কক্সবাংলা রিপোর্ট(১১ আক্টোবর) :: রোহিঙ্গাদের বায়োমেট্রিক নিবন্ধন প্রক্রিয়ায় আরও বেশি সম্পৃক্ত হতে আগ্রহী জাতিসংঘ। নিবন্ধনের কিছু কাজে সংস্থাটি সরাসরি অংশ নিতে চায়। বর্তমানে বাংলাদেশ সরকারের নিবন্ধন প্রক্রিয়ায় কারিগরি সহায়তা দিচ্ছে জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআর।
এদিকে রোহিঙ্গাদের জন্য বিশ্বব্যাংকের ৪০ কোটি ডলারের সহায়তার বিষয়টি সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় আছে। এছাড়া দীর্ঘমেয়াদে রোহিঙ্গাদের নিয়ে নানামুখী চ্যালেঞ্জের আশঙ্কা আছে। ঢাকায় সরকারের উচ্চপর্যায় এবং সাহায্য সংস্থার সূত্রে জানা গেছে এসব তথ্য।
মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গার সংখ্যা বর্তমানে ৯ লাখের বেশি। আগে থেকেই তিন লাখের মতো রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছিলেন। গত বছরের অক্টোবরের পর ৮৭ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসেন। ২৫ আগস্ট মিয়ানমারের নিরাপত্তা চৌকিতে হামলার পর আরও পাঁচ লাখ ২০ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসেন। রোহিঙ্গাদের আসা অব্যাহত আছে।
জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বুধবার বলেছেন, ‘রোহিঙ্গাদের নিবন্ধন প্রক্রিয়ায় জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআর ভলান্টিয়ার হিসেবে কাজ করছে। তাদের পরামর্শ নেয়া হচ্ছে। তারা বলছে, নানান কিছু দেবে। কিন্তু এখন পর্যন্ত কিছুই দেয়নি। আমাদের হাতে সময় নেই। তাই আমাদের যা আছে তা দিয়ে বায়োমেট্রিক নিবন্ধন শুরু করে দিয়েছি।’
নিবন্ধন প্রক্রিয়ায় নেয়া তথ্য পর্যাপ্ত নয় বলে অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের পারিবারিক পরিচয়, কতজন সঙ্গে নিয়ে এসেছেন সব তথ্যই দেয়া হচ্ছে।’
রোহিঙ্গাদের শরণার্থী হিসেবে কেন ঘোষণা করা হচ্ছে না- জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘ওদের শরণার্থী ঘোষণা দেয়া হবে না। ওরা এদেশে থাকবে না। নিজেদের দেশ মিয়ানমারে ফিরে যাবে।’ নিরাপত্তা সহযোগিতা ও রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে আলোচনা করতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী শিগগিরই মিয়ানমার সফরে যাচ্ছেন।
এ সফরের দিনক্ষণ সম্পর্কে জানতে চাইলে মন্ত্রী বলেন, ‘২০ থেকে ২৫ অক্টোবরের মধ্যে মিয়ানমার সফরে যাব।’ তিনি এ বিষয়ে বিস্তারিত আর কিছু বলেননি।
আন্তর্জাতিক সংস্থার সূত্র মতে, সরকার রোহিঙ্গাদের নিবন্ধনের যে উদ্যোগ নিয়েছে তাকে জাতিসংঘ ইতিবাচক হিসেবে নিয়েছে। বর্তমানে নিবন্ধনে রোহিঙ্গাদের নাম, ছবি ও আঙুলের ছাপ নেয়া হয়েছে। তবে আন্তর্জাতিক মহল এটাকে অপর্যাপ্ত তথ্য বলে মনে করছে।
তাদের ধারণা, এসব তথ্য থেকে প্রমাণ করা কঠিন হবে যে, নিবন্ধিতরা মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গা। এ ধরনের প্রমাণ মিয়ানমার সরকার মেনে নাও নিতে পারে। ভবিষ্যতে মিয়ানমারের সঙ্গে আলোচনায় আরও অধিক তথ্য সংযোজনের প্রয়োজন।
নিবন্ধন প্রক্রিয়ায় তিনটি উপাদান থাকা উচিত বলে আন্তর্জাতিক মহলের অভিমত। এগুলো হল রোহিঙ্গাদের সংখ্যা নিরূপণ, তাদের পরিবারের সঙ্গে সম্পর্কিত বিস্তারিত তথ্য ও মিয়ানমারের কোথায় জন্ম ও বেড়ে উঠেছে এ সংক্রান্ত বিস্তারিত তথ্য।
রোহিঙ্গাদের শনাক্তকরণ সম্পর্কিত কিছু ঘটনা যেমন- পরিবারের কেউ অপহরণের শিকার কিংবা নিখোঁজ হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে তারা বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছেন কিনা। গর্ভবতী নারী হলে তার সন্তানের তথ্য নিবন্ধনে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। এসব বিস্তারিত তথ্যের পরিবর্তে সীমিত তথ্যের নিবন্ধন কোনো কাজে আসবে না বলে সংশ্লিষ্ট একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা ধারণা করছে।
অপর্যাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে কেন নিবন্ধন করা হচ্ছে- জানতে চাইলে ওই সূত্র বলেন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে নিবন্ধন হচ্ছে। তারা দ্রুত কাজটি করার চেষ্টা করছে। জাতিসংঘের কর্মকর্তারা বলছেন, ইউএনএইচসিআরের শরণার্থী বিষয়ে অভিজ্ঞতা থাকায় তাদের পক্ষে বিস্তারিত তথ্য সংবলিত নিবন্ধন কার্যক্রম যথাসম্ভব দ্রুত সম্পাদনের সক্ষমতা আছে।
এই সংস্থা প্রতি দুই সপ্তাহে পর্যাপ্ত তথ্য সংবলিত এক লাখ রোহিঙ্গার নিবন্ধন করার সক্ষমতা আছে। এখন পর্যন্ত ৭৮ হাজার রোহিঙ্গাকে বায়োমেট্রিক নিবন্ধনের আওতায় আনা সম্ভব হয়েছে।
ঢাকায় জাতিসংঘের কর্মকর্তারা মনে করেন, মিয়ানমারের সেনাবাহিনী সিদ্ধান্ত নিয়ে পদ্ধতিগতভাবে সমন্বিত উপায়ে রোহিঙ্গাদের বিতাড়িত করছে। ফলে এই ধারা শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সরকার ও জাতিসংঘের সংস্থাগুলোর মধ্যে সংকটের ব্যাপারে ধারণাগত তফাৎ লক্ষ্য করছে আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থা।
ফলে সংকট মোকাবেলায় কার্যক্রমে তার প্রভাব দেখা যায়। এখন থেকে ছয় মাস পর বর্তমান সংকটের পরিস্থিতি কী দাঁড়াবে সেটা নিয়ে চিন্তার পার্থক্য দেখা দিয়েছে।
জাতিসংঘের সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, এবারের রোহিঙ্গা সংকট পুরোপুরি জাতিগত নিধন। রাখাইন অঞ্চলটি খালি করে সেখানে নতুন বিনিয়োগের লক্ষ্য রয়েছে মিয়ানমারের। ফলে রাখাইনকে রোহিঙ্গা শূন্য করার এই কার্যক্রম দেশটির সেনাবাহিনী মাঝপথে থামাবে না। বর্তমানে বালুখালীতে তিন হাজার একর ভূমিতে রোহিঙ্গাদের রাখা এবং ভবিষ্যতে অবকাঠামোর উন্নয়ন না করে ভাসানচরে স্থানান্তরের কোনো পরিকল্পনা বাস্তবসম্মত নয়।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মতে, রোহিঙ্গাদের এক জায়গায় না রেখে আলাদাভাবে ২০টি ক্যাম্প নির্মাণ করে রাখা হলে তাদের তদারকি সহজ হবে।
রোহিঙ্গাদের শরণার্থী ঘোষণা দেয়া নিয়ে সরকারের সঙ্গে জাতিসংঘের মতপার্থক্য রয়েছে। সরকার মনে করে, জাতিসংঘের ১৯৫১ সালের শরণার্থী সংক্রান্ত কনভেনশনে বাংলাদেশ সই না করায় রোহিঙ্গাদের শরণার্থী ঘোষণার কোনো বাধ্যবাধকতা নেই।
রোহিঙ্গাদের শরণার্থী ঘোষণা করা হলে তাদের অনেক বেশি অধিকার নিশ্চিত করতে হবে বলে সরকারি মহলের ধারণা। কাজেই সরকার রোহিঙ্গাদের ‘জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত মিয়ানমারের নাগরিক’ বলে চিহ্নিত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
তবে জাতিসংঘের কর্মকর্তারা বলছেন, রোহিঙ্গাদের শরণার্থী ঘোষণা না করলে তাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠাতে সমস্যা হবে।
জাতিসংঘের সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা বলেছেন, ‘রোহিঙ্গাদের শরণার্থী হিসেবে না ডাকলেও তারা আসলে শরণার্থী। কারণ তারা মিয়ানমারে দমন-পীড়নের শিকার হয়ে এসেছেন। রোহিঙ্গাদের শরণার্থী ঘোষণা করলেই অধিকার দেয়া বাধ্যতামূলক এমন ধারণা অমূলক। শরণার্থীরা কতটুকু অধিকার ভোগ করবেন সেটা স্থানীয় পরিপ্রেক্ষিতে বিবেচ্য। মালয়েশিয়াতেও রোহিঙ্গা আছেন। তাদের শরণার্থী হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে।’
Posted ১০:৫৮ পূর্বাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ১২ অক্টোবর ২০১৭
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta