বৃহস্পতিবার ২৭শে জুন, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ১৩ই আষাঢ়, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

শিরোনাম

বৃহস্পতিবার ২৭শে জুন, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

শিরোনাম

রোহিঙ্গাদের যেভাবে নিঃশেষ করে দিচ্ছে মিয়ানমার

সোমবার, ২৮ আগস্ট ২০১৭
838 ভিউ
রোহিঙ্গাদের যেভাবে নিঃশেষ করে দিচ্ছে মিয়ানমার

কক্সবাংলা রিপোর্ট(২৮ আগস্ট) :: নিজ দেশে দশকের পর দশক নাগরিক অধিকার বঞ্চিত রোহিঙ্গারা পরিচিত বিশ্বের সবচেয়ে নিপীড়িত জাতি হিসেবে। রাখাইনের রোহিঙ্গারা নিজেদের দাবি করে আরব বংশোদ্ভূত আদি নৃগোষ্ঠী। তবে তাদের অবৈধ অভিবাসী বলে দাবি করছে মিয়ানমার সরকার। বিশ শতকের গোড়া থেকে চলা সংকট অব্যাহত আছে এখনো।

মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মসুলিমদের সঙ্গে বৌদ্ধ জনগোষ্ঠীর বিরোধের ইতিহাস ব্রিটিশ শাসনামল থেকেই। ১৯৪৮ সালে ব্রিটিশ শাসনের অবসানের পর রোহিঙ্গাদের সঙ্গে উত্তেজনা বাড়ে নবগঠিত রেঙ্গুন সরকারের। শুরু হয় দমন পীড়ন। ১৯৫০ সালে মুজাহিদ নামে রোহিঙ্গাদের একটি সংগঠন আরাকান রাজ্যকে পাকিস্তানের অংশ করার আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়। পাশাপাশি চলে স্বায়ত্বশাসনের আন্দোলনও। পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি সেনা অভিযানে দমন হয় সংগঠনটি।৮০ শতাংশ বৌদ্ধ অধ্যুষিত মিয়ানমারে এখন মুসলিম জনসংখ্যা প্রায় ২৩ লাখ। এর মধ্যে রোহিঙ্গা মুসলিম আছে আট লাখ।

সম্প্রতি দুনিয়ার সবচেয়ে নিপীড়িত জনগোষ্ঠী রোহিঙ্গাদের ওপর নতুন করে আবারও তাণ্ডব শুরু করেছে মিয়ানমারের কর্তৃপক্ষ। সরকারি বাহিনীর সঙ্গে একযোগে হামলায় অংশ নিচ্ছে স্থানীয় উগ্রপন্থী বৌদ্ধরা। ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ আর রাষ্ট্রীয় নিধনযজ্ঞ থেকে জীবন বাঁচাতে রোহিঙ্গাদের দৃষ্টি এখন বাংলাদেশ সীমান্তে। কিন্তু সেখানেও কড়া পাহারা । সীমান্তের নো-ম্যানস ল্যান্ডে হাজারো রোহিঙ্গার আর্তনাদ। এদের কেউবা এসেছেন মুমূর্ষ শিশু সন্তানকে কোলে নিয়ে কেউবা আবার গুলিবিদ্ধ অবস্থায়। কেউ এসেছে বয়োবৃদ্ধ মা-বাবাকে সঙ্গে নিয়ে। ইতিহাসের কালপঞ্জিতে দেখে নেওয়া যাক রোহিঙ্গাদের কিভাবে নিঃশেষ করে দিচ্ছে মিয়ানমার।

১৭৮৪ সালে বার্মার তৎকালীন রাজা আরাকান দখলের পর থেকে রোহিঙ্গাদের দীর্ঘ ভাগ্য বিড়ম্বনার শুরু। ১৭৯৯ সালে পঁয়ত্রিশ হাজারেরও বেশি মানুষ বার্মিজদের অত্যাচার থেকে বাঁচতে আরাকান থেকে নিকটবর্তী চট্টগ্রাম অঞ্চলে চলে আসে। ওই সময় আরাকানের হাজার হাজার মানুষকে হত্যা করা হয়।

ব্রিটিশরা এ অঞ্চল ছেড়ে যাওয়ার পর ১৯৬২ সালে বার্মার সামরিক জান্তা দেশটির ক্ষমতা দখল করে। মূলত এরপর থেকেই রোহিঙ্গাদের ওপর রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করে।

১৯৭০ সালে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব সনদ দেওয়া বন্ধ করে দেয় বার্মিজ কর্তৃপক্ষ।১৯৭৪ সালে তাদের ভোটাধিকার কেড়ে নেওয়া হয়।

১৯৭৭ সালে অপারেশন নাগামিন বা ড্রাগন কিং নামে একটি অভিযান শুরু করে মিয়ানমার সরকার। তখন দাবি করা হয়েছিল এর উদ্দেশ্য হচ্ছে কোনও বিদেশি মিয়ানমারে অবস্থান করছেন কিনা; তা যাচাই করা। তবে প্রকৃতপক্ষে এটি রোহিঙ্গা বিরোধী অভিযানে পরিণত হয়। সে সময় আড়াই লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসেন। জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে একটি প্রত্যাবসন চুক্তি হয়। এর অধীনে প্রায় সব রোহিঙ্গা ফেরত চলে যান।

১৯৮২ সালে মিয়ানমার নাগরিক আইন জারি করে। ওই আইনে দেশটিতে বসবাসরত ১৩৫টি জাতিকে স্বীকার করে নিলেও রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব অস্বীকার করা হয়। এই আইন এখনও বলবৎ আছে। রোহিঙ্গারা সরকারি অনুমতি ছাড়া ভ্রমণ করতে পারেন না। জমির মালিকানা অর্জন করতে পারেন না। দুইটির বেশি সন্তান না নেওয়ার অঙ্গীকারনামায় স্বাক্ষর করতে হয়।

১৯৯১ সালে ‘রাখাইনে শান্তি স্থাপনের লক্ষ্যে’ সরকারিভাবে দ্বিতীয় দফায় শুরু হয় রোহিঙ্গাবিরোধী অভিযান। সে সময় প্রায় আড়াই লাখ রোহিঙ্গা আবার বাংলাদেশে পালিয়ে আসেন।

১৯৯২ সালের শেষদিকে এবং ১৯৯৩ সালের গোড়ার দিকে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের জন্য আরেকটি চুক্তি স্বাক্ষর করে। বর্তমান পররাষ্ট্রমন্ত্রী এএইচ মাহমুদ আলী এ চুক্তি স্বাক্ষরে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

১৯৯৩ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত ১৩ বছরে প্রায় দুই লাখ ৩৬ হাজার রোহিঙ্গা মিয়ানমারে ফেরত যান। রোহিঙ্গাদের শেষ ব্যাচটি ২০০৫ সালে ফেরত যায়। সে সময় থেকে বাংলাদেশে থেকে ফিরে যায় প্রায় ৩৩ হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থী।

২০১২ সালের রোহিঙ্গাবিরোধী দাঙ্গায় নিহত হন শতাধিক রোহিঙ্গা। গৃহহীন মানুষের সংখ্যা এক লাখ ছাড়িয়ে যায়। সে সময় লক্ষাধিক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসেন।

২০১৬ সালের ৯ অক্টোবর বার্মিজ পুলিশ অভিযোগ করে, শতাধিক জঙ্গি (রোহিঙ্গা) তাদের সীমান্তবর্তী তিনটি ঘাঁটিতে হামলা চালিয়ে ৯ পুলিশ সদস্যকে হত্যা করেছে। এ সময় পাল্টা হামলায় আট হামলাকারীও নিহত হয়। পুলিশের দাবি, রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন নামের একটি সামরিক গোষ্ঠী এ হামলা চালিয়েছে। পরদিন ১০ অক্টোবর রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকায় মানবাধিকার সংস্থাগুলোর ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। বিভিন্ন শহরে সেনা মোতায়েন করা হয়।

একই বছরের ৩ নভেম্বর স্থানীয় অমুসলিম বাসিন্দাদের নিয়ে গঠিত বেসামরিক নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার কথা জানায় বার্মিজ পুলিশ।

৯ অক্টোবর মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বর্ডার গার্ড পুলিশের ক্যাম্পে হামলার ঘটনায় স্বাধীনতাকামী রোহিঙ্গাদের দায়ী করে দেশটির কর্তৃপক্ষ। এরপর থেকে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে শুরু হয় নতুন করে জাতিগত নিধনযজ্ঞ। সে সময় জীবন বাঁচাতে দলে দলে বাংলাদেশে ছুটে আসে রোহিঙ্গারা। সরকারি হিসাবে বাংলাদেশে বর্তমানে চার লাখ রোহিঙ্গার বসবাস। তবে বাস্তবে এ সংখ্যা আরও বেশি হবে বলে মনে করা হচ্ছে।

২০১৭ সালের জানুয়ারির গোড়ার দিকে বার্মিজ পুলিশ কর্তৃক রোহিঙ্গাদের ওপর নির্মম নির্যাতনের একটি ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। এতে দেখা যায়, সারি বেঁধে বসে থাকা রোহিঙ্গাদের ঘিরে আছে পুলিশ সদস্যরা। এক পর্যায়ে একজন পুলিশ কর্মকর্তা এক রোহিঙ্গাকে মারধর করতে শুরু করে। আরেক কর্মকর্তা এসে লাথি মারে তার মুখে। এরপর পর্যায়ক্রমে অন্যদেরও মারধর করতে থাকে পুলিশ সদস্যরা।

এক পুলিশ কর্মকর্তার ধারণ করা এই ভিডিও ছড়িয়ে পড়লে দুনিয়াজুড়ে সমালোচনার মুখে পড়ে মিয়ানমার সরকার। চাপের মুখে আইন ভঙ্গকারী পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার ঘোষণা দেয় কর্তৃপক্ষ।

ওই ভিডিও ছড়িয়ে পড়ার পর সরকার কর্তৃক গঠিত তদন্ত কমিশন জানায়, রাখাইন প্রদেশের মংডুতে কোনও ধরনের গণহত্যা বা ধর্মীয় নিপীড়নের অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায়নি।

জানুয়ারির শেষ দিকে সফররত কফি আনান কমিশনের সদস্যরা জানান, রাখাইন প্রদেশে নির্যাতনের শিকার হয়ে বাংলাদেশে আসা ৮০ শতাংশ নারী মিয়ানমারে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের সঙ্গে আলাপকালে তারা এ তথ্য দেন।

ফেব্রুয়ারিতে নিউইয়র্কভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ)-এর এক প্রতিবেদনেও একই রকমের তথ্য উঠে আসে। এতে বলা হয়, ধর্মীয় পরিচয়ের কারণে রোহিঙ্গা নারীরা এমন সহিংসতার শিকার হয়েছেন।

২১ জানুয়ারি মিয়ানমারের মংডু’তে কর্তৃপক্ষের ঘনিষ্ঠ স্থানীয় তিন রোহিঙ্গা মুসলিমের মরদেহের সন্ধান মিলে। এ ঘটনায় নাগরিক অধিকারের জন্য লড়াই করা রোহিঙ্গা দলগুলোকে দায়ী করে দেশটির কর্তৃপক্ষ।

মার্চে বার্মিজ পুলিশের হাতে আটক ৪২৩ জন রোহিঙ্গার একটি তালিকা প্রকাশ করে যুক্তরাজ্যভিত্তিক সংবাদমাধ্যম রয়টার্স। ২০১৬ সালের ৯ অক্টোবর থেকে আটক হওয়া এসব ব্যক্তিদের ১৩ শিশুও ছিল। ছিলেন ৭৫ বছরের বৃদ্ধও। ওই প্রতিবেদন প্রকাশের পর বিষয়টি স্বীকার করে কর্তৃপক্ষ।

বার্মিজ পুলিশের একজন কর্মকর্তা রয়টার্সকে বলেন, রোহিঙ্গা হামলাকারীদের সঙ্গে যারা সহযোগিতা করছে তাদেরই পুলিশ গ্রেফতার করছে। সে শিশুই হোক আর যা-ই হোক। তারা অপরাধী কিনা; সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণের এখতিয়ার আমাদের নয়। এটা আদালতের বিষয়।

মে মাসে বার্মিজ সেনাবাহিনীর এক বিবৃতিতে বলা হয়, রাখাইন রাজ্যে হত্যা, ধর্ষণ বা নির্যাতনের যে গুরুতর অভিযোগ উঠেছিল তা সম্পূর্ণ মিথ্যাচার।

২৭ জুন রাখাইন রাজ্যের পুলিশ প্রধান সেইন লুইন ঘোষণা করেন, মুখোশধারী হামলাকারীদের ব্যাপারে নিরাপত্তা বাহিনী ‘উচ্চ সতর্ক’ অবস্থান নিয়েছে।

৪ জুলাই রাখাইন রাজ্যের রাজধানী সিটওয়ের রাস্তায় সাত রোহিঙ্গাকে দেখতে পেয়ে তাদের ওপর হামলে পড়ে একদল উগ্রপন্থী বৌদ্ধ। তাদের দিকে ইট-পাথর ছুঁড়ে মারে হামলাকারীরা। এতে একজন নিহত হন। আহত হন ছয়জন। সিটওয়ে শহরের বাইরে একটি ক্যাম্পে থাকতেন ওই সাত রোহিঙ্গা। শহরের একটি আদালতে এক মামলায় সাক্ষ্য দিতে তারা ক্যাম্প ছাড়ার অনুমতি পেয়েছিলেন। সাক্ষ্য দেওয়া শেষে তারা স্থানীয় এক ব্যবসায়ীর কাছ থেকে নৌকা কিনতে সেখানে যেতে পুলিশের সাহায্য চান। ওই নৌকা কেনার সময়ই তাদের ওপর হামলে পড়ে উগ্রপন্থীরা।

৬ আগস্ট আনুষ্ঠানিকভাবে তদন্ত শেষ করার ঘোষণা দেয় রোহিঙ্গা নির্যাতন নিয়ে গঠিত মিয়ানমারের রাষ্ট্রীয় তদন্ত কমিশন। তাদের প্রতিবেদনে বলা হয, সেনাবাহিনীসহ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর বিরুদ্ধে রোহিঙ্গাদের খুন, ধর্ষণ এবং তাদের বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগের কোনও প্রমাণ মেলেনি। তাদের বিরুদ্ধে জাতিগত নিধনযজ্ঞের অভিযোগ ভিত্তিহীন।

২৪ আগস্ট মিয়ানমার সরকার এক বিবৃতিতে দাবি করে, রাখাইন রাজ্যের বিদ্রোহীরা ২৪টি পুলিশ চেকপোস্টে সমন্বিত হামলা চালিয়েছে। রাতভর সংঘর্ষে ৮০ বিদ্রোহীসহ (রোহিঙ্গা) ৯৮ জন নিহত হয়েছে। এই ঘটনায় রোহিঙ্গাদের ওপর নতুন করে তাণ্ডব শুরু করে মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনী। নির্বিচার খুন, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ থেকে বাঁচতে এরইমধ্যে বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছেন সহস্রাধিক রোহিঙ্গা।

838 ভিউ

Posted ১:১৯ অপরাহ্ণ | সোমবার, ২৮ আগস্ট ২০১৭

coxbangla.com |

এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

এ বিভাগের আরও খবর

Editor & Publisher

Chanchal Dash Gupta

Member : coxsbazar press club & coxsbazar journalist union (cbuj)
cell: 01558-310550 or 01736-202922
mail: chanchalcox@gmail.com
Office : coxsbazar press club building(1st floor),shaheed sharanee road,cox’sbazar municipalty
coxsbazar-4700
Bangladesh
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
বাংলাদেশের সকল পত্রিকা সাইট
Bangla Newspaper

ABOUT US :

coxbangla.com is a dedicated 24x7 news website which is published 2010 in coxbazar city. coxbangla is the news plus right and true information. Be informed be truthful are the only right way. Because you have the right. So coxbangla always offiers the latest news coxbazar, national and international news on current offers, politics, economic, entertainment, sports, health, science, defence & technology, space, history, lifestyle, tourism, food etc in Bengali.

design and development by : webnewsdesign.com