কক্সবাংলা ডটকম(২৭ আগস্ট) :: মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা নিধনের জন্য সেনাবাহিনীকে দায়ী করেছে জাতিসংঘ। সোমবার এক প্রতিবেদনে সংস্থাটি বলেছে, রোহিঙ্গা নিধনযজ্ঞে সেনাবাহিনী জড়িত।
ওই প্রতিবেদন উদ্ধৃত করে জাতিসংঘের ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশনের প্রধান মারজুকি দারুসম্যান বলেছেন, সেনাপ্রধানের পদত্যাগ করা উচিত। ইতোমধ্যে সেনাপ্রধানসহ ২০ জন বার্মিজ নাগরিকের ফেসবুক অ্যাকাউন্ট বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
প্রতিবেদনে নিধনযজ্ঞকে যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধ বলে উল্লেখ করেছে সংস্থাটি। বলা হয়েছে আগস্টে রোহিঙ্গাদের ওপর অভিযান ছিলো পূর্বপরিকল্পিত। আর অভিযানে যোগ দিয়েছিলো রাখাইনের অরোহিঙ্গা স্থানীয়রাও।
গত বছরের ২৫ আগস্ট নিরাপত্তা চৌকিতে আরসার হামলাকে রোহিঙ্গাবিরোধী অভিযানের কারণ বলা হলেও বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন ও সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, রাখাইন থেকে রোহিঙ্গাদের তাড়িয়ে দিতে এবং তাদের ফেরার সব পথ বন্ধ করতে আরসার হামলার আগে থেকেই পরিকল্পিত সেনা-অভিযান শুরু হয়েছিল। চলমান জাতিগত নিধনে হত্যা-ধর্ষণসহ বিভিন্ন ধারার সহিংসতা ও নিপীড়ন থেকে বাঁচতে বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর প্রায় সাড়ে ৭ লাখ মানুষ।
গত সোমবার (২৭ আগস্ট) এক প্রতিবেদনে রোহিঙ্গা নিধনযজ্ঞে সেনাবাহিনীর সংশ্লিষ্টতার কথা তুলে ধরে জাতিসংঘ। প্রতিবেদনে বলা হয়, সেনাবাহিনীর সঙ্গে বেসামরিক কর্তৃপক্ষও এই নিধনযজ্ঞে ইন্ধন জুগিয়েছে। রাষ্ট্রীয় উপদেষ্টা অং সান সু চিও তার সাংবিধানিক ক্ষমতা প্রয়োগ করে এই সহিংসতা থামাতে ব্যর্থ হয়েছেন।
জাতিসংঘ জানায়, রাখাইনে সংঘটিত হত্যাযজ্ঞ নিয়ে মিয়ানমার সরকারের প্রত্যাখ্যান ও অস্বীকারের মাত্রায় তারা অবাক হয়েছেন। এই ঘটনায় জড়িত সেনা কর্মকর্তাদের অবশ্যই বিচারের আওতায় আনা উচিত বলে মন্তব্য করা হয় প্রতিবেদনটিতে। এতে ছয়জন সেনা কর্মকর্তার নাম উল্লেখ করা হয়েছে যার মধ্যে সেনাপ্রধানও আছেন।
প্রতিবেদনে বলা হয়, সেনাবাহিনীর অভিযান হঠাৎ করে হয়নি। এটা পূর্বপরিকল্পিত ছিলো এবং আগে থেকেই বোঝা যাচ্ছিলো। এছাড়া ৫ সেপ্টেম্বর এই অভিযান শেষ হয়েছে দাবি করা হলেও অক্টোবর মাস পর্যন্তও এই অভিযান চলমান ছিলো। রাখাইনে থাকা রোহিঙ্গারা স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারছিলেন না। নিজেদের বাড়িতেই এক প্রকার বন্দি ছিলেন। হামলার শিকার রোহিঙ্গাদের কোনোরকম সুরক্ষা দেয়নি নিরাপত্তা বাহিনী। পায়নি কোনও মানবিক সহায়তাও।
জাতিসংঘের ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে ওই শুদ্ধি অভিযানের নেতৃত্ব দেয় তাতমাদাও বা মিয়ানমার সেনাবাহিনী। তাদের সঙ্গে অন্যান্য নিারপত্তা বাহিনীও ছিলো বিশেষ করে মিয়ানমার পুলিশ ও সীমান্তরক্ষী বাহিনী। ওয়েস্টার্ন কমান্ডের ইউনিটি সরাসরি এর সঙ্গে জড়িত ছিলো।
৩৩ ও ৯৯ লাইট ইনফ্যান্ট্রি ডিভিশন যুক্ত ছিলে এর সঙ্গে। তারা উপ-সেনাপ্রধান জেনারেল সো উইনের নির্দেশে কাজ করতো। লাইট ইনফ্যান্ট্রি ডিভিশনই সবচেয়ে বড় অপরাধগুলোর সঙ্গে জড়িত ছিলো। ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশন জানায়, নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে রাখাইনের স্থানীয়রাও রোহিঙ্গা নিধনে যোগ দেয়।
সেনাবাহিনীর এই অভিযানকে কাঠামোবদ্ধ নিপীড়ন উল্লেখ করে জাতিসংঘ জানায়, তারা বেসামরিক মানুষকে লক্ষ্য করেছিলো। বেশিরভাগ অভিযানই চলেছে সাধারণ মানুষের বসতিতে। সেনাসদস্যরা পালানোর চেষ্টা করা রোহিঙ্গাদেরও সরাসরি গুলি করেছে।
জাতিসংঘের ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশন তাদের প্রতিবেদনে চারটি বিষয়ে জোর দিয়েছে। এরমধ্যে রয়েছে, বেসামরিক হত্যা, যৌন নিপীড়ন, রোহিঙ্গাদের বাদ দিয়ে একক জাতিগত পরিচয় প্রতিষ্ঠার প্রয়াস এ সেনাবাহিনীর দায়মুক্তি।
বেসামরিক মানুষকে হত্যা
জাতিসংঘ জানায়, মিয়ানমার সেনাবাহিনী বেসামরিক রোহিঙ্গাদের লক্ষ্য করেই অভিযান চালায়। বারবার তারা মানবাধিকার ও আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করেছে। ১৯৬০ সালে নেওয়া সন্ত্রাসবিরোধী নীতি এখনও অটুট রয়েছে। ফোর কাটস নামে সেই নীতি অনুযায়ী অরাষ্ট্রীয় সশস্ত্র গোষ্ঠীর খাবার, অর্থ, তথ্য ও চাকরি থেকে বঞ্চিত করা হয়। শুদ্ধি অভিযানেও এই নীতি প্রয়োগ করে মিয়ানমার তবে আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী এটা অবৈধ। সেনাবাহিনী কখনই বেসামরিক মানুষকে ইচ্ছামতো হত্যা বা ধর্ষণ করতে পারে না। কিংবা পুরো গ্রাম জ্বালিয়ে দিতে পারে না। সেনাবাহিনীর এসব পদক্ষেপ ছিলো আইনবহির্ভূত।
যৌন নিপীড়ন
রাখাইন, কচিন ও শান রাজ্যে ২০১১ সাল থেকেই বেসামরিকদের ওপর যৌন নিপীড়ন চালানো হচ্ছে। গত তিন দশক ধরেই চলছে এটা। ধর্ষণ, সংঘবদ্ধ ধর্ষণ, যৌন দাসত্ব, জোরপূর্বক নগ্নতা, যৌন নিপীড়ন করেই হত্যা করার ঘটনা ঘটছে। আতঙ্ক ছড়ানোর হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে ধর্ষণকে।
সংখ্যালঘুদের বাদ দিয়ে জাতিগত পরিচয় প্রতিষ্ঠা
সেনাবাহিনী সবসময়ই নিজেদের মিয়ানমারের রক্ষাকর্তা ভেবে আসছে। বিগত বছরগুলোতে তাদের বিরুদ্ধে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার প্রমাণ পাওয়া গেছে। ধর্ম ও গোত্রের নামে আগেও হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে তারা। আর রোহিঙ্গা সংকট শুরু হয়েছ ১৯৬০ সাল থেকেই। রাষ্ট্র সবসময়ই রোহিঙ্গাদের বাঙালি বলে চিহ্নিত করতে চেয়েছে। এতে করে ধীরে ধীরে রোহিঙ্গারা রাষ্ট্রহীন হয়ে পড়েছে। অন্যান্য সম্প্রদায় কিছুটা নাগরিকত্বের অধিকার পেলেও রোহিঙ্গারা তা পায়নি। দিনদিন আরও অসহায় হয়ে পড়ছিলো তারা। তাই তাদের ওপর সহিংসতা আরও চড়াওভাবে চালায় সেনাবাহিনী।
দায়মুক্তি
মিয়ানমারে সেনাবাহিনীকে কখনওই আইনের আওতায় আনা যায়নি। তাদের কৃতকর্মের জন্য কখনোই দায়ী করা হয়নি। আর অপরাধ বারবারই অস্বীকার করা হচ্ছে। আইনের মাধ্যমেই তাদের অবাধ ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। তাই ধীরে ধীরে অপরাধের মাত্রা বেড়ে গেছে। একদমই এড়ানো না গেলে কখনও কখনও তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত হয়েছে। কিন্তু বিচার হয়নি। দেশের রাজনৈতিক ও আইনি কাঠামো এভাবেই রুপ নিয়েছে। সামরিক বিচারেও সেনাপ্রধানই চূড়ান্ত রায় দেন।
এসব অভিযোগ ছাড়াও সেনাবাহিনী কর্তৃক রোহিঙ্গা নিধনযজ্ঞকে যুদ্ধাপরাধ, মানবতাবিরোধী অপরাধ ও হত্যাযজ্ঞ বলে উল্লেখ করা হয়েছে জাতিসংঘের প্রতিবেদনে।
Posted ৯:৩৯ অপরাহ্ণ | সোমবার, ২৭ আগস্ট ২০১৮
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta