্রতি খরচ অনেক বেশি হয় বলে দাবি ব্যবসায়ীদের।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, ভোজ্যতেলের দাম নির্ধারণ হয় মূলত মজুদ, এলসিসহ এক্স-বন্ডের অধীনে থাকা পণ্যের আমদানি মূল্যের বিবেচনায়। ফেব্রুয়ারিতে দেশে নতুন দাম নির্ধারণের সময় সয়াবিনের আমদানি মূল্য ছিল ১ হাজার ৪০৭ ডলার, বর্তমানে যা প্রায় ২ হাজার ডলার ছুঁইছুঁই। এ অবস্থায় অধিকাংশ কোম্পানিই ভোজ্যতেল আমদানির জন্য এলসি খোলার পরিমাণ কিছুটা কমিয়ে দিয়েছে।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, বিশ্ববাজারে দাম বেড়ে যাওয়ায় প্রতিদিনই আমদানিকারকরা লোকসান দিচ্ছেন। সে কারণে অনেকটা বাধ্য হয়ে আমদানির পরিমাণ কমাতে হচ্ছে তাদের। অন্যান্য ভোগ্যপণ্য আমদানি স্বাভাবিক থাকলেও ভোজ্যতেল আমদানিতে ঋণপত্র খুলতে ধীরে চলো নীতি বেছে নিয়েছেন আমদানিকারকরা।
এ বিষয়ে দেশের শীর্ষস্থানীয় ভোজ্যতেল আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান টি কে গ্রুপের পরিচালক (ফ্যাইন্যান্স অ্যান্ড অপারেশন) শফিউল আতহার তাসলিম বলেন, ভোগ্যপণ্যসহ যেকোনো ধরনের পণ্য আমদানি ও বিক্রির ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীদের স্বাধীনতা থাকে। কিন্তু ভোজ্যতেলের ক্ষেত্রে সে সুযোগ নেই। গত দেড়-দুই মাসে বিশ্ববাজারে তেলের দাম অতিরিক্ত বেড়ে যাওয়ায় ব্যবসায়ীরা ভোজ্যতেল আমদানি, পরিশোধন ও বিপণনে ৮০০-৯০০ কোটি টাকা লোকসান দিয়েছেন।
শফিউল আতহার তাসলিম আরো বলেন, বিশ্ববাজারে তেলের দাম এমন ঊর্ধ্বমুখী থাকলে ভোগের পরিমাণ কমবে। তখন স্বাভাবিকভাবেই ব্যবসায়ীদের আমদানির পরিমাণ কমিয়ে দিতে হবে।
দেশের শীর্ষ এক আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের পরিচালক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ২০১৯ সালের শেষ দিকে এবং কভিড-১৯ মহামারী শুরুর আগে বিশ্ববাজারে সয়াবিনের দাম ছিল টনপ্রতি ৬০০ ডলার। সে সময় দেশে লিটারপ্রতি বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম ছিল ১০০ টাকা। ব্যবসায়ীরা এ দামে ভোজ্যতেল বিক্রি করেও মুনাফা করতেন। এখন বিশ্ববাজারে প্রতি টন সয়াবিনের দাম ১ হাজার ৮০০ থেকে ১ হাজার ৯০০ ডলারে উঠে গেলেও দেশে দাম নির্ধারিত রয়েছে ১৬০-১৬৩ টাকা। ফলে স্বাভাবিকভাবেই নতুন এলসি খুলতে অনীহা দেখা দিতে পারে ব্যবসায়ীদের মধ্যে।
এ ধারা অব্যাহত থাকলে ঈদের পর দেশে ভোজ্যতেলের সরবরাহ চেইন ভেঙে পড়বে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেন এ ব্যবসায়ী। তিনি বলেন, লোকসানের ভয়ে কোনো ব্যবসায়ী পণ্য আমদানিতে অনাগ্রহী হতে পারেন। সেক্ষেত্রে বাজারে সংকট দেখা দিলে তাকে দায়ী করা যাবে না।
স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের ভাইস প্রেসিডেন্ট ও খাতুনগঞ্জ শাখার প্রধান সাব্বির আহমেদ চৌধুরী বলেন, বৈশ্বিক দাম যতই বাড়ুক না কেন ভোগ্যপণ্যের সরবরাহ চেইন ধরে রাখতে আমদানি প্রক্রিয়া চলমান রাখেন ব্যবসায়ীরা। কয়েক বছরের মধ্যে ভোগ্যপণ্যের দাম অস্বাভাবিক বাড়লেও আমদানি থেমে নেই। অন্যান্য আমদানি পণ্যের ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীরা দাম নির্ধারণ করতে পারলেও ভোজ্যতেলের ক্ষেত্রে সরকারের অনুমোদন নিতে হয়। এ কারণে অন্যান্য ভোগ্যপণ্যের এলসি খোলার পরিমাণ স্বাভাবিক থাকলেও সে তুলনায় ভোজ্যতেলের এলসি খোলার পরিমাণ কিছুটা কম। পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে ব্যবসায়ীরা কিছুটা লাগাম টেনেছেন বলেই মনে করছেন তিনি।
বিশ্বব্যাংকের কমোডিটিজ প্রাইস ডাটা অ্যানুয়াল অ্যাভারেজেস সূত্রে জানা গিয়েছে, ২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত অপরিশোধিত পাম অয়েলের টনপ্রতি বুকিং গড় দর ছিল ৬০১ ডলার। ক্রমান্বয়ে সেটি বাড়তে বাড়তে ২০২০ সালে ৭৫২ ডলার এবং ২০২১ সালে ১ হাজার ১৩১ ডলারে উঠে যায়। সর্বশেষ মার্চে পাম অয়েলের বুকিং দর বেড়ে ১ হাজার ৭৭৭ ডলারে উন্নীত হয়েছে। একইভাবে ২০১৯ সালের জানুয়ারি-ডিসেম্বর পর্যন্ত সয়াবিনের গড় বুকিং দর ছিল ৭৬৫ ডলার। ২০২০ সালে বেড়ে ৮৩৮ ডলার ও ২০২১ সালে আরো বেড়ে ১ হাজার ৩৮৫ ডলারে উন্নীত হয়। তবে সবচেয়ে বেশি দাম বেড়েছে সর্বশেষ তিন মাসে। রেকর্ড পরিমাণ দাম বেড়ে গত মার্চে সয়াবিনের বুকিং দর টনপ্রতি ১ হাজার ৯৫৭ ডলারে উঠে গেছে। একইভাবে পাম কার্নেল অয়েলের ২০১৯ সালের বার্ষিক গড় দাম ৬৬৫ ডলার থেকে বেড়ে সর্বশেষ মার্চে উঠে গেছে ২ হাজার ৪৪১ ডলারে।
নিয়ম অনুযায়ী, ভোজ্যতেলের আমদানি মূল্যের ৯৫ ভাগের ওপর ১৫ শতাংশ ভ্যাট দিতে হয় ব্যবসায়ীদের। এরপর দেশে ৫ ভাগ মূল্য সংযোজন হলে সেটিসহ ১০০ ভাগের ওপর ৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপ করা হয়। তবে সরকার বর্তমানে আমদানি পর্যায়ে ১০ শতাংশ ও দেশে মূূল্য সংযোজনের ওপর ৫ শতাংশ ভ্যাট জুন পর্যন্ত স্থগিত করেছে। এ কারণে ভোজ্যতেল আমদানি ও বিপণনের ক্ষেত্রে তেমন একটা মূল্য পার্থক্য হয়নি।
Posted ৪:০৫ পূর্বাহ্ণ | সোমবার, ১১ এপ্রিল ২০২২
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta