(২০ জানুয়ারি) :: মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ শুক্রবার দেশটির রাখাইন রাজ্যের মংটো এলাকা পরিদর্শন করেছে। যেখানে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের জন্য ঘড় বাড়ি তৈরি করেছে দেশটি।
গত মঙ্গলবার রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে বাংলাদেশ মিয়ানমারের সাথে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেছে।ওই চুক্তি অনুসারে আগামী ২৩জানুয়ারি অথবা ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহ থেকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু হওয়ার কথা।
আর কোনো রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী যেন বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করতে না পারে, সে ব্যাপারে জোরালো ভূমিকা রাখার প্রত্যয় ছিলো মিয়ানমারের। গত মঙ্গলবার (১৬ জানুয়ারি) যখন রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন চুক্তিটি চূড়ান্ত হচ্ছিলো, ঠিক সেই সময় মিয়ানমারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বাংলাদেশকে এভাবে আশ্বস্ত করেছিলো। অথচ বাস্তবতা একেবারেই ভিন্ন। ওই আশ্বাসের ২৪ ঘণ্টা না পেরোতেই নাফ নদী পাড়ি দিয়ে এপারে আসে কমপক্ষে আড়াইশ রোহিঙ্গা।
এরপর খোদ আশ্রয় শিবিরগুলোতেই প্রশ্ন উঠেছে, রোহিঙ্গাদের ফেরাতে মিয়ানমার কতটা আন্তরিক? যদি আসলেই সরকার রোহিঙ্গাদের ফেরাতে চায়, তাহলে নতুন কাউকে অনুপ্রবেশে বাধা দিচ্ছে না কেন? নানান প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বেড়ানো রোহিঙ্গারা কোনো মিল পাচ্ছেন না মিয়ানমার সরকারের কথা আর কাজে। নিজ দেশে ফিরে যেতে উন্মুখ রোহিঙ্গারা চুক্তির শর্তাবলীকে সম্পূর্ণ অবাস্তব বলেই মনে করছে।
এদিকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে জাতিসংঘ আবারো তাদের আহ্বান পুনর্ব্যক্ত করে বলেছে, ফেরত যাওয়ার আগে সেখানে (মিয়ানমার) রোহিঙ্গারা নিরাপদ কিনা তা ভাবতে হবে। এছাড়া প্রত্যাবাসন হতে হবে রোহিঙ্গাদের ইচ্ছায়।
অপরদিকে জাতিসংঘ মহাসচিবের মুখপাত্র স্টিফানি ডুজারিক জাতিসংঘ সদরদপ্তরে নিয়মিত সংবাদ সম্মেলনের অংশ হিসেবে এ কথা বলেন।
তিনি বলেন, কেউ তাদের নির্ধারিত করে দিতে পারবে না। প্রত্যাবাসনে প্রত্যেক রোহিঙ্গার মিয়ানমার যাওয়াটা তাদের (রোহিঙ্গা) ইচ্ছার ওপর নির্ভর করবে।
অনুস্বন্ধানে টেকনাফ-উখিয়ায় আশ্রিত একাধিক রোহিঙ্গা নেতা বলেন, এবারের স্রোতে যারা এপারে চলে এসেছেন, তাদের মধ্যে অনেকেই শিক্ষিত-সচেতন। অনেকেই অবস্থাসম্পন্ন এবং তারা নিজেদের ভিটেমাটিতে ফিরে যেতে খুবই আন্তরিক। কিন্তু বর্তমান চুক্তির আওতায় ফিরে গেলে যেখানে যাবেন, সেটিকে ‘নরক’ বলেই আখ্যা দিচ্ছেন তারা।
মাত্র ছয় বছর বয়সে শরণার্থী জীবনে পা রাখেন আমানউল্ল্যাহ। উচ্চশিক্ষিত হয়ে একপর্যায়ে তিনি পাড়ি জমান একটি উন্নত দেশে। অতি সম্প্রতি কয়েকদিনের জন্য দেশে ফিরেছেন।
তিনি বলেন, গত আগস্ট-সেপ্টেম্বরের পর যেসব রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেছে, তাদের বেশিরভাগই অবস্থাসম্পন্ন। তাদের মধ্যে যাদের কিছুই নেই, তাদের অন্তত বসবাসের ভিটেটুকু আছে। অনেকের সোনার দোকান আছে।
বেশিরভাগ রোহিঙ্গার চাষাবাদের জমি আছে। হালের বলদও আছে অনেক মানুষের। সবকিছু রেখেই তারা আজ শরণার্থী। এই মানুষগুলো নিজ দেশে ফিরতে খুব বেশি উদগ্রীব হয়ে আছে। কিন্তু তাদের ফেরানোর যে চুক্তি হয়েছে দুই দেশের মধ্যে, সেটি সম্পূর্ণ অবাস্তব।
আমানউল্ল্যাহ বলেন, ‘চুক্তিতে বলা হয়েছে রোহিঙ্গাদের জোর করে মিয়ানমারে পাঠানো যাবে না। প্রত্যাবাসন হবে স্বেচ্ছামূলক। আবার ওদিকে মিয়ানমার বলছে প্রত্যাবাসনের পর এসব রোহিঙ্গাদের রাখা হবে একটি অস্থায়ী ক্যাম্পে। ক্যাম্পেই যদি থাকতে হয়, তাহলে রোহিঙ্গারা ফিরে যাবে কেন? তারা তো নিজেদের ভিটেমাটি ফিরে পেতে উন্মুখ হয়ে আছে।’
গত ১৬ জানুয়ারি যে চুক্তি চূড়ান্ত করেছে বাংলাদেশ-মিয়ানমার, সেটি বাস্তবায়নের পরে কি হতে পারে, সে ব্যাপারে এখনও নিশ্চিত কিছু বলা যায় না। কিন্তু টেকনাফ-উখিয়ায় আশ্রিত রোহিঙ্গারা ফিরে তাকাচ্ছেন পাঁচ বছর আগের ঘটনায়। ২০১২ সালের সহিংসতায়ও প্রায় চার লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেছিলো।
ওই সময় উদ্ভুত পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের চাপের মুখে আকিয়াব শহরের নিকটবর্তী একটি ক্যাম্পে সরকার আশ্রয় দিয়েছিলো ১ লাখ ৪০ হাজার রোহিঙ্গাকে। শহরের আশপাশের এলাকাগুলো থেকে তাদের ওই ক্যাম্পে নেওয়া হয়। কয়েক মাস পরে ইস্যু ঠাণ্ডা হয়ে গেলে নড়েচড়ে বসে মিয়ানমার।
ওই ক্যাম্পের চারপাশে এমন প্রহরা বসানো হয়, যাতে ক্যাম্পের ভেতর থেকে একটি পাতাও বাইরে যেতে না পারে। সেই ঘটনার পর থেকে ওই ক্যাম্পটি কার্যত একটি বন্দিশালায় রূপ নেয়। সেখানে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের জীবন অত্যন্ত মানবেতর। তারা মনে করে থাকেন, ওই ক্যাম্প তাদের জন্য কারাগার, তারা সকলে বন্দি। গত পাঁচ বছরেও তারা মুক্তি পাননি।
এবারের প্রত্যাবাসন চুক্তির আওতায় বাংলাদেশ থেকে প্রতিদিন যে ৩০০ জন করে রোহিঙ্গাকে নিয়ে মিয়ানমারের নির্ধারিত ক্যাম্পে রাখা হবে, সেটিকেও ২০১২ সালের ওই ক্যাম্পের অনুকরণ বলে মনে করছেন রোহিঙ্গারা। আকিয়াবের সেই ‘বন্দিশালার’ কথা ভাবতেই শিউরে ওঠেন যে রোহিঙ্গারা, তারা কেউই স্বেচ্ছায় মিয়ানমারে ফিরে যেতে চাওয়ার কথা নয়। বিষয়টি আরও স্পষ্ট হয়েছে মঙ্গলবারের চুক্তির পরে আশ্রয়শিবিরে রোহিঙ্গাদের বিক্ষোভ প্রদর্শনের মধ্য দিয়ে।
এসব বাস্তবতার নিরিখে চূড়ান্ত হওয়া প্রত্যাবাসন চুক্তির ওপর ভরসা রাখতে পারছে না খোদ বাংলাদেশ সরকারও। চুক্তি অনুযায়ী আর মাত্র দুদিন পর (২৩ জানুয়ারি) থেকেই প্রতিদিন ৩০০ জন করে রোহিঙ্গাকে ফেরত নেওয়ার কথা মিয়ানমারের। দুদিন আগে সেই ধরনের কোনো আলামতও দেখা যাচ্ছে না। তাই চুক্তির অনিশ্চয়তার কথা মাথায় রেখেই আন্তর্জাতিক চাপ অব্যাহত রাখতে চায় ঢাকা।
ইতোমধ্যে এসব ব্যাপারে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রী সুষমা স্বরাজের সঙ্গে কথাও বলেছেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রী এ এইচ মাহমুদ আলী।
নয়াদিল্লিতে ওআইসি (অর্গানাইজেশন অব ইসলামিক কান্ট্রি) রাষ্ট্রদূতদের সঙ্গে নৈশভোজের বৈঠকেও পররাষ্ট্র মন্ত্রী এ বিষয়ে জোরালো বক্তব্য দিয়ে এসেছেন। রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমারের প্রতি চাপ অব্যাহত রাখতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে সজাগ রাখতে ওআইসি-দেশগুলির জোরালো ভূমিকা চেয়েছেন তিনি।
এদিকে, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন চুক্তির বাস্তবায়নের বিষয়টি আগামী সংসদ নির্বাচনের আগে আলোচনায় জায়গা করে নিবে বলেও ধারণা সরকারের। এ জন্য আগেভাগেই পরিস্থিতি সামাল দিতে ভারতের সহযোগিতা চেয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। সুষমা স্বরাজও বাংলাদেশের প্রতি তাদের আন্তরিক সহযোগিতার কথা পুনর্ব্যক্ত করেন। বিশেষ করে রোহিঙ্গাদের ফেরাতে বাংলাদেশের পাশে থাকার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন তিনি।
প্রত্যাবাসন চুক্তির শর্তাবলীর প্রতিটি অক্ষর পড়ে ফেলেছে আশ্রিত রোহিঙ্গারা। ক্যাম্প থেকে ক্যাম্পে এখন আলোচনার মূল বিষয়বস্তু এটি। ফলে ভারত যতই বাংলাদেশের পাশে থাকার ঘোষণা দিক না কেন, এসব শর্তের ‘ফাঁদে’ পা ফেলতে চাইছে না রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর একজন মানুষও। ফেরানোর নামে ‘বন্দি’ করতে এটি মিয়ানমারের কৌশল বলেই মনে করেন তারা। তারা আসলেই ফিরতে চান। তবে এক নম্বরে তারা চান বেঁচে থাকার নিশ্চয়তা। নিজেদের মাটিতে বসবাসের সুযোগ চান। অন্য কোনো শর্তে তারা যেতে রাজি নয়। চুক্তিতে কিন্তু এটিই স্পষ্ট লেখা আছে- কাউকে ধাক্কা দিয়ে ফেরত পাঠানো যাবে না; কেবল স্বেচ্ছায় ফিরতে চায়, এমন রোহিঙ্গাদেরকেই গ্রহণ করবে মিয়ানমার।
Posted ৩:০৮ পূর্বাহ্ণ | রবিবার, ২১ জানুয়ারি ২০১৮
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta