কক্সবাংলা ডটকম(২৭ ফেব্রুয়ারী) :: মিয়ানমারের উত্তপ্ত রাখাইন রাজ্যের রাজধানী সিত্তুইতে শনিবার (২৪ ফেব্রুয়ারি) সকালে তিনটি বোমা বিস্ফোরিত হওয়ার ফলে সেখানে আরো সহিংসতার শঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে।
তিনটি বোমার একটি বিস্ফোরিত হয় ক্ষমতাধর রাজ্য সচিব তিন মঙ সোইয়ের আবাসিক কম্পাউন্ডে। অপর দুটি বিস্ফোরিত হয় একটি আদালত ও ভূমি অফিসের কাছে। এতে আহত হয় এক পুলিশ সদস্য। আরো কয়েকটি ডিভাইস অবিস্ফোরিত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়।
সিত্তুইয়ে সহিংসতা নতুন কিছু নয়। ২০১২ সালে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার সময় কসমোপলিটান বাণিজ্যিক বন্দরটি থেকে রোহিঙ্গা মুসলিমদের নির্মূল করে দেয়। এর পর থেকে সেখানকার প্রায় ৯৫ হাজার মুসলিম অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুত লোকজনের (আইডিপি) ক্যাম্পগুলোতে কোনো মতে জীবন ধারণ করে রয়েছে।
সিত্তুই’র মধ্যভাগে রয়েছে আঙ মিঙ্গালার ঘেটৌ। এখানে কয়েক শ’ লোকের বাস, বেশির ভাগই রোহিঙ্গা। পুরো নগরীতে কেবল এখানেই মুসলিম বসতি টিকে আছে। ক্যাম্প ও ঘেটৌ উভয় স্থানেই বসবাসকারী লোকজনের চলাচলে প্রবল বাধানিষেধ রয়েছে।
গত আগস্টে সন্ত্রাসী হামলার পর মিয়ানমার সামরিক বাহিনী নৃশংস ‘শুদ্ধি অভিযান’ চালায়। এর ফলে প্রায় সাত লাখ রোহিঙ্গা সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশে পাড়ি জমাতে বাধ্য হয়।
সিত্তুইয়ে রয়েছে এই অঞ্চলে কর্মরত জাতিসঙ্ঘ ও আন্তর্জাতিক কয়েকটি সাহায্য সংস্থার সদরদফতর। এখানে প্রায়ই উচ্চ পর্যায়ের বিদেশী অতিথিরা আসেন।
বোমা হামলাকে গত ১৬ জানুয়ারি রাখাইনের মরাউক উ-এ বেসামরিক বিক্ষোভকারীদের ওপর মিয়ানমার পুলিশের গুলিতে সাত বিক্ষোভকারীর নিহত হওয়ার বদলা বলেই ধারণা করা হচ্ছে।
এটা ২০০৯ সালে সৃষ্ট জাতিগত রাখাইন সশস্ত্র প্রতিরোধ আন্দোলন আরাকান আর্মির (এএ) শক্তিবৃদ্ধির প্রমাণ হতে পারে। তারা নর্দার্ন অ্যালায়েন্সের সদস্য হিসেবে সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে। এএ উত্তর-মধ্য রাখাইন রাজ্য ও প্যালেতওয়া টাউনশিপসহ প্রতিবেশী দক্ষিণ চিন রাজ্যে তাদের কার্যক্রম সম্প্রসারণ করেছে।
সম্প্রতি প্রধান সিত্তুই-ইয়াঙ্গুন সড়ক ও মধ্য মরাউক উ টাউনশিপে কয়েক দফা বোমা হামলার পর সেখানকার কর্মকর্তারা ভয় পেয়ে যান। তাদের আশঙ্কা এএ ইউনিটগুলো মধ্য রাখাইনে তাদের কার্যক্রম সম্প্রসারিত করেছে।
গত দুই বছরে মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করা কিংবা এএ-কে সমর্থন প্রদানের জন্য বেশ কয়েকজন রাখাইন বেসামরিক লোককে গ্রেফতার করা হয়েছে। সম্প্রতি এএ’র জনপ্রিয়তা ব্যাপকভাবে বেড়ে গেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
সিত্তুই-এ আরসার বোমা হামলার বিষয়টি উড়িয়ে দেওয়া যায় না। সরকারি বাহিনীর বিরুদ্ধে হামলায় গ্রুপটি সম্প্রতি ইম্প্রভাইজড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস (আইইডি) ব্যবহার করেছে। নিরাপত্তা বাহিনী সম্প্রতি ঘরে তৈরি বোমার সরঞ্জামসহ কয়েকটি আরসা আইইডি প্রশিক্ষণ ক্যাম্পের সন্ধান পেয়েছে।
গত ৫ জানুয়ারি আরসার সর্বশেষ হামলায় মিয়ানমার সেনাবাহিনীর পাঁচ সদস্য আহত হয়। তারা উত্তর মাংডুর তুরাইঙ গ্রামের কাছে আইইডি বিস্ফোরণের জন্যও দায়ী ছিল। ঘটনার দু’দিন পর তারা টুইটারে ওই হামলার দায়দায়িত্ব স্বীকার করে।
সিত্তুইয়ে বোমা হামলার পর ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা আবর্জনা,
আরসার দায়দায়িত্ব ঠিক হয়ে থাকলে ধরে নিতে হবে সরকারের কঠোর নিয়ন্ত্রণে থাকা এলাকাগুলোতেও আসরার বিদ্রোহীরা ঢুকে পড়েছে। আবার সরকারও আরসাকে কলঙ্কিত করার জন্য নিজেরাই এ ঘটনা ঘটিয়ে থাকতে পারে। মিয়ানমার সরকার ২০১৪ সালের সন্ত্রাসপ্রতিরোধ আইনে আরসাকে নিষিদ্ধ করেছে। তারা একে ‘চরমপন্থী বাঙালি সন্ত্রাসী’ সংগঠন হিসেবে অভিহিত করেছে।
গত ৩১ জানুয়ারি আরসা আরেকটি ভিন্ন ধরনের হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে একটি বিবৃতি দেয়। এতে সশস্ত্র গ্রুপ, ডাকাতদল, মানব পাচারকারী, মাদক পাচারকারীদের হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলা হয়, মিয়ানমারের সন্ত্রাসী সরকার আরসার ছদ্মনামে এসব কাজ করছে। তাদের এ বক্তব্য মিয়ানমার-বাংলাদেশ সীমান্তের জটিল সঙ্ঘাত ও অপরাধচিত্রকে আরো অস্পষ্ট করে তুলেছে।
তবে শনিবার সিত্তুই’র বোমা হামলা থেকে যেটা পরিষ্কার তা হলো, রাখাইন রাজ্যজুড়ে আরেক দফা সহিংস ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে এবং সহিংসতা দমন করে শান্তিপ্রতিষ্ঠার জন্য বেসামরিক-সামরিক এস্টাবলিশমেন্টের আলোচিত প্রয়াসের ওপর আরো চাপ সৃষ্টি করবে।
রাখাইনে বোমা বিস্ফোরণের ঘটনায় ১০ জন আটক
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের রাজধানী সিত্তেতে বোমা বিস্ফোরণের ঘটনায় জড়িত সন্দেহে কমপক্ষে ১০ জনকে আটক করেছে পুলিশ। আটককৃতদের সবাই জাতিগত রাখাইন বৌদ্ধ।
সিত্তে নগর পুলিশ স্টেশনের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, মহানগর আদালত আটককৃতদের দুই সপ্তাহের রিমান্ড মঞ্জুর করেছে। আটককৃতদের মধ্যে একজন মিয়ানমারের বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান ন্যাশনাল কাউন্সিল-এএনসি’র সদস্য।
এএনসি মিয়ানমারের জাতিগত সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর মাতৃ সংগঠন ইউনাইটেড ন্যাশনালিটিজ ফেডারেল কাউন্সিলের অন্যতম সদস্য। স্থানীয় সংবাদমাধ্যমের খবরে বলা হয়, আটকদের মধ্যে এএনসির কেন্দ্রীয় কমিটির একজন সদস্য রয়েছেন।
গত শনিবার ভোরে রাখাইন রাজ্যের রাজধানী সিত্তের পৃথক স্থানে তিনটি বোমা বিস্ফোরণ ঘটে। এতে এক পুলিশ কর্মকর্তাসহ অন্তত দুইজন আহত হন। এরমধ্যে রাজ্য সরকারের সচিবের বাড়িতে একটি বোমা আঘাত হানে। বাকি দুইটি আঘাত হনে পৃথক দুই শহরের একটি অফিসের সামনে ও একটি রাস্তায়। সেখানে তিনটি অবিস্ফোরিত বোমাও পাওয়া গেছে।