কক্সবাংলা ডটকম(২৬ এপ্রিল) :: মিয়ানমার সরকার রাখাইন রাজ্যে মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রতি তার আচরণ এবং অন্যান্য মানবাধিকার লঙ্ঘন, অন্যান্য জাতিগত এলাকায় সামরিক বাহিনীর আচরণ এবং সংবাদপত্রের স্বাধীনতা খর্ব করা প্রশ্নে ক্রমবর্ধমান আন্তর্জাতিক চাপের মধ্যে পড়তে যাচ্ছে। এসব ঘটনা আন্তর্জাতিক সমালোচনার সৃষ্টি হচ্ছে, নতুন করে অবরোধের শঙ্কা বাড়ছে। বিশেষ করে দেশটির সেনাবাহিনী বা তাতমাদাও নিষেধাজ্ঞার কবলে পড়তে পারে। মানবাধিকার লঙ্ঘনের পেছনে সেনাবাহিনীই সক্রিয় ছিল বলে অভিযোগের প্রেক্ষাপটে তারা চাপে রয়েছে।
রাখাইন রাজ্যের মুসলিম উদ্বাস্তুদের সমস্যা সমাধানে সরকারের প্রয়াসও খতিয়ে দেখবে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়। প্রতিবেশী বাংলাদেশে পালিয়ে যাওয়া ১০ লাখ উদ্বাস্তুর নিরাপদে ফেরার বিষয়টির দিকে নজর রাখবে থাকা। সিঙ্গাপুরে চলমান আসিয়ান শীর্ষ সম্মেলনেও বিষয়টি ব্যাপক গুরুত্ব পাচ্ছে। এরপর আসছে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের ১৫ সদস্যের সফরের বিষয়টি। বিশেষ সফরে মিয়ানমারে গিযে তারা রাখাইন রাজ্যের মুসলিমদের প্রত্যাবর্তনে সরকারি উদ্যোগ প্রত্যক্ষ করতে চাচ্ছে।
নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যদের মধ্যে উচ্চ পর্যায়ের মার্কিন প্রতিনিধি নিকি হ্যালেও রয়েছেন। রোববার রাজধানী নেপিয়াদাওয়ে তাদেরকে পরিস্থিতি সম্পর্কে অবগত করা হবে। এ সময় উপস্থিত থাকবেন দেশটির সর্বোচ্চ বেসামরিক নেতা আঙ সান সু কি।
রাখাইন প্রশ্নে কফি আনান কমিশনের সুপারিশমালা বাস্তবায়নে সরকার কী করেছে, তা সরেজমিনে দেখতে তারা এরপর রাখাইনের রাজধানী সিত্তুই সফর করবেন। মিয়ানমারে যাওয়ার আগে তারা বাংলাদেশে গিয়ে কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলো পরিদর্শন করবেন।
একই সময় আন্তর্জাতিক সমালোচনাও দেখা যাচ্ছে। রাখাইনে জাতিগত নির্মূল অভিযান পরিচালনা করার জন্য মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠেছে। এছাড়া কচিন রাজ্যসহ জাতিগত সংখ্যালঘু এলাকাগুলোতে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ রয়েছে। মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীকে আন্তর্জাতিক আদালতে নেওয়ার প্রস্তাবও রয়েছে।
রোম চুক্তি অনুযায়ী দি হেগের আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে (আইসিসি) বিচার করার কথা বলা হচ্ছে। মিয়ানমার রোম চুক্তির সদস্য না হলেও বাংলাদেশ যেহেতু এর সদস্য, তাই রোহিঙ্গাদের বিষয়টি আন্তর্জাতিক আদালতে উত্থাপন করা সম্ভব বলে আন্তর্জাতিক আইন বিশেষজ্ঞদের অনেকে অভিমত দিয়েছেন।
চলতি মাসের শুরুর দিকে প্রাক-বিচার শুনানিতে মিয়ানমার থেকে রোহিঙ্গা লোকজনকে বাংলাদেশে বহিষ্কার করার এখতিয়ার নিয়ে বিচারপতি অ্যান্টোনি কেসিয়া-এমবি মিদুয়া আইসিসির কাছ থেকে রুলিং কামনা চেয়েছেন।
আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আইসিসি যদি অনুমতি দেয়, তবে বাংলাদেশ তা আইনগতভাবে শুরু করতে পারে। আগামী কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই রুলিংটি পাওয়া যেতে পারে বলে আশা করা হচ্ছে। এটি ‘প্যান্ডোরার বাক্স’ খুলে দিতে পারে। এটি এড়ানোর চেষ্টা করে যাচ্ছেন মিয়ানমারের সামরিক নেতৃত্ব।
সামরিক গোয়েন্দা সূত্রের তথ্য অনুযায়ী, শীর্ষ জেনারেলসহ সশস্ত্র বাহিনীর শীর্ষ সদস্যরা এটি মোকাবিলার জন্য পরিকল্পনা প্রণয়ন করছেন।
রাখাইন পরিস্থিতির জন্য সামরিক বাহিনীর প্রতি প্রবল আন্তর্জাতিক চাপের ফলে দেশটির সেনাবাহিনীর শীর্ষ পর্যায়ে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে। আইসিসিতে নেওয়া নিয়ে সিনিয়র জেনারেল মিন আঙ হ্লাইঙ উদ্বিগ্ন।
গোয়েন্দা সূত্রগুলো জানাচ্ছে, গত কয়েক মাস ধরে তিনি তুলনামূলক শান্ত রয়েছেন, উচ্চবাচ্য করছেন না। এমনকি বার্ষিক সেনাবাহিনী দিবসেও তিনি নিচু স্বরে কথা বলেছেন বলে এশিয়ার কূটনীতিকরা জানিয়েছেন।
শীর্ষ জেনারেলদের সাথে গত কয়েক মাসে স্টেট কাউন্সিলর আঙ সান সু চির সম্পর্ক অত্যন্ত নাজুক পর্যায়ে উপনীত হলেও তারা এখন অনীহা সত্ত্বেও তারই সহায়তা দরকার বলে মনে করছে। সাবেক এক সিনিয়র সামরিক অফিসার সম্প্রতি সাউথ এশিয়ান মনিটরকে পরিচয় গোপন রাখার শর্তে বলেছেন, তিনিই আমাদের রক্ষা করতে পারেন, আন্তর্জাতিক সমালোচনা থেকে আড়াল করতে পারেন।
শীর্ষ সামরিক কমান্ডাররা এশিয়ান কূটনীতিকদের আশ্বাস দিয়েছেন, তারা দি লেডিকে (তারা সু চিকে এ নামেই ডাকে) সমর্থন করছেন। চীনারা বিশেষভাবে জোর দিয়েছে, তারা তাদের সাথে আলাদাভাবে চুক্তি করবে না। তবে ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্র্যাসির (এনএলডি) সিনিয়র নেতারা এখনো সংশয়ে আছেন। তারা জোর দিয়ে বলছেন, রাখাইন ইস্যুতে সেনা কমান্ডাররা সহায়তা করতে প্রস্তুত থাকলেও তারা শান্তি-প্রক্রিয়া নিয়ে বেসামরিক সরকারের সাথে সহযোগিতা করছে না। সামরিক বাহিনী নিজেদের মতো করে জাতিগত বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করছে।
তবে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী ও স্টেট কাউন্সিলর নিশ্চিতভাবেই রাখাইন প্রশ্নে ঐক্যবদ্ধভাবে নিরাপত্তা পরিষদের প্রতিনিধিদের সামনে উপস্থিত হতে চায়। নিরাপত্তা পরিষদের ১৫ সদস্যের সাথে থাকবেন প্রতিবেশী পাঁচ দেশের প্রতিনিধি। তাছাড়া আসিয়ানের বর্তমান চেয়ারম্যান সিঙ্গাপুর থাকছে।
নিরাপত্তা পরিষদ প্রতিনিধিদের এ সফর মিয়ানমারের জন্য সুযোগও হতে পারে। তারা রাখাইন রাজ্যবিষয়ক কফি আনান কমিশনের সুপারিশমালা বাস্তবায়নে কী কী করেছে, তা তুলে ধরতে পারে এখানে। রাখাইন রাজ্যের সহিংসতা অবসান, বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে আস্থা প্রতিষ্ঠা, উন্নয়ন কার্যক্রম এগিয়ে নিতে এসব সুপারিশকে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে গ্রহণ করেছে নিরাপত্তা পরিষদ।
থাইল্যান্ডের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. সুরাকিয়ার্তের পরামর্শক গ্রুপের সাথে সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যরা ঘটনাস্থলে বাস্তব পরিস্থিতি দেখতে চায়।
তারা সরাসরি স্টেট কাউন্সিলের কাছ থেকেও এ ব্যাপারে কথা শুনতে চায়। জাতিসংঘ সদস্যদের স্বাগত জানানো ও এ ব্যাপারে প্রস্তুতি সম্পন্ন করার জন্য সু চি আসিয়ান সম্মেলনে যাননি।
একটি সূত্র বলেন, এটি মিয়ানমার সরকারের পক্ষ থেকে ইতিবাচক উদ্যোগ। তবে সবকিছু মসৃণভাবে চলছে না। সীমান্তের উভয় পক্ষে প্রত্যাবাসন প্রশ্নে জাতিসংঘ ও বাংলাদেশের মধ্যে সমঝোতা স্মারক থাকলেও মিয়ানমার ও জাতিসংঘের মধ্যে নেই। উদ্বাস্তু প্রত্যাবর্তনে এটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
দুই পক্ষের মধ্যে এ নিয়ে আলোচনা চলছে বলে সরসারি সূত্র জানিয়েছে।
ইউএনডিপি ও ইউএনএইচসিআরের সাথে এ নিয়ে অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে বলে সিনিয়র সরকারি সূত্র জানিয়েছে। যেকোনো ধরনের প্রত্যাবাসন ও রাখাইনে উন্নয়ন কার্যক্রমে জাতিসংঘের এ দুটি সংস্থাই নেতৃত্ব দেবে বলে আশা করা হচ্ছে। মূল দলিল মিয়ানমার সরকার ব্যাপকভাবে সংশোধন করেছে বলে জানা গেছে। তারা এমন সব শর্ত জুড়ে দিচ্ছে, তা জাতিসংঘ সংস্থাগুলোর কাছে গ্রহণযোগ্য নয়।
তবে আশা করা হচ্ছে, নিরাপত্তা পরিষদের চলতি সপ্তাহান্তের সফরে বিদ্যমান অচলাবস্থা দূর হয়ে অতিপ্রয়োজনীয় গতির সঞ্চার হবে। বিশেষ দূত নিয়োগে জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্টোনিও গুতারেজের উদ্যোগ কার্যকর করা নিয়ে জটিলতারও অবসান হবে বলে আশা করা হচ্ছে। নিরাপত্তা পরিষদ ছয় মাস আগে ওই দূত নিয়োগের কথা বলেছিল। কিন্তু মিয়ানমার সরকার এতে রাজি হচ্ছিল না। এ নিয়োগ হলে জাতিসংঘের সাথে মিয়ানমারে আলোচনার সুযোগ করে দেবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
Posted ৬:৫৮ অপরাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ২৬ এপ্রিল ২০১৮
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta