কক্সবাংলা ডটকম(৩ জানুয়ারী) :: আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকারের মেয়াদের চার বছরের মাথায় মন্ত্রিসভায় আকস্মিকভাবে বড় ধরনের রদবদল হয়েছে। গতকাল বুধবার মহাজোটের শরিক দলের তিন মন্ত্রীর দপ্তর পুনর্বণ্টন করা হয়েছে। সেই সঙ্গে মঙ্গলবার নিযুক্ত তিন মন্ত্রী এবং এক প্রতিমন্ত্রীও নতুন দপ্তর পেয়েছেন। ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটনমন্ত্রী রাশেদ খান মেননকে সমাজকল্যাণ মন্ত্রী করা হয়েছে। জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য, পানিসম্পদ মন্ত্রী ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদকে করা হয়েছে পরিবেশ ও বনমন্ত্রী। পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকা জেপি সভাপতি আনোয়ার হোসেন মঞ্জুকে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
সরকারের শেষ সময়ে এসে হঠাৎ করে জোটমন্ত্রীদের দপ্তর বদলের এ ঘটনা রাজনীতিতে নানা প্রশ্ন ও আলোচনার জন্ম দিয়েছে।অনেকটা চমকে দিয়েই মন্ত্রিসভায় পরিবর্তন এনেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারক নেতারাও মন্ত্রিসভায় আকস্মিক রদবদল নিয়ে বিস্মিত। এটা তাদের অনেকেরই ধারণার বাইরে ছিল। মন্ত্রিসভার তিন জন মন্ত্রী ও একজন প্রতিমন্ত্রীর দফতর পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু তাতে খুশি নন কেউ কেউ। তারা কেউ তা ব্যক্ত করেছেন। কেউ করেননি। আবার কেউ এড়িয়ে গেছেন সুকৌশলে। একইসঙ্গে নতুনদের মধ্যে আনন্দের পাশাপাশি পছন্দসই দফতর না পাওয়ার অতৃপ্তিও আছে। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
পুরনোদের মধ্যে রাশেদ খান মেননকে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় থেকে সরিয়ে সমাজকল্যাণমন্ত্রী করা হয়েছে। এতে তিনি কিছুটা কষ্ট পেলেও তা ব্যক্ত করেননি। যদিও তার মুখে শোনা গেলো, ‘সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় এমন একটি মন্ত্রণালয় যেখানে সাধারণ ও প্রান্তিক মানুষ, প্রতিবন্ধী আর সমাজের পিছিয়ে পড়া মানুষদের নিয়ে কাজ করতে পারবো। তাই আমি মনে করি, এখানে আরও বেশি কাজ করার সুযোগ আছে। বিশেষ করে মানুষের সঙ্গে মিশে কাজ করার সুযোগ হলো। আশা করি, এই মন্ত্রণালয়েও সফলভাবে কাজ করতে পারব। বিমান মন্ত্রণালয়ে আমি সফলতা দেখিয়েছি।’
তবে সমাজকল্যাণমন্ত্রী করায় রাশেদ খান মেননের সমর্থকদের মধ্যে হতাশা লক্ষ্য করা গেছে। ওয়ার্কার্স পার্টির একাধিক নেতাকর্মী মনে করছেন, এর মাধ্যমে তার পদাবনতি হয়েছে। তাদের মতে, বিমান মন্ত্রণালয়ের মতো মর্যাদার নয় সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়।
রদবদলে আছেন পানিসম্পদমন্ত্রী ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ। বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয় সামলানোর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে তাকে। গুরুত্বের দিক দিয়ে পানিসম্পদের তুলনায় বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয় অনেকটাই উঁচুতে। তাই দফতর পরিবর্তনে তেমন অখুশি নন আনিসুল ইসলাম মাহমুদ। এরপরও প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সরকারে ছিলাম, সরকারে আছি। প্রধানমন্ত্রী যে দায়িত্ব দিয়েছেন তা আগেও পালন করেছি, আগামীতেও করবো।’
অন্যদিকে বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয় থেকে সরিয়ে পানিসম্পদমন্ত্রীর দায়িত্ব দেওয়া আনোয়ার হোসেন মঞ্জু মনোক্ষুণ্ন হলেও কথা বলেছেন সুকৌশলে। মন্ত্রণালয় পরিবর্তন প্রসঙ্গে দেওয়া তার ভাষ্য, ‘কেন ও কিসের জন্য এই পরিবর্তন তার তারষ বলতে পারবেন একমাত্র প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। উনি হর্তা কর্তা বিধাতা।উনি সব নির্ধারণ করেন। এ বিষয়ে আমার কোনও ক্রিয়া বা প্রতিক্রিয়া নাই।’
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী থেকে পূর্ণ মন্ত্রী হিসেবে পদোন্নতি পাওয়া নারায়ন চন্দ্র চন্দ মনে করেন, কাজের স্বীকৃতি পেয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘আমি কাজের স্বীকৃতি পেয়েছি। নেত্রী যে আস্থা রেখে দায়িত্ব দিয়েছেন তা মর্যাদার সঙ্গে পালন করাই আমার চ্যালেঞ্জ।’
দফতর পরিবর্তন হয়েছে প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিমের। তিনি ছিলেন ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে। তাকে পাঠানো হয়েছে তথ্য মন্ত্রণালয়ে। সেখানে পূর্ণমন্ত্রী রয়েছেন হাসানুল হক ইনু। এভাবে সরিয়ে দেওয়ায় তিনি কিছুটা কষ্ট পেয়েছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।
তবে প্রধানমন্ত্রীর প্রতি কৃতজ্ঞতার অন্ত নেই তারানার। বারবার সেই কৃতজ্ঞতা ব্যক্ত করে তিনি বলেন, “আমাদের নেত্রী শেখ হাসিনার ওপর আমি কৃতজ্ঞ। তিনি আমাকে দু’বার সংসদ সদস্য বানিয়েছেন, প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্বও দিয়েছেন। তিনি না চাইলে এসবের কিছুই হতে পারতাম না। বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে ধারণ করে আমার ওপর রাখা তার বিশ্বাস ও আস্থা রাখার চেষ্টা করেছি।’
তবে অনেকটা কষ্ট নিয়ে তারানা হালিম বলেছেন, ‘এভাবে সরিয়ে দেওয়া! মানুষ হিসেবে আমার লাগে। কারণ আমি রক্তে-মাংসে গড়া একজন মানুষ। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের কাজ শেষ করে এনেছি। স্যাটেলাইট বিষয়ে মানুষের কোনও ধারণাই ছিল না। থাকলেও তা ছিল ভ্রান্ত ধারণা। আমি মানুষের মধ্যে সেই ধারণার জন্ম ও ভ্রান্ত ধারণা বদলে দিয়েছি। এমন পরিস্থিতিতে আমাকে সরিয়ে দেওয়াটা মানুষ হিসেবে একটু লাগে। আমি তো ফেরেশতা নই, অন্য কিছুও নই; মানুষ। রক্তে-মাংসে গড়া।’
এদিকে নতুনদের মধ্যে ডাক ও টেলিযোগাযোগ এবং তথ্যপ্রযুক্তিমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পেয়েছেন মোস্তাফা জব্বার। তিনি বলেছেন, ‘ডাক ও টেলিযোগাযোগ এবং আইসিটি বিভাগের মধ্যে সমন্বয় করতেই হয়তো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এমন একটি দুঃসাহসিক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।’
নতুনদের মধ্যে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পাওয়ায় শাহজাহান কামাল খুব খুশি। তিনি মনে করেন, দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে এটাই শেখ হাসিনার কাছ থেকে পাওয়া তার সেরা উপহার। তিনি বলেছেন, ‘আনন্দের এই প্রতিক্রিয়া ভাষায় ব্যক্ত করা সম্ভব নয়।’
শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেওয়া কাজী কেরামত আলী খুশি হলেও নিজের দফতর নিয়ে সন্তুষ্ট নন তিনি। তার সমর্থকদের সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্য জানা গেছে।
মঙ্গলবার (২ জানুয়ারি) সন্ধ্যায় বঙ্গভবনের সামনে থাকা কেরামত আলীর গ্রামের বাড়ি রাজবাড়ীর সমর্থকরা শুনেছিলেন, তাদের নেতা স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী হচ্ছেন। এতে রাজবাড়ীসহ বঙ্গভবনের সামনে সমর্থকরা আনন্দ-উচ্ছ্বাস শুরু করেন।
কিন্তু শপথ গ্রহণ শেষে কেরামত আলী বঙ্গভবন থেকে বেরিয়ে জানান, তিনি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী হয়েছেন। এতে তাৎক্ষণিকভাবে সমর্থকদের উচ্ছ্বাসে ভাটা পড়ে। বুধবার মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে মাদ্রাসা ও কারিগরি বিভাগের প্রতিমন্ত্রী হিসেবে প্রজ্ঞাপন জারির পর তা আরও প্রকট হয়।
একজন সমর্থক নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, কেরামত আলী এমন একটি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পেলেন যা সাধারণ মানুষকে বোঝানোই যাবে না!
তবে শেখ হাসিনার মতো একজন নেত্রীর নেতৃত্বাধীন সরকারে কাজ করার সুযোগ পেয়ে নিজেকে ধন্য মনে করেন কেরামত আলী। তিনি বললেন, ‘নেত্রী বিশ্বাস রেখে দায়িত্ব দিয়েছেন. সেটাই বড় কথা।’
এদিকে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত নুরুজ্জামান আহমেদকে মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। তাকে রাখা হয়েছে একই মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী হিসেবে। প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘কষ্ট পেয়ে আর কী হবে! রাজপথে রাজনীতি করা মানুষ আমি। প্রধানমন্ত্রী আমাকে প্রতিমন্ত্রী বানিয়েছেন, এটাই তো অনেক।’
অন্য এক প্রশ্নের জবাবে সমাজকল্যাণ প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘মন্ত্রণালয়ে একজন পূর্ণ মন্ত্রী এসেছেন। এতে কাজ কিছুটা সহজ হলো, এই আর কী!’
এর আগে ২০১৫ সালের ১৪ জুলাই মন্ত্রিসভায় রদবদল আনা হয়। তখন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালক, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী ইয়াফেস ওসমান এবং চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের নেতা নুরুল ইসলাম বিএসসিকে পূর্ণমন্ত্রী করা হয়। আর প্রতিমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন সংরক্ষিত নারী আসনের সংসদ সদস্য তারানা হালিম ও লালমনিরহাট-২-এর সংসদ সদস্য নুরুজ্জামান আহমেদ। গত বছরের ৯ জুলাই স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলামকে দফতরবিহীন মন্ত্রী করা হয়। পরে তাকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দিয়ে এলজিআরডি মন্ত্রী করা হয় ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেন। সমাজকল্যাণমন্ত্রী সৈয়দ মহসিন আলী ও একই মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী প্রমোদ মানকিন মারা যান। এরপর ২০১৬ সালের ১৯ জুন খাদ্য প্রতিমন্ত্রী থেকে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান নুরুজ্জামান আহমেদ।
জানা যায়, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি বিএনপিসহ বেশির ভাগ রাজনৈতিক দলের নির্বাচন বর্জনের মধ্যে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের মাধ্যমে টানা দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ। পরে ওই বছরের ১২ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে নতুন মন্ত্রিসভা শপথ নেয়। তখন অধিকাংশ পুরোনো মন্ত্রীকে বাদ দিয়ে অপেক্ষাকৃত নতুন ও আগের সরকারের সময় দলের বাদ পড়া জ্যেষ্ঠ নেতাদের নিয়ে সরকার গঠন করা হয়। ওই বছরের ২৬ ফেব্রুয়ারি আরেক দফা মন্ত্রিসভা সম্প্রসারণ করেন প্রধানমন্ত্রী। ওই সময় আবুল হোসেন মাহমুদ আলীকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং নজরুল ইসলামকে পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব দেওয়া হয়। হজ নিয়ে বিতর্কিত মন্তব্যের জন্য ২০১৪ বছরের ১২ অক্টোবর আবদুল লতিফ সিদ্দিকী ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয় থেকে অপসারিত হন।
“
Posted ৪:১৫ পূর্বাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ০৪ জানুয়ারি ২০১৮
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta