কক্সবাংলা ডটকম(২৫ আগষ্ট) :: বাংলাদেশের প্রতিবেশী মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে ২০১৭ সালে রোহিঙ্গাদের ওপর সে দেশের সেনাবাহিনী ও তার সহযোগীদের চরম নৃশংসতার এক বছর পূর্ণ হলো ২৫ আগস্ট।
গত বছর ২৫ আগস্ট আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরসা) মিয়ানমারের নিরাপত্তারক্ষীদের ওপর হামলা চালায়। এতে কয়েকজন নিরাপত্তারক্ষী নিহত হন।
ওই ঘটনার জের ধরে পরবর্তী সময় খুন করা হয় হাজার হাজার রোহিঙ্গাকে, ধর্ষণ করা হয় তাদের নারীদের, জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ছারখার করে দেয়া হয় তাদের জমিজিরাত-বসতবাটি।
প্রাণ বাঁচাতে দলেবলে বাংলাদেশের সীমান্ত পেরিয়ে ঢুকে পড়ে তারা, আশ্রয় নেয় বিভিন্ন শিবিরে। রাখাইন থেকে পালিয়ে আসার পথে নদী কিংবা সাগরে ডুবে মারা যায় কয়েকশ’ রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ ও শিশু।
ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ হয়ে প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গা পালিয়ে আশ্রয় নেয় বাংলাদেশে। কবে যে তাদের ফেরা হবে নিজ দেশে আজ পর্যন্ত নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি সে প্রশ্নের উত্তর, প্রাপ্তির খাতায় জমা হয়েছে কেবল আশাবাদ। রোহিঙ্গাদের স্বদেশে ফিরিয়ে নেয়ার ব্যাপারে দুদেশের মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষর হলেও এখন পর্যন্ত কার্যকর উদ্যোগ নেয়নি মিয়ানমার।
বিশে^র প্রায় সব দেশ রোহিঙ্গাদের পাশে দাঁড়ালেও তাদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনসহ ভাগ্য পরিবর্তনে কোনো অগ্রগতি হয়নি। বহু দেশের সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানসহ শীর্ষ কর্মকর্তা, জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন মানবাধিকার ও সাহায্য সংস্থা সমস্বরে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনসহ তাদের অধিকার ফিরিয়ে দেয়ার কথা বললেও মিয়ানমারের মন গলাতে পারেনি কেউ। উল্টো রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তন বিলম্ব হওয়ার জন্য মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সু কি দায় চাপিয়েছেন বাংলাদেশের ওপর।
উপরন্তু রোহিঙ্গাদের ফেলে আসা সব গ্রামে নির্মাণ করা হয়েছে বিভিন্ন ধরনের সেনা স্থাপনার অবকাঠামো। সেখানে এনে পুনর্বাসিত করা হয়েছে বিভিন্ন এলাকার বৌদ্ধ কিংবা অন্যান্য উপজাতির লোকজনকে। রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে মিয়ানমারকে বাধ্য করার জন্য বাংলাদেশ বিভিন্ন তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে।
তবে তাদের সামনে সবচেয়ে দুর্লঙ্ঘ্য বাধা জাতিসংঘে এ বিষয়ে চীন ও রাশিয়ার মিয়ানমারকে সমর্থন ও বাংলাদেশের বিপরীত অবস্থান গ্রহণ। ফলে মিয়ানমারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ প্রয়োগের বিষয়টি ভোঁতা হয়ে গেছে ইতোমধ্যে।
এদিকে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোও বলছে, রোহিঙ্গাদের রাখাইনে ফিরে যাওয়ার উপযুক্ত পরিবেশ এখনো তৈরি হয়নি। রোহিঙ্গারা এখনো সেখান থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আসছে। হতাশাজনক এ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব মো. শহিদুল হক গত বুধবার বলেন, বিষয়টি জটিল এবং সে কারণেই সময় সাপেক্ষ।
তবে সময় নিলেও রোহিঙ্গাদের অবশ্যই ফিরে যেতে হবে। ফিরে যাওয়ার আগে রোহিঙ্গারা চাইছেন তাদের সুরক্ষা, নিরাপত্তা ও নাগরিক অধিকারের নিশ্চয়তা। সে জন্য প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া কিছুটা বিলম্বিত হচ্ছে। পুরো প্রক্রিয়াটি একটি চ্যালেঞ্জ। সব চ্যালেঞ্জেরই একটি সমাধান রয়েছে। আমরা যে কোনো চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে পারব যদি একটি দৃঢ় ইচ্ছা আছে। এটাই সবচেয়ে জরুরি।
এদিকে সম্প্রতি সিঙ্গাপুরে এক অনুষ্ঠানে মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সিলর অং সান সু কি রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন বিলম্বের জন্য বাংলাদেশকে দায়ী করে বলেন, মিয়ানমার শরণার্থীদের নিতে প্রস্তুত, তাদের পুনর্বাসনের জায়গাও ঠিক হয়েছে। কিন্তু তাদের পাঠানোর দায়িত্ব মূলত বাংলাদেশের।
যদিও কর্মকর্তাদের বরাতে আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থা বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়, গত বছরের নভেম্বরে সই হওয়া প্রত্যাবাসন চুক্তির ১০ মাস পরও প্রধান কোনো শর্তই বাস্তবায়ন করেনি মিয়ানমার। শুধু দুটি অভ্যর্থনা ক্যাম্প এবং একটি ট্রানজিট ক্যাম্প তৈরি করা ছাড়া কাজের কাজ কিছুই করেনি তারা। বিশ্বজুড়ে আলোচিত এ সংকটের শুরু থেকেই বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় প্রত্যাবাসনের যাবতীয় পথ রুদ্ধ করে রেখেছে মিয়ানমার।
মিয়ানমারের নেত্রীর বক্তব্যের ব্যাপারে বাংলাদেশ আনুষ্ঠানিক কোনো প্রতিক্রিয়া না দিলেও সু কির এমন বক্তব্যকে দুর্ভাগ্যজনক বলে মনে করছেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা বলেন, মিয়ানমার নেত্রীর বক্তব্য দুর্ভাগ্যজনক।
অন্যদিকে বাংলাদেশ সরকারের রোহিঙ্গা শরণার্থী প্রত্যাবাসন বিষয়ক কমিশনার আবুল কালাম বলেছেন, মিয়ানমারের নেত্রীর বক্তব্যের সঙ্গে বাস্তবতার মিল নেই। গত বছরের নভেম্বর মাসে মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের চুক্তি হয়। এরপর দুদেশের কর্মকর্তাদের মধ্যে কয়েক দফা বৈঠক হয়েছে। কিন্তু চুক্তি সইয়ের ১০ মাসেও এর প্রধান কোনো শর্তই মিয়ানমার বাস্তবায়ন করেনি।
আবুল কালাম বলেন, মূল সমঝোতা চুক্তিতে পরিষ্কারভাবে বলা আছে, তারা প্রত্যাবাসিত হবে তাদের নিজেদের গ্রামে; সম্ভব হলে নিজঘরে। কোনো কারণে যদি তা সম্ভব না হয়, তাহলে এমন স্থানে নিতে হবে, যা তাদের গ্রামের নিকটবর্তী। কিন্তু এখন পর্যন্ত মিয়ানমার মোটা দাগে শুধু দুটি অভ্যর্থনা ক্যাম্প এবং একটি ট্রানজিট ক্যাম্প তৈরি করেছে।
এ ছাড়া মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে এখনো রোহিঙ্গাদের আটক ও নির্যাতন করা হচ্ছে বলে জানিয়েছে মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ)।
প্রতিষ্ঠানটি জানায়, বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের মধ্যে যারা এর আগে রাখাইন ফিরে গিয়েছিলেন তাদের আটক ও নির্যাতন করা হচ্ছে।
গত মঙ্গলবার হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এশীয় অঞ্চলের উপপরিচালক ফিল রবার্টসন স্বাক্ষরিত এক বিবৃতিতে এ তথ্য জানানো হয়। বিবৃতিতে বলা হয়, এই নির্যাতনই বলে দিচ্ছে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে নিরাপদ প্রত্যাবাসনের আগে সেখানে জাতিসংঘের নজরদারি কতটা জরুরি।
রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয়ার জন্য বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যেমন নন্দিত হয়েছেন বিশ^ব্যাপী, রোহিঙ্গাদের নির্যাতন বন্ধে প্রশ্রয়দাতার ভূমিকা পালনের কারণে ততটাই নিন্দিত হয়েছেন মিয়ানমারের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের নেত্রী অং সান সু কি। অতীতের সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকার মাধ্যমে অর্জিত নানা স্বীকৃতিও খোয়া গেছে তার।
তার হারানো স্বীকৃতির মধ্যে রয়েছে এলি উইজেল অ্যাওয়ার্ড, ফ্রিডম অব অক্সফোর্ড, এডিনবরা অ্যাওয়ার্ড, ইউনিসন অ্যাওয়ার্ড, ফ্রিডম অব গø্যাসগো অ্যাওয়ার্ড। এ ছাড়া অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘জুনিয়র কমন রুম’ টাইটেল থেকেও মুছে ফেলা হয়েছে সু কির নাম।
Posted ২:০৯ পূর্বাহ্ণ | শনিবার, ২৫ আগস্ট ২০১৮
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta