বিশেষ প্রতিবেদক :: কক্সবাজারের উখিয়ার রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবিরগুলোয় প্রায়ই গোলাগুলি, সংঘর্ষ, খুনোখুনি ও অপহরণের মতো অপরাধ আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে।
আধিপত্য বিস্তার, মাদক চোরাচালান নিয়ন্ত্রণ এবং চাঁদাবাজির ঘটনাকে কেন্দ্র করে মিয়ানমারের সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান স্যালভেশন আর্মি (আরসা) ও আরাকান রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশনের (আরেএসও) মধ্যে এই লড়াইয়ে সাধারণ রোহিঙ্গারা আতঙ্কিত।
জীবনের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন আশ্রয়শিবিরে নিয়োজিত দেশি-বিদেশি বেসরকারি সংস্থার কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।
আশ্রয়শিবিরের নিয়ন্ত্রণ, আধিপত্য বিস্তার, মাদক বিক্রি নিয়ে মিয়ানমারের দুটি সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান স্যালভেশন আর্মি (আরসা) ও রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশনের (আরএসও) মধ্যে প্রায় সময় সংঘর্ষ-গোলাগুলির ঘটনা ঘটছে।
মাঝেমধ্যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গেও সংঘর্ষে জড়াচ্ছে এই দুটি সশস্ত্র গোষ্ঠী।
চলতি মাসের প্রথম ১২ দিনে উখিয়ার কয়েকটি আশ্রয়শিবিরে একাধিক সংঘর্ষ, গোলাগুলি ও ধারালো অস্ত্রের আঘাতে অন্তত ৯ জন খুন হয়েছেন। এর মধ্যে সশস্ত্র গোষ্ঠী দুটির পাঁচজন সদস্যও রয়েছেন।
আশ্রয়শিবিরের কয়েকজন রোহিঙ্গা নেতা জানান, সন্ধ্যা নামার পরপরই আশ্রয়শিবিরগুলোয় আরসা, আরএসও সহ একাধিক গোষ্ঠী অস্ত্রের মহড়া দেয়। আধিপত্য বিস্তারে সন্ত্রাসীরা ফাঁকা গুলি ছুড়ে আতঙ্কের সৃষ্টি করে।
সশস্ত্র গোষ্ঠীর তৎপরতা অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। গত মে মাসে একাধিক সংঘর্ষের ঘটনায় ৭ জন রোহিঙ্গা খুন হয়েছেন। এপ্রিল মাসে ৪ জন। অথচ জুন মাসের প্রথম ১২ দিনেই খুন হয়েছেন ৯ জন।
আশ্রয়শিবিরের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) তথ্যমতে, গত পাঁচ মাসে একাধিক সংঘর্ষ ও গুলির ঘটনায় অন্তত ২৬ জন খুন হয়েছেন।
এর মধ্যে মার্চ মাসে খুনের ঘটনা ঘটেনি। জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে খুন হন ৪ জন করে মোট ৮ জন। ২০২৩ সালে খুন হয় ৬৪ জন।
এসব ঘটনায় আরসার শীর্ষ নেতাসহ ১২৯ সন্ত্রাসীকে গ্রেপ্তার করা হয়।
চলতি মাসে হঠাৎ আশ্রয়শিবিরে সশস্ত্র গোষ্ঠীর তৎপরতা বেড়ে যাওয়ায় কয়েক লাখ রোহিঙ্গার পাশাপাশি শরণার্থীদের সেবায় নিয়োজিত অর্ধশতাধিক দেশি-বিদেশি সংস্থার কর্মীরা আতঙ্কের মধ্যে আছেন। বিকেল চারটার আগে সবাই ক্যাম্প ত্যাগ করেন।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অভিযান চালিয়ে অস্ত্রশস্ত্র, গোলাবারুদসহ সন্ত্রাসীদের গ্রেপ্তার করলেও পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখা যাচ্ছে না।
বর্তমানে উখিয়া ও টেকনাফের ৩৩ আশ্রয়শিবিরে নিবন্ধিত রোহিঙ্গার সংখ্যা সাড়ে ১২ লাখ। এর মধ্যে উখিয়ার ২৩টি আশ্রয়শিবিরে ৯ লাখ রোহিঙ্গার বসবাস।
টেকনাফের ১০টি আশ্রয়শিবিরে মাঝেমধ্যে অপহরণ ও খুনের ঘটনা ঘটলেও উখিয়ার আশ্রয়শিবিরে খুনখারাবি নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।
থেমে নেই গোলাগুলি-খুনোখুনি
সর্বশেষ গত বুধবার উখিয়ার তাজনিমারঘোনা আশ্রয়শিবিরে (ক্যাম্প-১৯) আরসার সঙ্গে এপিবিএনের মধ্যে সংঘর্ষ ও গোলাগুলির ঘটনায় আবদুল মোনাফ (২৭) খুন হয়েছেন।
তিনি ওই আশ্রয়শিবিরের এ-৪ ব্লকের রোহিঙ্গা আজিম উল্লাহর ছেলে। আবদুল মোনাফ আরসার গান কমান্ডার। মোনাফের বিরুদ্ধে চারটি হত্যা, একটি অস্ত্রসহ ছয়টি মামলা রয়েছে।
আগের দিন মঙ্গলবার উখিয়ায় মধুরছড়া আশ্রয়শিবিরে (ক্যাম্প-৪) আরসার সন্ত্রাসীরা পিটিয়ে হত্যা করে সৈয়দ আমিন (৩৫) নামের আএসওর এক সদস্যকে।
সোমবার একই আশ্রয়শিবিরে (ক্যাম্প-৪) আরসার সন্ত্রাসীরা গুলি করে ও ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে আরএসওর আরও তিন সদস্যকে। গুলিবিদ্ধ হন আরও সাতজন রোহিঙ্গা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েক রোহিঙ্গা নেতা জানান, গত রোববার রাতে মধুরছড়া আশ্রয়শিবিরে অভিযান চালিয়ে র্যাব আরসার শীর্ষ কমান্ডার মৌলভি অলি আকিজসহ গোষ্ঠীর পাঁচ সদস্যকে গ্রেপ্তার করে। এ সময় বিদেশি পিস্তলসহ বিপুল গোলাবারুদ উদ্ধার করা হয়।
এ ঘটনার পর আরসার সন্ত্রাসীরা বেপরোয়া হয়ে ওঠে। প্রতিপক্ষ আরএসওর সদস্যদের পাশাপাশি এপিবিএন সদস্যদের ওপরও হামলার চেষ্টা চালাচ্ছে। গত মঙ্গলবার এপিবিএন সদস্যের ওপর হামলার ঘটনায় পাঁচজন রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীকে গ্রেপ্তার করা হয়।
আরএসও-আরসা মুখোমুখি
রোহিঙ্গা নেতা জানান, গত এপ্রিল মাস থেকে উখিয়ার হাকিমপাড়া, ময়নারঘোনা, লম্বাশিয়া, কুতুপালং রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবিরে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড শুরু করে সশস্ত্র গোষ্ঠী আরসা এবং আরএসও।
আশ্রয়শিবিরে মাদক চোরাচালান, আশ্রয়শিবিরের নিয়ন্ত্রণ, আধিপত্য বিস্তার নিয়ে আরএসওর সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়েছে আরসা। এক বছর আগেও অধিকাংশ আশ্রয়শিবির আরসার নিয়ন্ত্রণে ছিল। এখন সব কটি আশ্রয়শিবির নিয়ন্ত্রণ করছে আরএসও।
র্যাব-১৫ কক্সবাজার ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট লে. কর্নেল এইচ এম সাজ্জাদ হোসেন বলেন, র্যাব এ পর্যন্ত আশ্রয়শিবিরে অভিযান চালিয়ে আরসার শীর্ষ সন্ত্রাসী, সামরিক কমান্ডারসহ ১১২ সন্ত্রাসীকে গ্রেপ্তার করেছে।
এ ছাড়া তারা উদ্ধার করে ৫২ কেজি বিস্ফোরক দ্রব্য, ৭০টি দেশি ও বিদেশি অস্ত্র, বিপুল পরিমাণ গ্রেনেড-হ্যান্ড মাইন ও অ্যানিমেশন। উখিয়া-টেকনাফের গহিন পাহাড়ে অবস্থান করায় সব কটি সন্ত্রাসীকে গ্রেপ্তার করা সম্ভব হচ্ছে না।
টেকনাফের হ্নীলা ইউপি চেয়ারম্যান রাশেদ মাহমুদ আলী ও উখিয়ার পালংখালী ইউপি চেয়ারম্যান গফুর উদ্দিন চৌধুরী বলেন, রাখাইন রাজ্যে অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে দুই দেশের একাধিক চোরাচালান সিন্ডিকেট ইয়াবা-আইসের বড় চালান দেশে নিয়ে আসছে। মাদকের টাকায় সশস্ত্র গোষ্ঠী কিনছে ভারী অস্ত্র ও গোলাবারুদ।
এসব অস্ত্র ব্যবহার করে সন্ত্রাসীরা আশ্রয়শিবিরে খুনখারাবি বৃদ্ধির পাশাপাশি নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে পরিস্থিতি অশান্ত করার চক্রান্ত করছে। সন্ত্রাসীদের নির্মূলে আশ্রয়শিবিরে একসঙ্গে সব কটি আশ্রয়শিবির ও পাহাড়ে যৌথ অভিযান চালানো জরুরি হয়ে পড়েছে।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একাধিক কর্মকর্তা জানান, গত এপ্রিল ও মে মাসে পাচারের সময় টেকনাফ, উখিয়া, রামু ও নাইক্ষ্যংছড়িতে অভিযান চালিয়ে বিজিবি, র্যাব, পুলিশ অন্তত ৫২ লাখ ইয়াবা, ১৩ কেজি আইস, ৩৯টির বেশি দেশ-বিদেশি অস্ত্র, বিপুল গ্রেনেড গোলাবারুদ, বিস্ফোরকসহ ১২৯ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। তবু মাদক-অস্ত্র চোরাচালান নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না।
সূত্র : আব্দুল কুদ্দুস রানা,প্রথম আলো,কক্সবাজার।
Posted ৬:৫৫ অপরাহ্ণ | রবিবার, ১৬ জুন ২০২৪
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta